স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে ভালোই চলছিল খুলনার দৌলতপুর জুটমিলের শ্রমিক ওবায়দুর রহমানের (৫০) সংসার। এ সুখে ছেদ পড়ে ২০১৯ সালে। হার্টের সমস্যার কারণে রিং পড়ানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা করানোর অর্থ ছিল না তার। ধীরে ধীরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
এদিকে জুট মিল বন্ধ হওয়ায় বেকার হয়ে পড়েন ওবায়দুর। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তির আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। সংসারে দেখা দেয় অভাব-অনটন। তিন মেয়ের লেখাপড়ার খরচ তো দূরের কথা,ধার-দেনা করে তাদের খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। নিরুপায় হয়ে পথে নামেন ওবায়দুরের স্ত্রী তসলিমা বেগম মুসলিমা (৪১)।
শুরু করেন বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাপড় বিক্রির কাজ। শুরুতে হেঁটে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে থ্রি-পিসসহ নারীদের পোশাক বিক্রি করেন। তাতেও চলছিল না সংসার। পরে একটি বাইসাইকেল কেনেন। সেই সাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুড়ি,ফিতা, গোল্ডপ্লেটের কানের দুল,আংটি, চেইন, টিপ,চিরুনিসহ প্রয়োজনীয় মালামাল বিক্রি শুরু করেন।
মুসলিমার স্বামী ওবায়দুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দু’বছর আগে থেকেই আমার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। ২০১৯ সালে মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তাম। এরপর খুলনার শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসক দেখায়।
সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে। আমি হাটতে গেলে হাঁপিয়ে যেতাম,অনেক সময় বুকে ব্যথা অনুভব করতাম। হার্টের ৯০ % ব্লক ধরা পড়ে। চিকিৎসকরা দ্রুত এনজিওগ্রাম করে রিং পরানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে রিং পড়ানো সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ‘ এ অবস্থায় চিকিৎসাও নিতে পারছি না। জুটমিলও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েছি। এ অবস্থায় সংসার চালাচ্ছেন আমার স্ত্রী। এখন ভারী কোনো কাজ করতেও পারি না। আর হৃদরোগে আক্রান্ত শুনলে কেউ কাজও দিতে চায় না। দুর্দশার মধ্যে আছি। ৩ মেয়ের লেখাপড়াও ঠিকমতো করাতে পারছি না। যদি কোনো ব্যক্তি আর্থিক সহায়তা করতে পারে তাহলে উপকৃত হতাম।
সরেজমিনে দেখা যায়, সাইকেলের সামনে ও পেছনে একাধিক ব্যাগ ও কাগজের কার্টনে মালামাল নিয়ে ফেরি করার উদ্দেশে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন মুসলিমা। খালিশপুর হাউজিং বাজারের এস লাইনে এক বাড়ির সামনে জটলা পাকিয়ে রয়েছেন কয়েকজন নারী। মাঝে মুসলিমা চুড়ি, টিপ,চিরুনিসহ গ্রাহকের চাহিদা মাফিক মালামাল খুলে দেখাচ্ছেন।
অনেকে পছন্দের জিনিস কিনছেন, অনেকে আবার দর কষছেন। সামান্য লাভ হলেই জিনিস ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। কেউ কেউ নগদ টাকা দিয়ে পছন্দের জিনিস কিনছেন,কেউবা বাকিতে খাতায় লিখে রাখছেন। এভাবেই দৈনিক সাইকেলে বাড়ি বাড়ি ফেরি করে মালামাল বিক্রি করছেন মুসলিমা। জীবনযুদ্ধে এক সংগ্রামী নারী তিনি। এখন তিনি ওই এলাকার নারীদের প্রিয়জন।
খালিশপুর হাউজিং বাজার এস লাইনের গৃহবধূ শাহানারা বেগম বলেন,‘ মুসলিমা ভাবীকে ২২ বছর ধরে চিনি। খুব ভালো তিনি। কিন্তু খুব কষ্ট তার। স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত। এখন বাধ্য হয়ে এলাকায় সাইকেলে মালামাল বিক্রি করার জন্য নেমেছেন। সরকার বা কোনো বিত্তবান যদি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন,তাহলে আমরাও খুশি হব।
ওই এলাকার মুদি দোকানি বলেন,‘স্বামী অসুস্থ থাকায় দারিদ্র্যতার কারণে ওই নারী পর্দার মধ্যে থেকে রাস্তায় নেমে কাজ করছেন। প্রতিদিনই তিনি মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মালামাল বিক্রি করছেন। যেটা পুরুষদের করার কথা। এটা দেখলেও খারাপ লাগে, কিন্তু কী করব? এটা ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।’
উকিল বাড়ির বাসিন্দা জসেদা রানী বিশ্বাস বলেন, তার কাছ থেকে প্রায় মালামাল কিনি। তার তিনটি মেয়ে আছে। স্বামী অসুস্থ থাকায় তিনি বাড়ি বাড়ি মালামাল বিক্রি করে সংসার এবং মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন।
জীবনযুদ্ধে হার না মানা সংগ্রামী নারী তসলিমা বেগম মুসলিমা বলেন, আমার স্বামীর হার্টে ৯০% ব্লক ধরা পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে তার চিকিৎসা করাবো কীভাবে? তারপরও আমি হাল ছাড়িনি। দৈনিক ফেরি করি,বাচ্চাদের পড়ালেখা ও খাবারের ব্যবস্থা করছি। স্বামীর চিকিৎসার টাকার ব্যবস্থা করছি।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে আমি ব্যাগ কাঁধে করে নারীদের আনুষঙ্গিক জিনিস বিক্রি শুরু করি। এখন আর কাঁধে করতে পারি না। মেরুদণ্ডের হাড়ে সমস্যা হয়ে গেছে। এরপর সাইকেল কিনলাম। এখন কখনও সাইকেল চালিয়ে, কখনও হেঁটে হেঁটে জিনিস বিক্রি করি। দৈনিক ৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। খুব কষ্ট করেই চলছে। বিত্তবানরা যদি আমাদের পাশে দাঁড়াতেন তাহলে খুব উপকার হতো।’
নতুন রাস্তা এলাকার একটি মসজিদের ইমাম আবু তালেব। খুতবা পড়ানোর সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। মসজিদের মুসল্লিরা তাকে শেখ আবু নাসের হাসপাতালে ভর্তি করায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারও হৃদরোগ ধরা পড়ে। আবু তালেব ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালে নেওয়ার পর ইনজেকশন দেয়। ওষুধ খেয়ে ও রেস্ট নেওয়ার পর কিছুটা সুস্থ হই। এখন বাড়িতে আছি। তবে চিকিৎসক তিন মাস সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। কোন ধরনের ভারী কাজ করতে মানা করেছেন।
শুধু ওবায়দুর-আবু তালেব নয়,প্রতিনিয়তই হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। অনেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সহায়-সম্বল হারিয়ে আর্থিকভাবে নিঃস্ব হচ্ছেন। বিশেষ করে মধ্য ও নিম্নবিত্তরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে হৃদরোগের লক্ষণ,কারণ ও প্রতিকার
খুলনার শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা.মো.ফয়সাল আলম বলেন, অধিকাংশ রোগী হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে আসেন। তাছাড়া হার্টের ভাল্বের বিভিন্ন সমস্যা, হৃদস্পন্দনজনিত কিছু জটিলতা নিয়ে রোগীরা আসেন। হাসপাতালে এনজিওগ্রাম এবং রিং পড়ানোর ব্যবস্থা আছে। সরকারি হাসপাতাল হওয়ায় স্বল্প খরচে রোগীরা ভালো সেবা নিতে পারেন।
তিনি বলেন, হার্ট ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তা বোঝা যাবে-পরিশ্রম করলে বুকে ব্যথা হওয়া, বুক ধড়ফড় করা এবং শ্বাসকষ্ট হওয়া। তবে এখানে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীরা বেশি আসেন।
খুলনার শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. এসএম কামরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালে হার্টের রোগীদের সুচিকিৎসার জন্য ৩০টি শয্যা রয়েছে। পদ্মার এ পাড়ের সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখান থেকে সেবা নিচ্ছেন। স্বল্প জনবল নিয়েও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, মানুষের অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন (শরীরচর্চা না করা,অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড ও কোলেস্টরল ফুডের প্রতি ঝোক,কায়িক পরিশ্রম না করা),অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিকস,উচ্চরক্তচাপ,শরীরে খারাপ কোলেস্টরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে ধূমপান।
হাতে গোনা কয়েকটি কারণ আমরা নিজেরাই প্রতিরোধ করতে পারি। এসব যদি সঠিকভাবে মেনে চলতে পারি তাহলে আমরা হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে পারি।
হৃদরোগ প্রতিরোধে নিয়মিত শরীর চর্চা,ধূমপান ত্যাগ,ফাস্টফুড ও চর্বিযুক্ত খাবার ত্যাগ,রক্তচাপ ও ডায়াবেটিকস নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং বেশি বেশি শাকসবজি খাওয়া সর্বোপরি লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন এ দু’চিকিৎসক। সূত্র; ঢাকা পোস্ট
বার্তা কক্ষ , ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
এজি