সাংবাদিক নূরজাহান বেগম ও একটি প্রস্তাবনা

বাংলাদেশের নারী জাগরণের অন্যতম সংগঠক, নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এবং চাঁদপুরের কৃতিজন ‘বেগম‘ পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম আর বেঁচে নেই (ইন্না…রাজিউন)। ২৩ মে সাকাল ১০ টায় তিঁনি ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করছেন।

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারি এই কৃতিজনের মৃত্যুতে তাঁর জন্মশহর চাঁদপুর তথা গোটা বাংলাদেশে একটি উজ্জল নক্ষত্র হারিয়েছে। আমি মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

‘বেগম সম্পাদক: নূরজাহান বেগম ও চাঁদপুর প্রেসক্লাব সমিপেসু একটি প্রস্তাবনা’ এই শিরোনামে একটি লেখা অনেকদিন আগে শুরু করেছিলাম।

জীবিকার প্রয়োজনে দিনভর ছুটে চলা অথবা অদৃশ্য কোনো ভয়ে লেখাটি আর শেষ করা হয়নি।

সোমবার যখন সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকের কল্যানে নূরজাহান বেগমের মৃত্যুর সংবাদটি জানতে পারি তখন বিবেকের আরো একবার পরাজয় মানতে হলো হলাম।

নূরজাহান বেগমের জীবদ্দশায় লেখাটি না লিখতে পারার পীড়ায় আজন্ম আমাকে ব্যাথিত থাকতে হবে। বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এবং ভারত উপমহাদেশের প্রথম সপ্তাহিক বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগমের জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুর জেলার চালিতাতলী গ্রামে।
বিখ্যাত সাহিত্য পরিত্রকা ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের কন্যা নূরজাহান বেগমের স্বামী ছিলেন দেশের আরেক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব রোকনুজ্জামান দাদাভাই।
নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি সুফিয়া কামালসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের কাছাকাছি থেকে বড় হয়েছেন নূরজাহান বেগম।
১৯২৯ সালে মা আমেনা বেগম ও মামা ইয়াকুব আলী শেখের সঙ্গে তিনি চাঁদপুর ছেঁড়ে কলকাতায় ১১ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাবার বাসায় চলে যান। ওই বাড়িতে নিয়মিত সাহিত্য মজলিসে যোগ দিতেন কাজী নজরুল ইসলাম, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, হবীবুল্লাহ বাহার, ইব্রাহীম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ।

এ সাহিত্য মজলিসের নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন নূরজাহান বেগম। তিঁনি ১৯৪২ সালে পশ্চিবঙ্গের বেগম রোকেয় প্রতিষ্টিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে ১৯৪৬ সালে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে থেকে বি এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই তাঁর বাবা নাসিরুদ্দীনের হাত ধরে প্রকাশিত হয় সপ্তাহিক সওগাত পত্রিকা। প্রতিষ্ঠার প্রথম ৪ মাস এর সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল।
এর পর পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব নেন নূরজাহান বেগম। ১৯৫০ সালে রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইকে বিয়ে করে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ঢাকার শরৎ গুপ্ত রোড়ের ৩৮ নম্বর বাড়িতে বসবাস করতেন।
এ বেগম পত্রিকার মূল লক্ষ্যই ছিলো নারী জাগরণ, নতুন লেখক সৃষ্টি, সাহিত্য ও সৃজনশীলতায় নারীকে উৎসাহী করা। তিনি আপওয়া, জোনটা ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদসহ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে সমাজসেবা করেছেন। আজীবন মানুষ সেবার কাজ করার স্বিকৃতী হিসেবে ১৯৯৬ সালে শ্রেষ্ঠ ব্যাক্তিত্ত্ব হিসেবে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠ চক্রের সন্মাননা, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে রোকেয়া পদক, ১৯৯৯ সালে গিন্ডারিয়া মহিলা সমিতি থেকে শুভেচ্ছা ক্রেস্ট, ২০০২ সালে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৩ ও ২০০৫ সালে নারী পক্ষ দুর্বার নেটওয়ার্ক ও কন্যা শিশু দিবস উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে তিনি সংবর্ধনা লাভ করেন।
এছাড়াও বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, চট্টগ্রাম লেডিজ ক্লাব, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিজ ক্লাব, ঋষিজ শিল্প গোষ্ঠী, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন। স্বর্ণপদক পেয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, লেখিকা সংঘ, কাজী জেবুনন্নেসা মাহাবুবুল্লাহ ট্রাষ্ট, বাংলাদেশ সাংবাদিক ফোরাম, রোটারি ক্লাব প্রভৃতি সংগঠন থেকে।
২০১০ সালে পত্রিকা শিল্পে তাঁর অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক নারী সংগঠন ইনার হুইল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮ সম্মাননা পান তিনি। সর্বশেষ দীর্ঘ ঢাকার স্কয়ার হাসপতালে চিকিৎসাধিন থেকে ২৩ মে সোমবার সকাল ১০ সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন।

যে আবেদনে এতো কথা বলা

অত্যান্ত কষ্টের বিষয় এই যে এমন একজ কৃতিজনের জন্ম চাঁদপুর জেলায় হলেও তাঁর নিজ জেলায় স্মৃতি ধরে রখাতে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে আজও পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। একজন নগণ্য সাহিত্য ও সংবাদকর্মী হিসেবে বিষয়টি আমাকেও যথেষ্ট পিড়া দেয় বা দিচ্ছে। কৃতি এই নারী সাংবাদিকের জন্মশহর চাঁদপুর জেলায় ভাতৃত্বে অন্যতম নিদর্শন হিসেবে যে সংগঠনটি দাড়িয়ে আছে তা সাংবাদিকদেরই সংগঠন ‘চাঁদপুর প্রেসক্লাব’। যাদের হাত ধরে এই প্রতিষ্ঠানটির গড়ে উঠেছে বা বর্তমানে যারা এর দায়িত্ব পালন করছে তাদের গুণকৃর্তন করার মতো যোগ্যতা আমার কখনোই ছিলো না অথবা নেই। তবে এতটুকু বলতে পারি বাংলাদেশের যতোগুলো প্রেসক্লাব রয়েছে তার মধ্যে সাংবাদিকদের ঐক্যের অন্যতম নিদর্শন চাঁদপুর প্রেসক্লাব।

সম্প্রতি সময়ে এর দায়িত্বপ্রাপ্তদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে চাঁদপুর প্রেসক্লাব ভবনটিও নান্দনিক সৌন্দর্য ধারণ করে রুপসী চাঁদপুরেকে আরো বেশী রূপবতি করে তুলেছে। এই ক্ষদ্র বয়সে আমার দেখা বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর প্রেসক্লাব ভবনটি চাঁদপুর প্রেসক্লাব।

এ ভবনটি বর্তমানে চাঁদপুরের সকল সাংবাদিকদের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। একজন নগণ্য সাহিত্য ও সংবাদকর্মী হিসেবে আমার দাবি ৩ তলা বিশিষ্ট চাঁদপুর প্রেসক্লাবে যে কোনো একটি কক্ষ নারী সাংবাদিকতা পথিকৃৎ বেগম সম্পাদকের নামে উৎসর্গ করা হোক।

যেমনিভাবে চাঁদপুর প্রেসক্লাবের পঠাগারের নাম এর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম কামরুজ্জমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে।

উপমহাদের প্রথম সপ্তাহিত পত্রিকা ‘বেগম’ সম্পাদকের নামে প্রেসক্লাবে কোনো একটি হল যদি নামকরণ করা হয় তবে চাঁদপুরের সন্তান নূরজাহান বেগম চাঁদপুরে অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। আর অদূর ভবিষ্যৎতে চাঁদপুর প্রেসক্লাবে পা রাখা এর উত্তরাধিকাররা নূরজাহান সম্পর্কে জানতে পারবে এবং তারা গর্বকরে বলতে পারবে ‘খ্যাতিমান এই নারী সাংবাদিক আমার জেলায় জন্ম নিয়েছিলো’। তথ্যঋণ: উইকিপিডিয়া।

লেখক পরিচিতি:আশিক বিন রহিম, চীফ করেসপন্ডেন্ট, চাঁদপুর টাইমস।
সম্পাদক কবিতার কাগজ ‘তরী’।

:  আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৭:০০ এএম,  ২৪ মে  ২০১৬, মঙ্গলবার

ডিএইচ

Share