মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান হিসেবে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা নিয়েই বড় হয়েছি। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী।
আমার বয়স সতের কি আঠারো, তখন বাবা হজে গেলেন। একজন মুসলমান শেষ বয়সে গিয়ে তার সামর্থ্য থাকলে হজব্রত পালন করবেন, এটিই ছিল বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের রীতি।
গ্রামের কৃষক হোক, শহরের ব্যবসায়ী হোক, সামর্থ্য থাকলে তিনি হজব্রত পালন করতে যেতেন পরিণত বয়সে। তখন এদেশ থেকে অধিকাংশ মানুষ হজে যেতেন সমুদ্রপথে, জাহাজে।
জাহাজ ছাড়ত চট্টগ্রাম থেকে। বাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি চট্টগ্রাম পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তিনি হজব্রত পালন করতে যাচ্ছেন, আমি না গিয়েও এর পবিত্রতা উপলব্ধি করেছিলাম বাবার প্রস্তুতি দেখে। তখনই আত্মস্থ করেছিলাম ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হজের গুরুত্ব কতখানি।
তখনকার দিনে কেউ হজে গেলে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। সবাই দোয়া চাইতেন। হজে যিনি যাচ্ছেন, তিনিও সবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে জাগতিক সব লেনদেন চুকিয়ে হজে যেতেন।
হজে যাওয়ার প্রস্তুতি ছিল একেবারে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতির মতো। সেলাইবিহীন দুই টুকরো সাদা কাপড় পরে ‘লাব্বায়েক আল্লাহুমা লাব্বায়েক…’ ধ্বনিতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ধর্মপ্রাণ মুসলমান সমবেত হন আল্লাহর ঘরে।
আজকাল স্যাটেলাইট আর তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশের যুগে ঘরে বসেই মানুষ হজব্রত পালনের সরাসরি চিত্র দেখতে পায়। পবিত্র ভূমি মক্কা থেকে সৌদি টেলিভিশন বছরব্যাপী হজ ও ওমরাহ পালনের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করে।
দিনের প্রতিটি সময়েই মক্কার চেহারা মানুষ দেখার সুযোগ পায়। প্রতি ওয়াক্তের আজান ও নামাজ আদায়ের দৃশ্যও দেখা যায়। আমার জীবনে প্রথম ওমরাহ হজে যাওয়ার সুযোগ হলো ২০০৪ সালে। আমি, আমার স্ত্রী ও আমার দুই সন্তান অয়ন, বিজয়।
ওরা তখন একেবারে শিশু। চ্যানেল আইয়ে কাফেলা অনুষ্ঠান সে বছরই শুরু হলো। সেবার ওমরাহ হজ পালনের পাশাপাশি পবিত্র মক্কা তথা সৌদি আরবের অনেক প্রসিদ্ধ স্থান দেখারও সুযোগ হলো। পরের বছর সপরিবারেই গেলাম পূর্ণ হজব্রত পালনে।
তারপর থেকে দুয়েক বছর পর পরই হজ ও ওমরাহ পালনের সুযোগ হয়েছে। চলতি বছর আবার যাওয়ার সুযোগ হলো। পবিত্র হারাম শরিফ, বায়তুল্লাহ শরিফ, কাবা শরিফ এবং মদিনা মনোয়ারা বা মসজিদে নববীর পরিবেশগত অনেক পরিবর্তনই আমি এই কয়েক বছরের মধ্যে লক্ষ্য করেছি। পরিবর্তন যেমন এসেছে অবকাঠামোগত, স্থান সংকুলানের জন্য বাড়ানো হয়েছে আয়তনও।
পৃথিবীর মানুষ যেমন বাড়ছে, বাড়ছে হাজীও। শুরুতে গিয়ে দেখেছি কাবা শরিফ তাওয়াফ করার সময় বিভিন্ন দেশের, বর্ণের মানুষ সর্বোচ্চ ভক্তি আর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছেন। পরিবেশই মানুষকে গভীর মনোযোগী করে দিত।
সত্যিই সবাই আল্লাহর ওয়াস্তে নিজেকে পুরোপুরি নিবেদন করতেন। ধনী, গরিব, উপরে, নিচের সব ভেদাভেদ ভুলে একজন আরেকজনের প্রতি সর্বোচ্চ সৌহার্দ্য ও সম্মান যেমন প্রদর্শন করতেন একইভাবে সর্বোচ্চ মনোযোগে দোয়া করতেন। তখন দুনিয়ার কোনোদিকেই মানুষের খেয়াল থাকত না।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষের এই ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আত্মনিবেদন দেখে অন্যরা শিখতেন ধর্মের পথে কীভাবে মশগুল ও মগ্ন হতে হয়।
পৃথিবী এগোচ্ছে সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তি মানুষকে অনেকদূর নিয়ে গেছে সন্দেহ নেই। এই প্রযুক্তি মানুষ কল্যাণে যেমন ব্যবহার করছে, একইভাবে ব্যবহার করছে অকল্যাণেও।
তখন থেকেই কাবা শরিফে অপ্রয়োজনীয় কোনো জিনিস ও ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এখনো এসব নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু পরিবেশটি আর তেমন নেই। মানুষের সহনশীলতা কমেছে। ইবাদতের প্রতি মগ্নতাও কমেছে।
এখন কাবা শরিফেও বহু মুসল্লির ইবাদতের মগ্নতা সবসময়ই ভেঙে যাচ্ছে কারও না কারোর বেসামাল আচরণে। এবার আমি যারপরনাই আহত হয়েছি। তাই এই লেখার অবতারণা।
মুসলমান মাত্রেই জানেন পবিত্র হজব্রত পালনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা।
সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে হাজির হওয়ার বার্তা ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহ আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ’ নিজ মুখে ঘোষণা করে হজরে আসওয়াতে চুমু খেয়ে শুরু হয় তাওয়াফ। তাওয়াফের সাতটি চক্করে ভিন্ন ভিন্ন দোয়া।
এই দোয়া পর্যায়ক্রমে গভীর থেকে গভীর হতে থাকে। প্রতিটি দোয়ার মধ্যেই রয়েছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়ার বিষয়।
বারবার আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা। এখানে কোনোভাবেই মনোযোগের বিচ্যুতি ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই। এমনকি কল্পনাতেও কোনো কিছু যাতে স্থান না পায় মনকে সেভাবে স্থির করতে হয়।
মনকে বিশ্বাসের গভীরে নেওয়ার অবিরাম চেষ্টার মধ্য দিয়েই ইবাদতে সার্থকতা পান একজন হাজী। কিন্তু সেই পরিবেশ এবার আর দেখিনি। হজব্রত পালন করতে এসেও মানুষ জাগতিক কিছুকে তো পরিত্যাগ করেইনি বরং পবিত্র কাবা শরিফে নিয়ে এসেছে বাইরের জঞ্জাল।
আজকের যুগের ‘স্মার্ট ফোন’ সবার হাতে হাতে। তার সঙ্গে ‘সেলফি স্টিক’। পবিত্র বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করার সময়ও এই সেলফি স্টিক ধরে ভিডিও ফেসবুক লাইভে ব্যস্ত অনেকেই। পবিত্র আল্লাহর ঘরের চারদিকে এক-দেড় ফুটের মধ্যেই মানুষ একেবারে বেসামাল।
এক প্রায় বৃদ্ধা মা হজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়ার পোজ দিচ্ছেন, আর তার ছেলে ছবি তুলছেন। এই একই প্রবণতা সব দেশের, সব বর্ণের মানুষের মধ্যেই। আল্লাহর ঘরের পবিত্রতা ভুলে দীর্ঘদিন পর পরিচিত কোনো মানুষকে দেখে হুড়মুড় করে জড়িয়ে ধরে মোবাইলে ছবি তোলার প্রবণতাও লক্ষ্য করলাম।
যতদূর জানি, সৌদি আরবে ফেসবুক, ভাইবার ও হোয়াটস অ্যাপের মতো মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের যথেচ্ছ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু মানুষ সৌদি আরব পৌঁছেই এগুলো ব্যবহারের বিকল্প পথের সন্ধান পেয়ে যায়।
তারা মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগে কাবা শরিফের সঙ্গে নিজের বাড়ি, আড্ডা কিংবা অন্য যে কোনো স্থানের ভিডিও সংযোগ স্থাপন করেন। মানুষের ইবাদতের মগ্নতা নষ্ট করার এই প্রবণতাকে ইসলাম কখনই স্বীকার যেমন করে না, প্রশ্রয়ও দেয় না।
আবার দেখেছি অনেক হাজী নামাজ আদায় করছেন তার পাশেই শোরচিৎকার করে হামেশাই ফোনে কথাবার্তা চলছে। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে অপ্রয়োজনীয় পারিবারিক আলাপ চলছে।
আগে কাবা শরিফের প্রতিটি স্থানে অত্যন্ত নীরব ও পবিত্র পরিবেশে নামাজ আদায় ও ইবাদত-বন্দেগির সুযোগ ছিল। এখন সেই সুযোগ ক্রমেই কমে আসছে।
এখন মোবাইল প্রযুক্তিই মানুষের সব ধ্যান ভাঙানোর জন্য সবচেয়ে আগে ভূমিকা রাখছে। পুণ্যস্থানের পবিত্রতা পর্যন্ত মোবাইলের দ্বারা নষ্ট হচ্ছে প্রতি পদে পদে।
পাঁচ দিন মক্কায় থেকে মদিনায় গেলাম। মক্কার চেয়ে অপেক্ষাকৃত সুশীতল মদিনা মনোয়ারা। রসুল (সা.) রওজা মোবারক ও মসজিদ মসজিদে নববী।
আগে সেখানে দেখেছি মানুষের গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নজির, এবার দেখলাম সেখানেও একই চিত্র। নবীজী (সা.)-এর রওজা জিয়ারতের সময়ও বেসামাল মানুষ মোবাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে উঠছেন। ফোনে অবলীলায় কথা বলছেন।
আরেকজনের নামাজের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন দূরের কথা, তার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের এর চেয়ে বড় নজির আর কী হতে পারে? জান্নাতুল বাকী, রসুল (সা.)-এর বিবি, কন্যাসহ অসংখ্য সাহাবায়ে কেরামের কবরস্থান যেখানে গিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মনটা সর্বোচ্চ নরম হয়ে যায়, সেখানেও দেখলাম একই তত্পরতা।
মোবাইল আজ আর শুধু কথা বলার যন্ত্র নয়। মোবাইল রীতিমতো এক সম্প্রচার মাধ্যম। একই সঙ্গে বহু বিনোদনের এক মাধ্যম। আজকের অনলাইন দুনিয়ায় দরকারি জিনিসের যেমন ভাণ্ডার রয়েছে, রয়েছে বহু অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর বিনোদনের ব্যবস্থাও।
এই মোবাইলই মানুষের ধ্যান-জ্ঞান ও মগ্নতাকে পদে পদে নষ্ট করছে। একজন আরেকজনের ইবাদত নষ্টের জন্য নিজের অজ্ঞাতেই দায়ী হয়ে যাচ্ছেন। আমার খুব ইচ্ছা, এই লেখাটি সৌদি আরবের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছনোর।
সৌদি সরকারের উদ্দেশ্যে তথা পবিত্র মক্কা ও মদিনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসনের উদ্দেশ্যে আমার বিনীত অনুরোধ আল্লাহ ও রসুলের পবিত্র ঘরে মোবাইল নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হোক।
এটি শুধু আমার ইবাদতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে তাই-ই নয়, আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও বিঘ্নিত করছে। আমরা সাধারণত কোনো সভায় বসার সময়ও উপস্থিতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ও মনোযোগ অখণ্ড রাখার সুবিধার কথা চিন্তা করে মোবাইল বন্ধ করে রাখি। এটিই এখনকার ভদ্রতা।
অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র স্থানটিতেই এই ভদ্রতা প্রদর্শনের পরিবর্তে বিকৃত রুচি ও চিন্তা প্রদর্শন করছি আমরা। ধর্মপ্রাণ মানুষের ইবাদতের প্রতি সম্মান জানিয়েই পবিত্র মক্কা ও মদিনায় মোবাইল বন্ধ করা উচিত।
উপরন্তু বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর পবিত্র পুণ্যস্থান মক্কা ও মদিনার সর্বোচ্চ পবিত্রতা রক্ষার বিষয়টিও গভীরভাবে আমলে আনা উচিত।
হজব্রত পালন করতে যাওয়া মানুষের এত বেসামাল হয়ে ওঠার সুযোগ চালু থাকলে দিনে দিনে পরিবেশ আরও খারাপ হতে পারে।
আল্লাহ তাঁর পবিত্র ঘর অবশ্যই পূর্ণ পবিত্রতায় হেফাজত করবেন। এক্ষেত্রে কোনো মুসলমানও পারে না তার দায় থেকে সরে যেতে।
লেখক : চাঁদপুরের কৃতি সন্তান শাইখ সিরাজ, হেড অব দা নিউজ চ্যানেল আই
সূত্র- বাংলাদেশ প্রতিদিনি
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৫:০০ পিএম, ৩১ অক্টোবর ২০১৬, সোমবার
ডিএইচ