কৃষি ও গবাদি

‘স্বয়ংসম্পূর্ণ মাছে দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’

আগামি ১৮ জুলাই হতে ২৪ জুলাই পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপি দেশের মৎস্য বিভাগ ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ মাছে দেশ,বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ এ প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে দেশব্যাপি ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০১৮ পালন করতে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ বিশ্বে একটি নদীমাতৃক ও কৃষিনির্ভর দেশ। আবহমান কাল থেকেই নদ-নদীর সাথে আমাদের জীবনধারার বৈশিষ্ট্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেননা প্রাণিজ সম্পদ ও কৃষিপণ্য আমাদের স্বনির্ভতার প্রতীক।

এ দেশের নদ-নদীতে প্রচুর মৎস্য সম্পদে ভরপুর। পাশাপাশি নদী বিধৌত ও নদীতীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রচুর কৃষিপণ্য উৎপাদনে আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। কৃষির পাশাপাশি রয়েছে আমাদের গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি,ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও অন্যান্য প্রাণী। যা আমাদের জীবন ধারণের অন্যতম মাধ্যম।

গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে কৃষাণ-কৃষাণীরা গরু,ছাগল,ভেড়া ও অন্যান্য প্রাণী প্রতিপালন করে থাকেন। এতে একদিকে তাদের আয় রোজগার বাড়ছে অন্যদিকে আমাদের আমিষের যোগান হচ্ছে। নদ-নদীর মধ্যে রয়েছে বিশ্ব খ্যাত ইলিশ।

যতদূর জানা গেছে – বাংলাদেশ পৃথিবীর নদ নদীর দেশগুলোর মধ্যে সপÍম। এদেশের নদ-নদীতে বহু প্রজাতির মাছ রয়েছে। এর মধ্যে ইলিশের অবস্থান সর্বশীষে। ইলিশ আমাদের দেশের নদ-নদী ও সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বিশ্বে মিঠা পানি মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ। বাংলাদেশের মাছ প্রধানত: দু’ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এর একটি হলো লোনা পানির মাছ আর একটি হলো মিঠা পানির মাছ ।

দেশের জাতীয় মাছ হলো ইলিশ। আর্ন্তজাতিক সংস্থা ‘ওয়ার্ড ফিস ’র সাম্প্রতিক তথ্য মতে, ইলিশ রয়েছে বিশ্বের ১১ টি দেশে। এর মধ্যে ১০ টিতেই দিন দিন ইলিশের উৎপাদন কমছে। অথচ বাড়ছে বাংলাদেশে।

বিশ্বের ৬৫% ভাগ ইলিশ বাংলাদেশেই উৎপাদন হয়। ইলিশ সাগরে বসবাস করে । কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মেই বংশ বিস্তার করার জন্যে প্রায় ১২শ’ কি.মি.পর্যন্ত অতিক্রম করে আমাদের দেশের মিঠা পানিতে প্রবেশ করে। ১টি মা ইলিশ একসঙ্গে প্রায় ২০ লাখ পর্যন্ত ডিম ছাড়ে।
ইলিশ ছাড়াও আমাদের নদ-নদীতে পোঁয়া,রূপচাঁদা, ভেটকি,বাইলা প্রভৃিত সাগরের মাছ রয়েছে।

এক তথ্যে জানা গেছে- দেশে গড়ে প্রতি বছর ৩ লাখ ৪৬ হাজার মে.টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। যার বর্তমান বাজার মূল্য ১০ হাজার কোটি টাকা। ২০০৪ সাল থেকে দেশের মাছের অভয়াশ্রম গুলো নিয়ন্ত্রণ ও জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ফলে ইলিশের উৎপাদন ক্রমাগত ভাবে বাড়তে শুরু করে ।

আমাদের জাতীয় জেডিপিতে ইলিশের অবদান ১২ %। আমাদের প্রতি বছর ইলিশ মাছ রপ্তানি করে ২ শ’৫০ থেকে ৩শ’ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়। মাছ রপ্তানির আরেকটি খাত হলো চিংড়ি ।

বাংলাদেশে ৬৫ প্রকারের চিংড়ির প্রজাতি রয়েছে। বিশ্বব্যাপি দিন দিন চিংড়ি মাছের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে । দেশে প্রায় ২ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর নদীতীরবর্তী জমিতে চিংিড়ির চাষ হয়ে থাকে। প্রতি বছর উৎপাদিত চিংড়ির গড়ে ৫০ হাজার মে.টন রপ্তানি হয়। এ দেশে আমরা এক বলি ‘সাদা সোনা’। মিঠা পানির মাছ চাষে গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের মধ্যে একটি । সমুদ্রের মাছ আহরণের দিক বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম।

পৃথিবীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হলো আমাদের দেশের চট্রগ্রামের হালদা নদী। এর দৈর্ঘ্য ৮১ কি.মি.। ২৯ কি.মি.অংশে সারা বছর নৌকা চলাচল করে। ফলে জোয়ার-ভাটায় রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে ।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের পুষ্টি গুণ পেয়ে থাকে মাছে। মাছে আছে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, প্রোটিন,¯েœহ ছাড়াও আরো অন্যান্য ভিটামিন। মিঠা পানির মাছের মধ্যে রয়েছে কৈ, রুই, কাতলা, মাগুর, শিং, আইড়, চিতল, বোয়াল, সৌল, পুটি, কালিবাউ, বাইন, পাবদা, গজার, টেংরা, ঢেলা, মলা, মৃগেল, খলিসা, ভাগনা, বাতাশি, কাইকা, ঘনিয়া, বাইলা, চান্দা, খইলা, চাপিলা, রিটা, নন্দিনা, তেলাপিয়া, নাইলোটিকা, গ্রাসকাপ প্রভৃতি।

আমাদের নদ-নদী ,পুকুর,জলাশয়,খাল,বিল,ঝিল,হাওড়,বাওড় ও চরে প্রচুর পরিমাণে এসব মাছ প্রাকৃতিকভাবেই উৎপাদিত হয়ে থাকে। বর্তমানে এ জাতীয় অনেক মাছ এখন চাষাবাদ করা হয়। আমাদের দেশের অভ্যন্তরে যে প্রকারের মাছ পাওয়া যায় পৃথিবীর অনেক বড় দেশে এসব মাছই নেই ।

পৃথিবীর অন্যতম মিঠা পানির নদী মেঘনা। আমাদের এ মেঘনা একদিকে এর তলদেশ ভরাট হচ্ছে অপর দিকে পানি দূষিত হতে চলছে। এভাবে ক্রমাগত ভাবে চলতে থাকলে আমাদের জাতীয় সম্পদ ইলিশসহ সকল প্রকার মিঠা পানির মাছ আর থাকবে না ।

ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্প কল কারখানার বর্জ্য মাছের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। বুড়িগঙ্গা আর শীতলক্ষ্যার দূষিত পানি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া পেরিয়ে চাঁদপুরের নৌ-সীমানার ষাটনল পর্যন্ত প্রবেশ করে ফেলছে।

চাঁদপুরের উত্তর সীমানায় মতলবের ষাটনল পর্যন্ত ঢাকার বুড়িগঙ্গার দূষিত পানি ও নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর এ দুর্গন্ধময়, দূষিত ও আর্বজনাযুক্ত পানি মেঘনায় প্রবেশ করা শুরু করছে মাত্র । যা পরিবেশ বিপর্যয় ও আমাদের মাছের করুণ পরিণতি বয়ে আনবে। দেশের আনবিক শক্তি কমিশনসহ দেশের সকল পরিবেশবিদ ও মৎস্য বিজ্ঞানীদের এখনই ভাবতে হবে।

মৎস্য বিজ্ঞানী ও ইলিশ গবেষকদের মতে, অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে বিশেষ করে বিভিন্ন নদ-নদীতে বাঁধ ও ব্রিজের কারণে এবং উজান থেকে পরিবাহিত পলি নদীর তলদেশে জমার জন্যে পানি প্রবাহ কমে যায় এবং জলজ পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়ে। আরো একটি ভয়ানক পরিস্থিতি বয়ে আনবে ভারত যদি তুলপাই নামক স্থানে টিপাইমুখ বাঁধ একেবারেই দিয়ে ফেলে তাহলে মেঘনা আর মেঘনা নদী থাকবে না।

মেঘনার বিচিত্র্য মৎস্য সম্পদ বিলীন হয়ে যাবে । পরিবেশের ওপর পড়বে আমাদের নানা নেতিবাচক পরিস্থিতি। কী করা প্রয়োজন-এর ভাবনা এখনই ভাবতে হবে ।

এদিকে জলবায়ূর পরিবর্তনের কারণে ইলিশের পরিভ্রমণ, প্রজনন ক্ষেত্র এবং বিচরণ ও চারণ ক্ষেত্র দিন দিন পরিবর্তিত ও বিনষ্ট হচ্ছে। এতে উৎপাদনও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। নির্বিচারে কম ব্যাসের ক্ষতিকর জাল ও সরঞ্জামাদি দিয়ে জাটকা ও মা ইলিশ আহরণও উৎপাদন কমে যাওয়ার আরো একটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

সর্বোপরি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ইলিশ সহ সকল প্রকার প্রাণিজ সম্পদ ও জীব-বৈচিত্রের ওপর একটি বড় ধরণের হুমকি এ দুর্গন্ধময়, দূষণযুক্ত ও আর্বজনাযুক্ত পানি ।

এ ব্যাপারে চাঁদপুর নদী গবেষণা কেন্দ্রের ইলিশ গবেষক ড.আনিছুর রহমান জানান,জলবায়ূ নিয়ে আমরা ইতোমধ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। এর মধ্যে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্প কল কারখানার বর্জ্য পানির সাথে দূষিত পানি যে জীব-বৈচিত্র্যেকে বিপন্ন করে তুলছে-সে বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে ও এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে।

মেঘনা আমাদের শুধুই মাছ সম্পদ দিচ্ছে না। জীব-বৈচিত্র্যে রক্ষার প্রধান বাহন এ মেঘনা নদী। এর দু’পাশের তীরবর্তী এলাকায় পলল মাটির কারণে কৃষি ফসল ,কৃষিপণ্য উৎপাদন ও পরিবহনেও অন্যতম ভূমিকা পালন করছে ।

মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র ফেব্রুয়ারি মাসে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের বলেছেন,‘ খাদ্য মন্ত্রণালয়ে ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নিদের্শিকা অনুযায়ী একজন মানুষের দিনে অন্তত: ৬০ গ্রাম মাছ খাওয়া প্রয়োজন । আর একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ১১২০ গ্রাম মাংসের প্রয়োজন। দেশে বর্তমান দৈনিক মাথাপিছু গোশতের প্রাপ্যতার ১২১ দশমিক ৭৪ গ্রাম , যা চাহিদার তুলনায় বেশি। ’

মৎস্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সালে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০ লাখ ৫৫ হাজার মে.টন। উৎপাদন হয়েছে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার মে.টন। যা ২০০৮-০৯ অর্থ বছরের থেকে ৫৩ শতাংশ বেশি। আমাদের জনপ্রতি প্রতিদিন মাছের চাহিদা ৪৮ গ্রাম। বর্তমানে বেড়েছে ৫৫ গ্রাম। বছরে জনপ্রতি চাহিদা ২১ কেজি ৯০ গ্রাম । গ্রহণ করছে ১৯ কেজি ৩০ গ্রাম।

২০০৪ সালে মাছের উৎপাদন ৫৭ ভাগ ছিলো। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে আরো ১১ ভাগ বেড়েছে । ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৭১ লাখ ৩৫ হাজর মে.টন গোশত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৭১ লাখ ৩৫ হাজার মে.টন উৎপাদন হয়েছে ।

মৎস্য মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র সচিবালয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এক সংবাদ বলেছেন,‘ মাছ ও গোশতে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। যা আমাদের গর্ব ও আনন্দের বিষয়। চাহিদা অনুযায়ী দেশের গোশত উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ।’

জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে মৎস্য আহরণে বিশ্বে চতুর্থ এবং মাছ চাষে পঞ্চম স্থানে রয়েছে ।

কর্মসংস্থানেও মৎস্য সেক্টর অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ১ কোটি ৮২ লাখ লোখ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মৎস্য সেক্টরে জীবিকা নির্বাহ করে চলছে। সুতরাং মাছ ও গোশতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা বজায় রাখতে দেশের কৃষি ও মৎস্য খাতকে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আবশ্যক ।

মাছের অতীত ঐতিহ্য ও আমাদের দেহ সুস্থ রাখতে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে দেশের সকল বিশেষজ্ঞ,আনবিক শক্তি কমিশন ও মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। তথ্য সূত্র : জাতীয় দৈনিক

লেখক : আবদুল গনি,গণমাধ্যমকর্মী, ১৭ জুলাই ২০১৮,মঙ্গলবার

Share