‘শরীরই স্ট্রং পয়েন্ট, কাজে লাগাই অর্থ পাই’

ছদ্মনাম নাম প্রিয়া। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট। এখন শরীর বিক্রি করেন। এ পেশায় নামতে জোরজবরদস্তি করেনি কেউ। নিজের ইচ্ছেতেই নেমেছেন। শোনাচ্ছিলেন তার এ পেশায় নামার গল্প।

বলছিলেন, তাঁর বিয়ে হয়েছিল অনেক ছোটো বয়সে। স্বামী ঘরে লোক ঢোকাত, তাই পালিয়ে আসেন। পড়াশোনা শেষ করেন। ইতিহাসে অনার্স নিয়ে। ঢোকেন চাকরিতে। সেখানে তিনি বুঝতে পারেন, সবাই তাঁর রূপে মুগ্ধ। শরীরের দিকেই নজর সবার।

কথা প্রসঙ্গে বললেন, সবাই আমাকে সুন্দরী বলে। শরীরের দিকেই নজর। বুঝতে পারি ওটাই আমার স্ট্রং পয়েন্ট। তাই সেটাকেই কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিই।” সালটা ২০১২।

দৈনিক যে পরিমাণ টাকা রোজগারের কথা প্রিয়া বলেছেন তা শুনলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য।

প্রিয়া জানিয়েছেন, তিনি এক এক দিন ২০ হাজার রোজগার করেন। হয়তো রোজ একই পরিমাণ টাকা আসে না। তবে যেদিন আসে .. সেদিন ২০ থেকে ৩০ হাজার।

মানে মাসে বেশ কয়েক লাখ টাকা। প্রিয়া নিজেই বলছেন, এত টাকা, যে ব্যাঙ্কে রাখতে পারেন না। ট্যাক্সের ভয়। সঠিকভাবে ব্যাঙ্কে উৎস দেখাতে পারবেন না। তাই ব্যাঙ্কে টাকা রাখা হয় না। এত রোজগারের রহস্য?

প্রিয়ার দাবি, তাঁর কাছে বড় বড় ক্লায়েন্টরা আসেন।

যৌনপেশায় শুরুর দিককার অনুভূতিও প্রিয়া জানান এভাবে প্রথম প্রথম নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ চলছিল। যখন দেখলাম, খুব ভালো আছি, তখন আর কোনও সমস্যা হয়নি।”

কেমন আছে জানতে চাইলে প্রিয়ার বলে বর্তমানে খুব ভালো আছি। বলছেন, আর পাঁচটা সাধারণ চাকুরের থেকে তাঁর সংসার অনেক বেশি উজ্জ্বল।

বলছিলেন, “অনেকের থেকে অনেক ভালো সংসারকে রাখতে পারছে সংসারকে । ছেলে নামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটে আগের থেকেও সুখে আছেন বাবা-মা। খুব ভালো আছেন তিনি।

নিজের মার্কেটিং কীভাবে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, “কাউকে জানাতে হয় না। যাদের দরকার, তারা নিজেরাই খবর জোগাড় করে নেন।”

‘আমি খাট-বিছানায় শুই, নীল রঙের মশারি, দোরগোড়ায় পাপোশ আছে, দেওয়ালে মা দুর্গার ছবি, আলমারি ভর্তি কাচের গেলাশ, বনবন করে পাখা ঘোরে। সাবান মেখে রোজ চান করি। এখানকার কুকুরগুলো সারা রাত ঘেউ ঘেউ করে। তাহলেই বুঝছো, কেমন আরামে আছি আমি?’
কথাগুলো না পাঠানো চিঠিতে লিখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

চার দেওয়াল ঘেরা আলো আঁধারির কুঠুরিতে আজও শরীর বিক্রি করেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেরই জীবনের কঠিন বাস্তবগুলো রোজ রাতে ওই কাচের গেলাশে, নীল মশারিতে, বনবন করে ঘোরা পাখায় আর দোরগোড়ার পাপোশে নিঃশব্দে গোঙায়। তবে যুগ তো বদলেছে। জোর করে মুখ চাপা দিয়ে সদ্য তরুণী যে মেয়েটিকে ‘ধান্দা’য় নামানো হয়েছিল আজ থেকে বছর চল্লিশ আগে, তার সঙ্গে আজকের দিনে মুখে রং মেখে নিয়ন আলোর নীচে দাঁড়ানো বছর একুশের যুবতির তফাতটা অনেক।

বারোর সে কিশোরী আজ যৌবন সায়াহ্নে এসেও ভুলতে পারে না শুরুর সে অন্ধকার।

ঠিক অন্যদিকে একুশ বছরের যুবতি আজ অনায়াসে বলে দেন- “আরও ভালো জীবন, আরও আনন্দ, আরও আরও পয়সা – তাই নেমেছি ধান্দায়। কেউ জোর করেনি তো।”

মূল্যবোধ? সে কে? কোথায় থাকে? কী তার পরিচয়? আজকের সমাজে তার অস্তিত্ব আছে কি?

নারীপাচার চলছে। জোরজবরদস্তি পতিতাপল্লির অন্ধকার গলিতে মেয়েদের ঠেলে দেওয়া চলছে। চলছে অত্যাচার। চলছে অনেক কিছুই।

এরইমধ্যে এক শ্রেণির মেয়ে দিনরাত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তির। স্বপ্ন দেখছে প্রেমের, সংসারের। বেরিয়ে আসতে চাইছে অন্ধকার গলি ছেড়ে।

আর মুদ্রার উলটোদিকে ঠিক তার উলটো ছবি। কিছু মেয়ে আছে, যারা গা এলিয়ে দিচ্ছে দামি সোফায়, মদের ফোয়ারায় স্রেফ টাকার জন্য। সংসারে অভাব কার নেই? থাক সে কথা।

ফিরে আসা যাক, যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তাতে। আজ ওই “নষ্ট গাড়ি চাই, বাড়ি চাই। গয়না চাই। কী হবে সতীপনা করে ? বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে শুতে হবে বিনে পয়সায়। আর খদ্দেরের সঙ্গে শুলে, অর্থ আসবে পায়ের তোড়ায়, কোমরের ভাঁজে, বুকের ভাঁজে। এবার বলুন কী বলবেন?

না, না গরিব না খেতে পাওয়া ঘরের মেয়েরা নয়। একদম পড়াশুনো করা। রীতিমতো গ্র্যাজুয়েট / পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট মেয়েরা ‘ভালো জীবনে’র খোঁজে সংসারের মায়াজালে জড়াতে রাজি নয়। তাদের একটাই কথা – কী হবে ওই সব বস্তাপচা মূল্যবোধে?

খোঁজ করতে গিয়ে এমন বেশ কয়েকজন যুবতির সঙ্গে কথা হল, যাঁরা এই পেশায় এসেছেন শুধুমাত্র লাক্সারির খোঁজে। এঁদের কেউ কেউ চাকরি করেন। কেউ আবার চাকরি ছেড়ে দেহ ব্যবসায় ফুল-টাইমার। এঁদের ক্লায়েন্ট আসে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কলকাতা, শিলিগুড়ি, বর্ধমান – এমনকি খদ্দের আসে দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই থেকেও। এক-এক রাতের খেলা দশ-বিশ হাজারে। যা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য ডিগ্রিটুকুর জোরে অর্জিত সামান্য মাইনের চাকরিতে সম্ভব নয়।

আর টাকা ছাড়া আজকের যুগে কীই বা আছে বলুন। এককথায়- লাক্স লাইফ কাটানোর ওটাই তো একমাত্র চাবিকাঠি। শরীরকে পুঁজি করেই তাই স্বেচ্ছায় বেশ্যাবৃত্তিতে আসেন আজ অনেকে। না, নিয়ন আলোর নীচে তাঁরা দাঁড়ান না। পতিতাপল্লির দেহলিতে তাঁদের শরীর মেলে দাঁড়াতে হয় না। ক্লায়েন্টের অপেক্ষায় থাকতে হয় না রাতভর জেগে।

বরং বুকিং হয় ফোনে। পরিচয় হয় নিত্যনতুন চ্যাটিং অ্যাপে। একতারা, দোতারা থেকে তিন-চারতারা হোটেলে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করে সুসজ্জিত বিছানা। স্বেচ্ছায় যখন শরীর মন্দ হয়, তখন নারী কী অপরিসীম – সে যে না দেখেছে, তাকে কী করে বোঝাবেন বলুন। তাই ওসব কথা থাক। শুধু এটুকু জানুন, রাত শেষ হয়, শেষ হয় না টাকা গোনা।

গোটা দেশে এমন অনেক প্রিয়া আছেন। কেউ সংসার আরও ভালো রাখার জন্য, কেউ ফূর্তিতে জীবন কাটাবার জন্য। এক-একজনের কাছে এক-এক কারণ। একটি এনজিও থেকে পাওয়া অনুপাত বলছে, দেশে প্রায় ৪০ শতাংশ মহিলা স্বেচ্ছায় শরীর বিক্রি করেন। সংসারের আর পাঁচজন হয়তো জানেন, বাড়ির মেয়ে যাচ্ছে কলেজ করতে। বউ যাচ্ছেন চাকরি করতে। কিন্তু আসল সত্যটা হয়তো ভিন্ন। বাড়ির লোকজন জানেই না – সেই মেয়ে বা বউয়ের নগ্ন শরীর জন্ম দিচ্ছে অনেক-অনেক টাকার। (প্রতিবেদক, সারীফা রিমু:সূত্র: এনাডু ইন্ডিয়া)

নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০৬:০০ এএম, ১৩ জুন ২০১৬, সোমবার
ডিএইচ

Share