বিএনপির জাতীয় সম্মেলনের পর কমিটি করতে দিয়ে ‘অস্বাভাবিক বিলম্ব’ শুরু থেকেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। কাকে রেখে কাকে বাদ দেবেন-এ নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু থেকেই ছিল বিএনপির শীর্ষ পর্যায়েই। প্রায় পাঁচ মাস পর ৫০২ সদস্যের ‘ঢাউস কমিটি’ ঘোষণার পরও দলের ভেতর ক্ষোভ-হতাশা প্রকাশ্যে।সদ্য ঘোষিত কমিটিকে কেন্দ্র করে বিএনপি ভবিষ্যতে আবারও ভাঙনের মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি নতুন কমিটি দেওয়াকে কেন্দ্র দলটির মধ্যে নতুন করে কোন্দল তীব্র হয়েছে।
এবার বিএনপির বিশাল আকারের নতুন কমিটিতে পদবঞ্চিত সংস্কারপন্থী নেতারা খালেদা জিয়ার কাছে চিঠি দেবেন। কেন তাদের পদ দেয়া হয়নি তা জানতে চাওয়া হবে। চিঠির সাড়া না মিললে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের নিয়ে নতুন দল গঠনের হুমকি দেয়া হতে পারে।
সবাইকে নিয়ে কমিটি হবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এমন আশ্বাস বাস্তবায়নের অপেক্ষায় ছিলেন সংস্কারপন্থী নেতারা। কিন্তু ৬ আগস্ট তাদের আশা ভঙ্গ হয়। এরপরই সিদ্ধান্ত হয় খালেদা জিয়াকে চিঠি দেয়া হবে।
সারা দেশে বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ নেতাদের বক্তব্যও এই চিঠিতে জুড়ে দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে কয়েক নেতা কাজও শুরু করেছেন।
এদিকে প্রত্যাশিত পদ না পাওয়ায় দলের বিক্ষুব্ধ অংশটি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছেন। পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে মাঝারি সারির ১৫ থেকে ২০ নেতা বারিধারার একটি বাসায় কয়েক দফায় বৈঠক করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, সংস্কারপন্থীরা অন্য দলে যাননি। এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তারা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে চলেছেন। ২০০৯ সালের কাউন্সিলের পর সংস্কারপন্থী কিছু নেতা দলে নেয়া হলেও এবার বাকিদের নেয়া হয়নি। যদিও দলের চেয়ারপারসন তাদের নেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, এবার সুন্দর একটা কাউন্সিল হয়েছে। সেখানে চেয়ারপারসন একটা রূপরেখা ঘোষণা করলেও সে অনুযায়ী কমিটি হয়নি। ঘোষিত কমিটিতে অনেক দুর্বলতা ও অসঙ্গতি রয়েছে। যোগ্যতার ভিত্তিতে পদ দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা করা হয়নি। সংস্কারপন্থী হওয়ার কারণে দলে যাদের জায়গা হয়নি, তারা তো বিকল্প দল গঠন করতেই পারেন। তবে তাদের সঙ্গে দলের হাইকমান্ডের কথা বলা উচিত।
বিগত ওয়ান-ইলেভেনে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় গত কমিটি থেকে ছিটকে পড়েন অনেকে। এদের মধ্যে অনেকেই অতীতের ভুল স্বীকার করে নতুন কমিটিতে পদ পাওয়ার জন্য জোর লবিং করেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও বিভিন্ন সময়ে দলের ঐক্যের কথা বলেন। সবাইকে নিয়ে নতুন কমিটি করা হবে এমন আশ্বাসও দেন তিনি।
সংস্কারপন্থীদের কোন প্রক্রিয়ায় দলে ফেরানো যায় সেই ব্যাপারে কয়েকজনকে দায়িত্বও দেয়া হয়। দায়িত্বপ্রাপ্তরা সংস্কারপন্থীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেন। তাদের কে কোন পদ পেতে পারেন এমন একটি খসড়া তালিকাও হয়।
ওই তালিকায় আলোচনায় ছিলেন সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল, মফিকুল হাসান তৃপ্তি, জহিরউদ্দিন স্বপন, দেলোয়ার হোসেন খান দুলু, জিএম সিরাজ, ডা. সালেক চৌধুরী, ইলেন ভুট্টো। কিন্তু নতুন কমিটিতে কারোরই জায়গা হয়নি।
জানতে চাইলে সংস্কারপন্থী নেতা বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক জহিরউদ্দিন স্বপন বলেন, এতে করে আমরা ক্ষুব্ধ, হতাশ। কারণ সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে দলকে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থা দেখতে চেয়েছিল। যার ওপর ভিত্তি করে চেয়ারপারসন ঘোষিত জাতীয় ঐক্য গঠন করা সম্ভব হতো। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। জাতীয় ঐক্য গঠনের বাধা এবং কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার কোটারি একই সূত্রে গাঁথা। আমরা আশা করি, কমিটি গঠনে যেসব ভুল-ত্রুটি আছে তা সংশোধন করে জাতীয় ঐক্য গঠনের বাধা দূর করা হবে।
কমিটিতে বঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়া ক্ষুব্ধ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে সংস্কারপন্থীরা। তাদের প্রথম পছন্দের তালিকায় আছে দলের প্রভাবশালী নেতা ও সামরিক সাবেক আমলারা।
আগের নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও বিএনপির নতুন কমিটিতে তাদের জায়গা হয়নি ২৫ থেকে ৩০ নেতার। এদের মধ্যে লে. কর্নেল (অব.) শাহজাহান, মেজর (অব.) জাবেদ, মেজর (অব.) সারোয়ার, ক্যাপ্টেন কামরুল, ব্যারিস্টার ফখরুল অন্যতম।
বিগত আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় থাকলেও কমিটিতে জায়গা হলেও পদোন্নতি পাননি মেজর (অব.) মিজানুর রহমান, মেজর (অব.) হানিফ প্রমুখ।
এ বিষয়ে মেজর (অব.) মিজানুর রহমান বলেন, ‘দলে মাঠের কর্মী হিসেবে কাজ করেছি। আন্দোলন করতে গিয়ে ৩ দফা গ্রেফতার হয়েছি। এরপরও নতুন কমিটিতে সঠিকভাবে আমাকে মূল্যায়ন করা হয়নি বলে মনে করি।
তিনি বলেন, দলে মূল্যায়ন পদ্ধতির ঘাটতি রয়েছে- যা দলীয় স্বার্থেই সংশোধন করা উচিত। এবারের কমিটিতে সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা ঠিক নয়। এতে করে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে একটা ভুল বার্তা যেতে পারে। জানা গেছে, সংস্কারপন্থীরা মূল দলের ক্ষুব্ধ নেতাদেরও তাদের সঙ্গে পেতে চান।
সংস্কারপন্থী অংশের এক নেতা অনেকটা ক্ষোভ এবং হতাশার সুরে বলেন, আমরা ২০০৯ সালের কাউন্সিলের পর থেকে অপেক্ষা করছি। এর মধ্যে সুযোগ পেলেও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হাত মিলাইনি। গত কমিটির মতো এবারও আমাদের জায়গা দেয়া হয়নি। আমাদের অপরাধটা কি? আর কত অপেক্ষা করতে হবে। আমরা কি মরে গিয়ে প্রমাণ করব যে, আমরা খালেদা জিয়া নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছি।
এ নেতা বলেন, খালেদা জিয়ার দলে যদি একেবারেই জায়গা না হয়, তাহলে আমরা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেব না। প্রয়োজনে বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠন করে শহীদ জিয়াউর রহমানের আদর্শে দল গঠন করব। নতুন কমিটিতে জায়গা না হওয়া বিএনপির সব ত্যাগী, বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ নেতাকেও ওই দলে জায়গা দেয়া হবে।
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১০:১৪ পি,এম ১৩ আগস্ট ২০১৬,শনিবার
ইব্রাহীম জুয়েল