Home / নারী / শেষ সাক্ষাতকারে যা বলেছিলেন নূরজাহান বেগম
শেষ সাক্ষাতকারে যা বলেছিলেন নূরজাহান বেগম

শেষ সাক্ষাতকারে যা বলেছিলেন নূরজাহান বেগম

উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা বেগম। ভারত, পূর্ব পাকিস্তান পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়ির অন্দরমহলে বেগম পত্রিকার কদর ছিল খুব বেশি। বেগম এর জন্মলগ্ন থেকে এর সম্পাদনায় যুক্ত রয়েছেন নূরজাহান বেগম।

বাবা সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের হাত ধরে সংবাদপত্র জগতে তার আবির্ভাব। তিনি ছয় দশক ধরে বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। তিনি শুধু একজন সাংবাদিকই নন লেখক গড়ার কারিগরও।

নূরজাহান বেগম ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুরের চালিতাতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এবং সাহিত্যিক।

সোমবার (২৩ মে) রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে এই গুনীজন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। মুত্যুকালে নূরজাহান বেগমের বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। নূরজাহান বেগম ফ্লোরা নাসরিন খান ও রিনা ইয়াসমিন মিতি নামের দুই মেয়ে ছাড়াও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

তাকে নিয়ে কৌতুহলী পাঠকদের জন্য জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সর্বশেষ সাক্ষাৎকারটি হুবুহু তুলে ধরা হল-

প্রতিবেদক : আমরা জানি মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ১৯২৭ সালে মাসিক সওগাতে জানানা মহল নামে প্রথম নারীদের জন্য একটি বিভাগ চালু করেন। নারী মহলে এই বিভাগটি কতখানি আলোড়ন তুলেছিল?

নূরজাহান বেগম : মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ১৯২৭ সালে মাসিক সওগাতে জানানা মহল নামে প্রথম নারীদের জন্য একটি বিভাগ চালু করলেও বাঙালি মুসলমান মেয়েরা বিভাগটি টিকিয়ে রাখতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেননি। মেয়েদের এগিয়ে না আসার কারণে বাবা সিদ্ধান্ত নেন মেয়েদের লেখা দিয়ে বছরে একবার সওগাত এর একটি সংখ্যা বের করবেন। এরই প্রেক্ষাপটে তিনি মেয়েদের ছবি দিয়ে ১৯২৯ সালে মহিলা সংখ্যা সওগাত প্রকাশ করেন। এই সংখ্যাটি বের করতে বাবা অন্দরমহলের নারীদের কাছ থেকে লেখা ও ছবি সংগ্রহ করেন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সওগাত মহিলা সংখ্যা বছরে মাত্র একটি প্রকাশ করা হয়। এসব প্রকাশনার সঙ্গে আমি সবসময়ই বাবার পাশে থেকেছি। কবি সুফিয়া কামালও মহিলা সংখ্যা সওগাত এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

প্রতিবেদক : সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ বাবার কাছ থেকে নিয়েছিলেন? সেই সময়টার কথা যদি আমাদের সামনে তুলে ধরেন?

নূরজাহান বেগম : ছেলেবেলায় বাবা আমার জন্য নিয়ে আসতেন অনেক পত্রপত্রিকা। যদিও আমি তখন তেমন পড়তে শিখিনি। কিন্তু তবুও আগ্রহ ভরে পত্রপত্রিকাগুলো উল্টেপাল্টে দেখতাম। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনটি ছিল আমার খুবই প্রিয়। সেখানে মজার মজার ছবি, প্রজাপতি, ফুল আর নানা ধরনের জীবজন্তুর ছবির সঙ্গে পরিচিত হই। এভাবে ছবি দেখতে দেখতে পত্রপত্রিকা ফাইলিং করা শিখে ফেললাম। চকের গুড়ো ঘষে ঘষে ব্লক থেকে ছবি বের করে বাবার চাহিদা মতো তাঁর হাতে তুলে দিতাম। এভাবে শিশু বয়সেই আমি বাবা নাসিরউদ্দীনের কাছে সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ নিই। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা শেষ হবার একবছর আগে ১৯৪৫ সালে বাবাকে সহযোগিতা করার জন্য সওগাত পত্রিকা অফিসে বসতে শুরু করি। পরীক্ষা শেষ হলে আমি সওগাত পত্রিকার সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হই।

প্রতিবেদক : বেগম পত্রিকার প্রথম প্রধান নারী সম্পাদক হিসেবে কবি সুফিয়া কামাল দায়িত্ব পালন করেন? তার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা এবং বেগম এর প্রথম প্রকাশনা সম্পর্কে যদি বলেন?

নূরজাহান বেগম : বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের উদ্যোগেই ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর কার্যালয় ছিল আমাদের বাড়ির পাশে কলকাতার ১২ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটের একটি বাড়িতে। বেগম এর প্রধান সম্পাদক হন বেগম সুফিয়া কামাল এবং আমি ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব্ পালন করি। তবে কবি সুফিয়া কামাল প্রধান সম্পাদক হলেও আমিই বেগম এর দেখাশুনা করতাম। বেগম পত্রিকায় যে মূল বিষয়গুলো স্থান পায় এসবের মধ্যে ছিল নারী জাগরণ, কুসংস্কার বিলোপ, গ্রামে-গঞ্জের নির্যাতিত নারীদের চিত্র, পরিবার পরিকল্পনা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জীবনবোধ থেকে লেখা চিঠি এবং মণীষীদের জ্ঞানগর্ভ বাণী। সওগাত পত্রিকা অফিসে বসে আমি বেগম পত্রিকার কাজ করতাম। কবি বেগম সুফিয়া কামাল মাঝে মধ্যে বেগম পত্রিকা অফিসে এসে দু-একটা লেখা সংগ্রহ করে দিয়ে যেতেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না থাকায় লেখা সংগ্রহ করাও ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। ঘরে বসেই ফোনের মাধ্যমে লেখা সংগ্রহ করতে হতো। প্রথমে আমরা ভেবেছিলেম হিন্দু-মুসলমান লেখিকাদের মিলিত প্রয়াসে পত্রিকাটি চালাব। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে হিন্দু লেখিকাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিই বেগম এর প্রচ্ছদে নারীর ছবি ছাপা হবে। সেই মোতাবেক প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ছবি ছাপা হয়।

প্রতিবেদক: আপনার শৈশবের কিছুটা সময় চাঁদপুরের চালিতাতলি গ্রামে কেটেছে? সেইসময়ের কথা যদি কিছু বলেন?

নূরজাহান বেগম : বাবা থাকতেন কলকাতায়। চাকরি করতেন একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। মাঝেমধ্যে তিনি গ্রামে বেড়াতে আসতেন। মায়ের সঙ্গে আমি থাকতাম কুমিল্লা জেলার (তৎকালীন ত্রিপুরা) চাঁদপুরের চালিতাতলি গ্রামে। বাড়িতে মা, মামা, দাদি, নানিও ছিলেন। ছোটবেলায় আমি খুবই চঞ্চল ছিলাম। আমাকে সামাল দিতে মা, চাচা, চাচী, মামা, দাদি, নানা, নানিকে হিমশিম খেতে হতো। গ্রামের মাঠে, ঘাটে, পুকুর, নদী, খালের পাড়ে ছুটে বেড়াতাম। এই দুষ্টুমিতে একদিন ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা। পুকুরে পড়ে গেলাম। আশপাশের লোকজন দেখে ফেলায় আমাকে দ্রুত পানি থেকে তুলে ফেলেন। আরেকদিন খাল পাড় দিয়ে দৌড়ে যেতে গিয়ে খালে পড়ে গিয়েছিলেম। এবারও সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে পানি থেকে টেনে তুলেন। এভাবে দুবার ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে বেঁচে যাই। তখন আমার বয়স ছিল তিন বছর। আমার এই দুর্ঘটনার সংবাদ শোনামাত্র বাবা আমাদের কলকাতায় নিয়ে যাবার জন্য গ্রামের বাড়িতে আসেন।

প্রতিবেদক : আপনার দেখা প্রথম কলকাতা ও সেই দিনগুলোর কথা যদি বলেন?

নূরজাহান বেগম : আত্মীয়স্বজনের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বাবা মা ও আমাকে ১৯২৯ সালে কলকাতায় নিয়ে যান। সঙ্গে ছিলেন মামা ইয়াকুব আলী শেখ। শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে চোখ ধাঁধিয়ে যায় আমার। কি বিশাল স্টেশন আর কত রং-বেরং এর মানুষ। এরপর স্টেশন থেকে ফিটন গাড়িতে ( ঘোড়ার গাড়ি) চড়ে এসে নামলাম ১১ নং ওয়েলেসলি স্ট্রিটের সেই বাড়িতে। বাবা আগে থেকেই থাকতেন ওই দোতলা বাড়িতে। দোতলার একদিকে ছিল বাবার সওগাত পত্রিকার অফিস। নিচতলায় ছিল প্রেস ক্যালকাটা আর্ট প্রিন্টাস আর অন্যদিকে থাকা খাওয়ার ঘর। বাবা আমাকে কলকাতার সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য তৈরি করতে মনস্থ হলেন। প্রথমে স্যাকরার দোকানে নিয়ে আমার নাকের ফুল কাটালেন। এরপর একদিন আমাকে কোলে করে সেলুনে নিয়ে লম্বা চুল কাটিয়ে চায়না ববকাট করলেন। এই বাড়ির নিচতলায় বাস করতেন এক ইংরেজ পরিবার। এই দম্পতির দুটি সন্তান ছিল। একজনের নাম লডেন অন্যজনের নাম টিটু। ওদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব্ হয়ে যায়। ভাষার প্রতিবন্ধকতায় বন্ধুত্ব তেমন গাঢ় না হলেও তাদের সঙ্গে মিশে আমার লাভই হয়। কারণ ইংরেজিতে কথা বলার প্রথম পাঠটা আমি ওদের কাছ থেকেই শিখি।

প্রতিবেদক : কলকাতার ওই বাড়িতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংম্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল আপনার। সে সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?

নূরজাহান বেগম : কথাটা সত্যি । এই বাড়িতেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় । কারণ তিনি এই বাড়িতেই থাকতেন। নজরুল যখন লেখায় গভীর মগ্ন তখন অনেক সময় মা আমার হাত দিয়ে কবির জন্য চা পাঠিয়ে দিতেন। একদিন আমি জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিলাম। এমন সময় আমাদের বাড়ির সামনে গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো একটি গাড়ি এসে থামল। সেই গাড়িতে উঠে বসলেন মাথায় গেরুয়া টুপি, পরনে গেরুয়া পাঞ্জাবি ও ধুতি, কাঁধের ওপরে পাটকরা চাদর আর চোখে চশমা পড়া কাজী নজরুল ইসলাম। ওই দিন ছিল বাবার আয়োজিত এলবার্ট হলে কাজী নজরুল ইসলামের সংবর্ধনা। সংবর্ধনা শেষে কাজী নজরুল ইসলাম বাড়ি ফিরলেন সোনার দোয়াত কলম, ভেলভেটের থলেতে মোহর আরো কিছু উপহার নিয়ে।

প্রতিবেদক : আপনাদের কলকাতার বাড়িতে প্রায়ই সাহিত্যের আসর বসত। সেই আসরে যারা অংশ নিতেন তাদের সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
নূরজাহান বেগম : আমাদের কলকাতার বাড়িতে প্রায় বিকেল ও রাতে মেঝেতে ফরাস বিছিয়ে বসত সাহিত্যের আসর। আসরে আসতেন কবি খান মঈনুদ্দীন, ইব্রাহিম খাঁ, আবুল ফজল, ওয়াজেদ আলী, আবুল মনসুর আহমেদ, এম ওয়াজেদ আলী বার এটল ও তাঁর মেয়ে মিরর পত্রিকার সম্পাদক। হাবিবুল্লাহ বাহার কলকাতায় এলে আমাদের বাড়িতে আসতেন।

প্রতিবেদক : পত্রিকাটি সম্পাদনার ক্ষেত্রে বাবার সহযোগিতা কতখানি পেয়েছেন?
নূরজাহান বেগম : আমি বেগম পত্রিকার দায়িত্ব্ পেলেও বাবার তত্ত্বাবধানেই পত্রিকাটি পরিচালনা করতাম। কোন লেখার সঙ্গে কোন ছবি যাবে, কিভাবে লেখাটি সাজাব এসব বিষয়ের সব সিদ্ধান্ত বাবার কাছ থেকে জেনে নিতাম। বাবার নির্দেশ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্তই নিতাম না। এদিকে পত্রিকায় প্রতি সংখ্যায় বিভাগ অনুযায়ী একাধিক নিবন্ধ, প্রবন্ধ, প্রতিবেদন দরকার। বাবা আমাকে বিভিন্ন ইংরেজি পত্র পত্রিকা থেকে প্রতিবেদনগুলো অনুবাদ করে ছাপানোর পরামর্শ দেন। বাবার পরামর্শ অনুযায়ী ইংরেজি পত্রিকার প্রতিবেদনগুলো নিজেদের প্রয়োজনমতো সহজ সরল ভাষায় অনুবাদ করে বেগম পত্রিকায় প্রকাশ করতে থাকি। এতে লেখা সংগ্রহের সমস্যা কিছুটা হলেও নিরসন হয়। এদিকে পত্রিকার জন্য নারীর ছবি তোলা এবং ছাপাতেও অনেক ঝামেলা। নারী ফটোগ্রাফার নেই। ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের ছবি সংগ্রহ করতে হতো। সেখানেও সমস্যা, আমি একা গেলে ছবি পাওয়া যায় না। একারণে আমার সঙ্গে বাবাকেও যেতে হতো। বাবাকে দেখে মেয়েরা সহজেই ছবি দিয়ে দিত। এসব ছবি পত্রিকায় ছাপানো অনেক ঝামেলা। ছবি ব্লক দিয়ে করাও অনেক কষ্ট ছিল। কলকাতা থেকে তিন বছর বেগম প্রকাশিত হয়।

প্রতিবেদক : প্রথম কবে বেগম পত্রিকার পূর্ণাঙ্গ সম্পাদকের দায়িত্ব পেলেন?
নূরজাহান বেগম : ১৯৪৭ সালে বেগম সুফিয়া কামাল কলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ ঢাকায় চলে এলে আমি বেগমের সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করতে থাকি। ১৯৪৮ সালে আমি কলকাতায় প্রথম ঈদ সংখ্যা বেগম প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই। ১৯৪৯ সালে বিশ্ব নবী সংখ্যা বেগম প্রকাশ করি। এদিকে কলকাতার পরিবেশ ক্রমশ শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক জটিলতার কারণে কলকাতায় মুসলমানদের জন্য নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে বাবা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকায় বাবা কোথাও একজায়গায় বাড়ি এবং প্রেস পেলেন না। পরে খবর পেলেন ঢাকার বিজয়া প্রেসের মালিক বিজয় চন্দ্র বসু তাঁর প্রেস কলকাতার কোনো প্রেসের সঙ্গে বদল করতে চান। সেই মোতাবেক বাবা ঢাকায় এসে ৬৬ লয়াল স্ট্রিটের বিজয়া প্রেস দেখেন এবং সেই সঙ্গে ৩৮ নম্বর শরৎগুপ্ত রোডের বসত বাড়িটিও পছন্দ করেন। এরপর পাকাপাকিভাবে ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন।

প্রতিবেদক: ঢাকায় বেগম-এর এগিয়ে চলার পরিবেশ কতটা প্রতিকূল ছিল বলে আপনি মনে করেন?

নূরজাহান বেগম : ১৯৫০ সালে আমরা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসি। বেগম পত্রিকার বয়স তখন মাত্র তিন বছর ছয় মাস। বুড়িগঙ্গার কাছে লয়াল স্ট্রিটের প্রেসটি ছিল চারদিকে খোলামেলা। তখন বিদ্যুৎও ছিল না কিন্তু বুড়িগঙ্গা নদীর বাতাস ছিল। ৩৮ নং শরৎগুপ্ত রোডের বাড়িতেই বেগম-এর কাজকর্ম দেখাশোনা করি। এখানেই বেগম পত্রিকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে বহু কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকের সমাগম ঘটে। এসময় ঢাকার মেয়েরাও লেখালেখিতে তেমন এগিয়ে আসেননি। নারী লেখিকাদের কাছ থেকে যে লেখাগুলো পাওয়া যেত তা একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিচালনা করার মতো যথেষ্ট ছিল না। ফলে আগের মতোই বিদেশী পত্রিকা থেকে অনুবাদ করে বিভিন্ন বিভাগ প্রকাশ করি। এরপর বাবার উদ্যোগে ১৯৫১ সালে ঈদ সংখ্যা বেগম প্রকাশ করি। বাবা বেগম পত্রিকা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের জন্য আমাকে সঙ্গে নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এভাবে বাবার সঙ্গে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতাম। এরকম নানা প্রতিকূলতার মাঝে ধীরে ধীরে বেগম পত্রিকা নিয়ে অগ্রসর হই। এসময় সাহিত্য কর্মে মুসলমান নারী সমাজও অংশগ্রহণ শুরু করেন। ক্রমে সারা বাংলাদেশে বেগম পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নারী কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, আন্তরিকতা, কর্মনিষ্ঠা এবং বাবার পৃষ্ঠপোষকতায় বেগম দ্রুত নারীদের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। বেগম-এ গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নিবন্ধের পাশাপাশি রান্না, সেলাই, সৌন্দর্য চর্চা, শিশু বিভাগ প্রভৃতি প্রকাশিত হওয়ায় প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের মেয়েরাও বেগম পত্রিকার লেখকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ছবিসহ লেখা ছাপানোর ব্যবস্থা থাকায় ঈদ সংখ্যা বেগম-এ লেখিকাদের অংশগ্রহণ বিপুলভাবে বেড়ে যায়। । এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয় অনেক পুরুষ পাঠক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই সাহিত্য ক্ষেত্রে মুসলমান মেয়েদের পদচারণা শুরু হয়েছে।

প্রতিবেদক: শোনা যায়, প্রখ্যাত মার্কিন নারী সাংবাদিক সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী আইদা আলসেথ বেগম পত্রিকা পরিদর্শনে এসেছিলেন। সেই স্মৃতি যদি আমাদের শোনান?

নূরজাহান বেগম : প্রখ্যাত মার্কিন নারী সাংবাদিক সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী আইদা আলসেথ ১৯৫৪ সালে ঢাকায় এলে একদিন সাপ্তাহিক বেগম পরিদর্শনে আসেন। তাঁর আগমন উপলক্ষে বাবা ও আমি কয়েকজন নারী কবি সাহিত্যিকদের বেগম অফিসে আমন্ত্রণ জানাই। আইদা আলসেথের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় হয়। তিনি বেগম পত্রিকার বিভিন্ন শাখা ঘুরে দেখেন এবং আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের অনেক মাসিক পত্রিকা বের হয় কিন্তু নারীদের জন্য কোনো সাপ্তাহিক সাময়িকী এখনও প্রকাশিত হয়নি। তিনি আরো বলেন, আমেরিকার নারী সমাজ যথেষ্ট বাধা বিপত্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে বর্তমান উন্নত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। তিনি সেখানকার নারীদের প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরে পূর্ব পাকিস্তানেও এধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আহ্বান জানান। সে সঙ্গে বাবা ও আমাকে এমন একটি মহিলা ক্লাব গঠনের পরামর্শ দেন যার মাধ্যমে মেয়েরা একসঙ্গে বসে মত বিনিময় করতে পারবেন, নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে পারবেন।

প্রতিবেদক : যতদূর জানি বেগম ক্লাব নামে একটি ক্লাব গঠন হয়েছিল। এর প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে কিছু বলুন?
নূরজাহান বেগম : আইদা আলসেথের পরামর্শ এবং উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে বাবা বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ এবং কবি সুফিয়া কামালের সঙ্গে আলোচনা করে ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বেগম ক্লাব প্রতিষ্ঠিত করেন। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ এবং সেক্রেটারি হই আমি। বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন এর অন্যতম উপদেষ্টা। অল্প সংখ্যক সদস্য নিয়ে ক্লাবের উদ্বোধন হলেও প্রাথমিক সদস্য সংখ্যা ছিল ৬৪। প্রথমে একটি টিনশেডের ঘরে ক্লাবের কাজ শুরু হয়। তখন এর আসন সংখ্যা ছিল পঁচাত্তর থেকে আশি জনের। প্রথম অবস্থায় বেগম ক্লাবে শুধুমাত্র সাহিত্য বা অন্য নানা বিষয় আলোচনা চললেও পরবর্তীতে এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। আমি সঙ্গীত শিল্পী হুসনা বানু ও লায়লা আর্জুমান্দ বানুর সঙ্গে দেখা করে তাঁদের দুজনকে সাংস্কৃতিক বিভাগের দায়িত্ব দিই।

প্রতিবেদক : আপনি কলকাতার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজ থেকে বি এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এ দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একজন সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়তে আপনাকে কতখানি সহযোগিতা করেছে বলে আপনি মনে করেন?

নূরজাহান বেগম : বাবা আমাকে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। হাসি আনন্দ খেলার মধ্য দিয়েই বিদ্যালয়ের পাঠ শিক্ষা নিই। পড়ালেখার পাশাপাশি ছবি আঁকাও শেখানো হতো। দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত অন্য স্কুলে পড়েছি। পঞ্চম শ্রেণিতে আবার এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন বিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ১৭ নং লর্ড সিনহা রোডের তিনতলা ভবনে। সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করি। ক্লাশে নাইটিংগেল, মাদামকুরি ইত্যাদি নামের দল ছিল। এদের কাজ ছিল শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যারা অংশগ্রহণ করবে তাদের তদারকি করা। এছাড়া পড়ালেখার সঙ্গে সঙ্গে গানবাজনা, নাটক, রান্না, সেলাই, ছবি আঁকা, খেলাধূলা সবকিছুতেই অংশ নিই। অষ্টম শ্রেণি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করি। ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করি। এরপর আই.এ. ভর্তি হই কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে। সহপাঠীরা মিলে একটি সাংস্কৃতিক দল তৈরি করি। কলেজে কবিতা আবৃত্তি, নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখে, অভিনয়ের মাধ্যমে বেশ সুনাম অর্জন করি আমি। মেঘদূত নাটকে নাচের মাধ্যমে মেঘের গতিবিধি তুলে ধরে কৃতিত্বের পরিচয় দিই। পড়াশুনার পাশাপাশি কলেজে খেলাধুলার ব্যবস্থাও ছিল। আমার পছন্দের খেলা ছিল ব্যাডমিন্টন। সময় পেলেই ব্যাডমিন্টন খেলতাম। লেডি ব্রেবোর্ণ থেকে ১৯৪৪ সালে আই.এ. পাশ করে বি.এ.তে ভর্তি হই। এই কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে কৃতিত্ব্রে সঙ্গে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করি।

প্রতিবেদক : স্বামী, সহযোদ্ধা হিসেবে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের কাছ থেকে কতখানি সহযোগিতা পেয়েছেন?

নূরজাহান বেগম : বেগম পত্রিকার মাধ্যমেই রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই এর সঙ্গে আমার পরিচয়। ১৯৫২ সালে রোকনুজ্জামান খানের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি ধাপে তিনি আমাকে সহযোগিতা করেছেন। বিয়ের বছর তিনেক পর বড় মেয়ে ফ্লোরা নাসরীন খান শাখী, এরপর ছোট মেয়ে রীনা ইয়াসমিন খান মিতির জন্ম হয়।

প্রতিবেদক : বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকদের মূল্যায়ন সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।

নূরজাহান বেগম : এখনকার নারী সাংবাদিকরা অনেক সাহসী। কূটনীতিক, অর্থনৈতিক, অপরাধমূলক, সামাজিক বিভিন্ন ধরনের রিপোর্ট, প্রতিবেদন তৈরি করছেন। স্পটে কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তারা সংবাদ সংগ্রহের জন্য উপস্থিত হন। সেটা যত বিপদসংকুল স্থানই হোক না কেন? নির্ভীক এই নারী সাংবাদিকরাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সত্য সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে।

(সাক্ষাৎকারগ্রহণ : রীতা ভৌমিক, বিভাগীয় সম্পাদক, সুরঞ্জনা, সূত্র- যুগান্তর)

নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৪:০০ এএম, ২৪ মে ২০১৬, মঙ্গলবার
ডিএইচ

Leave a Reply