জবস

‘সংবাদকর্মীকে বিভিন্ন অজুহাতে হেনস্তা করা হচ্ছে’

গণমাধ্যম প্রতিবেদক :

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি (একাংশ) শওকত মাহমুদ ও শহীদ পরিবারের সন্তান সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে গ্রেফতারের ঘটনা সাংবাদিক নির্যাতনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সাংবাদিকতায় পেশাগত ভূমিকার চাইতে রাজনৈতিক পরিচয়কে বড় করে দেখা এবং ঐক্যবদ্ধ পেশাগত সংগঠন না থাকায় নিপীড়ন বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, সাংবাদিকরা বর্তমানে দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের অনুসারী হয়ে গেছে। সাংবাদিকদের দাবী আদায়ের প্রধান দু’টি সংগঠন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন দু’টি করে অংশে বিভক্ত থাকায় বিভিন্ন সরকারের সময়ে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও এটি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম না থাকায় অধিকাংশ হয়রানি ও নির্যাতনের সুরাহা হচ্ছে না। উল্টো ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ছেন ভুক্তভোগীরা।

গত ১৬ আগস্ট রবিবার দৈনিক বাংলা-৭১ ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল উত্তরাধিকার-৭১’র সম্পাদক প্রবীর শিকদারকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে মঙ্গলবার তাকে ফরিদপুর জেলা জজ কোর্টে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শওকত মাহমুদকে যাত্রাবাড়ীতে বাসে অগ্নিসংযোগের জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এর আগে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশের দায়ে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রতিবেদক রফিক মোহাম্মদ, বার্তা সম্পাদক রবিউল্লাহ রবি, রিপোর্টার মো. আতিকুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারপতির স্কাইপি ফোনালাপ হ্যাক ও মিথ্যা সংবাদ প্রকাশের দায়ে ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল ‘আমার দেশ’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও পত্রিকাটির প্রকাশনার ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনীর হত্যাকাণ্ডের এখনো কোনো কূলকিনারা হয়নি। হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম দিকে সাংবাদিকরা যাবতীয় মতানৈক্যের ঊর্ধ্বে থেকে প্রতিবাদ ও আন্দোলন করে আসলেও এখন তা অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে।

বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকরা বিভিন্ন সরকারের রোষানলে পড়লেও সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর বিভক্তির কারণে ঐক্যবদ্ধ কোনো আন্দোলন দেখা যায়নি। এ ব্যাপারে কথা বলা হলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের ‍ওপর নির্যাতন নতুন কিছু নয়। অনেক পুরাতন বিষয়। পাকিস্তান সময় থেকেই এই বিষয়টি ঘটে আসছে, যা স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত চলছে। এর পেছনের কারণটা সবারই জানা। আমাদের দেশে সাংবাদিকরা কখনই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। গণমাধ্যমের মালিকদের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে কর্মীরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন।’

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘যেখানে গণমাধ্যমের দায়িত্ব হল সমাজের অনিয়মগুলো তুলে ধরা এবং সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা, সেখানে আমরা দেখছি সংবাদকর্মীকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অজুহাতে হেনস্তা করা হচ্ছে। সম্প্রতি এটা আশঙ্কাজনক হারে দেখা দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রবীর শিকদার তার জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সহায়তা চেয়েছেন। সেখানে সহায়তা না পেয়ে তিনি তার ফেসবুকের স্ট্যাটাসে বিষয়টি তুলে ধরেছেন, যা তার একান্ত ব্যক্তিগত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু এই স্বাধীনতা তথ্যপ্রযুক্তি আইন অমান্য করায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অন্যদিকে আজ শওকত মাহমুদকেও গ্রেফতার করা হয়েছে তিন-চার মাস আগে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতার দায়ে। আমার প্রশ্ন হল এতদিন কি শওকত মাহমুদ পলাতক ছিলেন? এতদিন কি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাকে খুঁজে পায় নাই? এখন কেন তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে?’

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সাংবাদিক নির্যাতনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং কোনো প্রকার প্রতিবাদ না হওয়ার একটা কারণ হল তাদের মধ্যে পেশাগত ঐক্য এখন আর নেই। তাদের সংগঠন এখন দু’টি রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত। তাই এক পক্ষের সাংবাদিক নির্যাতিত হলে বা সরকারের রোষানলে পড়লে অন্য পক্ষের সাংবাদিকরা এর প্রতিবাদ করছে না। তারা নিশ্চুপ থাকছেন। সাংবাদিকতায় রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণেই এমনটি ঘটছে।’

একই বিষয়ে কথা বলা হলে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নতুন বার্তা ডটকমের সম্পাদক সরদার ফরিদ আহমদ বলেন, ‘প্রথমত সাংবাদিকরা দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিত এবং মর্যাদার সঙ্গে চাকরি করতে পারছেন না। এমনকি কোনো কারণে তারা চাকরিচ্যুত হলেও তাদের পাওনা মালিকপক্ষের কাছ থেকে আদায় করতে পারছেন না। তারা কেন পারছেন না তা নতুন প্রজন্মের সংবাদকর্মীরা না জানলেও যারা এই মাধ্যমে দীর্ঘদিন কাজ করছেন তারা ভাল করেই জানেন। মালিকপক্ষ রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় এবং সাংবাদিকদের রুটি-রুজির দাবী আদায়ের সংগঠন সাংবাদিক ইউনিয়ন দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ায় এমনটি ঘটছে। তাই দেখা যায় একাংশের অনুসারী সংবাদকর্মী নির্যাতিত হলে বা সরকারের রোষানলে পড়লে অন্য পক্ষ নীরব থাকছে। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের পেশাগত চরিত্রের চাইতে রাজনৈতিক চরিত্রটাও বেশী প্রকাশিত হচ্ছে। যে কারণে আমরা এই পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায় আছি। এই মুহূর্তে যদি ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ করা না যায় তাহলে কিছুই করা সম্ভব নয়। আশার কথা হল সম্প্রতি উভয় পক্ষের সাংবাদিক নেতা ও সক্রিয় কর্মীদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সংগঠনের ব্যাপারে কথা হচ্ছে।’

একই বিষয়ে কথা বলা হলে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ও বাংলাদেশে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘সাংবাদিকদের ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল সাংবাদিকদের ঐক্যের পেছনে প্রধান বাধা কারা? আমি তো অনেক চেষ্টা করেছি সাংবাদিক ঐক্যের জন্য। একটা এ্যাগ্রিমেন্টও করেছিলাম। কিন্তু অন্য পক্ষ ঐক্যের চাইতে রাজনীতিকে বড় করে দেখেছেন। আর তার ফলশ্রুতিতে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আর প্রবীর শিকদার এবং শওকত মাহমুদের গ্রেফতারের বিষয়টা আইনের। তারা সাংবাদিকতা করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন তা কিন্তু না। প্রবীরের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা হয়েছে ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য, সাংবাদিকতার জন্য না। আর শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে রাজনৈতিক সহিংস কর্মসূচির জন্য। এ ব্যাপারে মন্তব্য করা উচিৎ হবে না।’

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদের কাছে এই বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে দুই সাংবাদিককে গ্রেফতারের প্রক্রিয়া নিয়ে তীব্র আপত্তি জানান। বলেন, ‘যে কেউ অপরাধ করলে আইনের সম্মুখীন হবেন এটাই স্বাভাবিক। যদি কোনো সাংবাদিক ফৌজধারী অপরাধে অভিযুক্ত থাকেন তাহলে আলাদা কথা।’

এই সাংবাদিক নেতা আরও বলেন, ‘সরকারের আইন অনুযায়ী, সংবাদ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মামলা হলে প্রথমে সমন জারি হয়। কিন্তু প্রবীর সিকদারের মতো সাংবাদিককে যেভাবে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর মামলা দেওয়া হয়েছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

শওকত মাহমুদের গ্রেফতারের বিষয়েও ব্যক্তিগতভাবে আপত্তি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শওকত মাহমুদ শুধু সাংবাদিক নন, একজন রাজনীতিকও। তিনি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছিলেন। একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার প্রাক্কালে এভাবে গ্রেফতার করার প্রক্রিয়াটি সমর্থন করি না।’

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের অন্য অংশের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান বলেন, ‘সাংবাদিকদের এভাবে গ্রেফতার নিঃসন্দেহে স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ। শওকত মাহমুদের মতো ব্যক্তিকে যেভাবে গ্রেফতার করা হল সেটা সম্পূর্ণ মাস্তানী কায়দা। এটা সমর্থনযোগ্য নয়।আমরা গ্রেফতারকৃত সাংবাদিকদের মুক্তি দাবি করছি।’

Share