Home / জাতীয় / রাজনীতি / দলনিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়
Fakhrul

দলনিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আমন্ত্রণে সংলাপে অংশ নিয়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ‘সহায়ক সরকার’-এর অধীনে ভোটের প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। দলটির বক্তব্য, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

দলীয় সরকারের এমন ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রশাসনের দ্বারা নিরপেক্ষ নির্বাচন যে একেবারেই অসম্ভব তার প্রমাণ দেশবাসী গত বেশ কয়েক বছরে প্রত্যক্ষ করেছে। কাজেই নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সহায়ক সরকার ব্যতীত কোনোক্রমেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।

এছাড়া নির্বাচনের সময় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন, ২০০৮ সালের আগের সংসদীয় আসনের সীমানা ফিরিয়ে আনা, ইভিএম চালু না করাসহ ২০ দফা প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। এতে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করার দাবিও রয়েছে তাঁদের।

রবিবার (১৪ অক্টোবর) সকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সংলাপে এসব প্রস্তাব উপস্থাপন করে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে সকাল ১১টায় আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এ সংলাপ শুরু হয়। তবে সংলাপ শুরু হওয়ার আগে বিএনপি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন সিইসি।

প্রায় তিন ঘণ্টা সংলাপ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনের খুব বেশি কিছু করার নেই। তার পরও এই সংলাপের পর বিএনপি কিছুটা আশাবাদী তো বটেই।

‘তিনি বলেন, ‘সংলাপে আমাদের ২০ দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনও তাদের সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেছে। তবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ আয়োজন ও সহায়ক সরকারের যে দাবির কথা তাদের বলেছি, সেই ব্যাপারে কমিশন তাদের ক্ষমতার মধ্যে থেকে কিছু করার চেষ্টা করবে বলে আমাদের জানিয়েছে। ’

মির্জা ফখরুল আরো বলেন, বিএনপি বিশ্বাস করতে চায়, নির্বাচন কমিশনের এই সংলাপ বা রোডম্যাপ বা পথনকশা নিছক কালক্ষেপণ বা লোক দেখানো কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে না। এই সংলাপ যেন প্রহসনে পরিণত না হয়, তা কমিশনকেই নিশ্চিত করতে হবে।

সংলাপে বিএনপি কিছুটা আশাবাদী কি না জানতে চাইলে দলের মহাসচিব বলেন, ‘বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের যে একটা প্রচণ্ড রকমের অগণতান্ত্রিক আচরণ, সেখানে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে বলে তো আমরা মনে করি না। ’ এর মধ্যেও আশার যাত্রাটা শুরু হলো বলে মনে করেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কিছুটা তো বটেই, আমরা কিছুটা আশাবাদী তো বটেই। ’

নির্বাচন কমিশন থেকে কী আশা নিয়ে ফিরছেন বা কী উপলব্ধি হয়েছে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা দুই ঘণ্টা ৩৫ মিনিট আলাপ করেছি। শেষের দিকে তারা বলেছে, অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। কমিশন এ-ও মনে করে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা তাদের দায়িত্ব পুরোপুরিভাবে পালন করতে পারছে না। গণতন্ত্রের আসল রূপও বাংলাদেশে নেই। ’

তিনি বলেন, আলোচনার শেষ দিকে এসে তারা বিএনপি প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছে, তারা চেষ্টা করবে। নিজেদের মধ্যে বসবে, বসে দেখবে তারা কী করতে পারে।

ফখরুল আরো বলেন, আগামী দিনে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের আন্তরিকতা, দক্ষতা ও নির্ভীক পদক্ষেপ সমগ্র জাতি প্রত্যাশা করে।

তিনি বলেন, জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য বিএনপি ইসিকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করতে চায়। এ জন্য ইসিকে সময় সময় গঠনমূলক সুপারিশ ও পরামর্শ প্রদান করার আহ্বান জানান তিনি।

ইসিতে বিএনপির প্রস্তাব : বিএনপি বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে যেসব প্রস্তাব তুলে ধরে তার প্রথমেই রয়েছে—নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার গঠন। এ সম্পর্কে লিখিত প্রস্তাবে বলা হয়, ‘বিএনপির পক্ষ থেকে শিগগিরই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে। এ রূপরেখা আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনেও হস্তান্তর করব। ’

সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ তৈরি বিষয়ে প্রস্তাবে বলা হয়, ‘সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত বর্তমান সংসদকে অকার্যকর ও অপরিপক্ব মর্মে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলটির অতীতের সংসদীয় কার্যক্রমও উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে বর্তমানে বিরাজমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংসদ বহাল রেখে কোনোক্রমেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তাই সংসদ নির্বাচনের তারিখের ন্যূনতম ৯০ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কার্যকর সংলাপের উদ্যোগ সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। ’

রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার এবং কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি জানিয়ে বিএনপির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘অবিলম্বে এক-এগারোর অবৈধ জরুরি আইনের সরকার কর্তৃক বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিশেষ করে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

একই সঙ্গে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগে দায়েরকৃত সব হয়রানিমূলক ফরমায়েশি মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। এসব মামলায় গ্রেপ্তারকৃত সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। নেতাকর্মীদের হয়রানির উদ্দেশ্যে পুলিশি মামলায় শত শত অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি দেখিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের টার্গেট করে গ্রেপ্তার ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে। এসব নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে উদ্যোগী হয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ’

এখন থেকেই রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশসহ সব স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে বিএনপির প্রস্তাবে বলা হয়, ‘বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কোনো ধরনের রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কার্যক্রম পালনের অনুমতিও পাচ্ছে না। সরকারের বাধার কারণে বিরোধী মতের দলগুলো ঘরোয়াভাবে কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানেও একত্র হতে পারছে না।

এমনকি ইফতার পার্টির মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং দুস্থদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের মতো মানবিক কার্যক্রমেও বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাই এখন থেকেই রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশসহ সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কারো প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা থেকে প্রশাসনকে বিরত রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ’

প্রশাসন বিষয়ে প্রস্তাবে বলা হয়, বর্তমান সরকার প্রশাসনের সর্বস্তরে ব্যাপক দলীয়করণ করে প্রশাসনের ভারসাম্য বিনষ্ট করেছে। বর্তমানে বিভিন্নভাবে প্রশাসনকে দলীয় আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতির অনিবার্য বিরূপ প্রভাব থেকে আগামী নির্বাচনকে মুক্ত রাখতেই হবে।

এ লক্ষ্যে প্রশাসনকে অবশ্যই দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে। সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠান এবং দূতাবাসগুলোয় চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিল করতে হবে। নির্বাচনের ৯০ দিন আগে থেকে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় যেমন—স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, অর্থ, তথ্য, প্রতিরক্ষা, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, পররাষ্ট্র, কৃষি, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ইত্যাদি সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর ৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে। নির্বাচিত নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত এ ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে।

নির্বাচনের ছয় মাস আগে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল করে স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আনার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি।

বিএনপির আরো প্রস্তাব, “ইভিএম বা ডিভিএমে ভোট গ্রহণ করা যাবে না। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২-এ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় ‘প্রতিরক্ষা বাহিনীকে’ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নির্বাচনের কমপক্ষে এক সপ্তাহ পূর্ব থেকে নির্বাচিত নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনী আসনে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত করতে হবে। সকল নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক টহলসহ ভোটগ্রহণের দিন ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। ২০০৮ সালের পূর্বের সংসদীয় আসনের সীমানা বহাল রাখতে হবে। ”

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ ১০ :৫০ পিএম, ১৬ অক্টোবর, ২০১৭ সোমবার
এইউ

Leave a Reply