হাইমচর

হাইমচরের শিশু মারজানা খুনের রহস্য এক বছরেও আলোর মুখ দেখেনি

মারজানা আক্তারের বয়স সবে মাত্র ৯ বছর। মেঘনার পশ্চিম পারের নদী বেষ্টিত দূর্গম চর এলাকা ইশানবালার ৩২নং চর কোড়ালিয়া সপ্রাবি’র তৃতীয় শ্রেনীর ছাত্রী সে। এটুকুটন বয়সেই তার উপর দৃষ্টি পরে স্থানীয় কিছু বখাটে যুবকের।

বিষয়টি অসহায় আর দরিদ্র বাবা মা জানলেও সাহস করে প্রতিবাদ করেনি। ফলে গত বছর ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শিশু মারজানা ধর্ষনের শিকার হয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসে বাবা মায়ের কোলে। দুষ্ট মানুষের ভূল পরামর্শে মারজানাকে ভূতে মেরেছে বলে মেনে নিয়ে তার লাশ ময়না তদন্ত ছাড়াই দাফনের অনুমতি চায় তার পরিবার।

অক্ষরজ্ঞানহীন বাবা মায়ের কথায় প্রশাসনও তার লাশ ময়না তদন্ত ছাড়াই দাফনের অনুমতি দেয়। ঘটনার এদকিন পরে মারজানার লাশ গোসল করানো মহিলা শিশুটির পিতা মোকশেদ হাওলাদারকে জানায় শিশুটির গোপন অঙ্গসহ বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিলো। মারজানার মা সেলিনা বেগম মেয়েকে খুঁজতে গিয়ে প্রতিবেশী এক যুবককে দৌড়ে যেতে দেখেছে। এর পরে বেরিয়ে আসে একের পর এক তথ্য।

এমন কথাগুলো প্রকাশ হতেই পুরো ঘটনা ভিন্ন দেকে মোড় নেয়। মেয়ে হারানোর শোকে পাগল প্রায় মোকশেদ হাওলাদার ছুটে যান বাজারের রাস্তা ধরে বিলের পাশে সেই বাঁশ ঝাড়ের কাছে। যেখানে মারজানার লাশ পড়ে ছিলো। খোজ নিয়ে দেখেন ওই স্থানে পাশেই স্থানীয় সেলিম সর্দারের পরিত্যাক্ত একটি ঘরের মাটিতে রক্ত লেগে আছে।

এই ঘটনার দীর্ঘ এক বছর পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্ত তিন পালাতক বখাটে যুবককে আটক করতে পারেনি পুলিশ। তবে ১০ মাস পরে মামলার তদন্তভার হাইমচর থানা পুলিশের কাছ থেকে চাঁদপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শামীম হোসেন চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এবং অভিযুক্ত আসামীদের আটক করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

চাঁদপুরে হাইমচর উপজেলার ৪নং নীল কমল ইউনিয়েনর ইশানবালার বাজারের খলিল মাতাব্বর কান্দিতে এই নির্মম ঘটনাটি ঘটে।

পরবর্তিতে মারজানাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে এ বছরের ১৯ জানুয়ারী মো. মোকশেদ হাওলাদার বাদী হয়ে হাইমচর জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টে স্থানীয় ৩ যুবককে আসামী করে মামলা দায়ের করে।

যার মামলা নং জিআর ০৪/১৮। ধারা ৩০২/৩৭৬/২০১/৩৪ ও ১০৯। আসামীরা হলেন, ওই গ্রামের সুরুজ কান্দী এলাকার দ্বিন ইসলামের ছেলে জালাল মিয়া (২০), কাদির বেপারীর ছেলে সিদ্দিক (২১) এবং মো. সফি উল্যাহর ছেলে সেলিম (২১)। ওই মামলার সূত্র ধরেই হত্যার রহস্য উৎঘাটনে ২৫ জানুয়ারী, আদালত কতৃক লাশ উত্তলন করে ময়না তদন্তের নির্দেশ দেয়।

প্রায় পৌনে দুই মাস পর ১২ ফেব্রুয়ারী সোমবার নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটে উম্মে হাবিবা মীরার ও হাইমচর থানার উপ-পরিদর্শক মো. মুকবুল সহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা উপস্থিতে কবর থেকে মারজানা (৯) উত্তোলন করে ময়না তদন্ত করা হয়।

লাশ চাঁদপুরে মর্গে এনে সেখানে সরকারি জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক দিয়ে ৩ সদস্য বিষিষ্ট মেডিকেল টিম গঠনের মাধ্যমে ময়নাতদন্ত করা হয়। এরপর শেষে ওই রাতে পূনরায় তাকে কবরে দাফন করা হয়।

মারজানার মা সেলিনা বেগম জানায়, সন্ধ্যার কিছু আগ মুহূর্তে সদাইয়ের জন্য প্লাস্টিকের ব্যাগ হাতে দিয়ে মারজানাকে বাজারে তার বাবার দোকানে পাঠায়। এরপর রাত ৮টার বাজলেও মেয়ে বাড়িতে না ফেরায় বাবা মা দু’জনে মেয়েকে খুঁজতে বের হয়। পরে বাজার থেকে অভিযুক্ত একজনের বাড়ি রাস্তার মাঝখানে একটি বাঁশঝাড়ের পাশে লাশ পাওয়া যায়।

মারজানার পিতার মো. মোকশেদ বলেন, ‘যখন মারজানার লাশ পাওয়া যায় তখন তার গায়ের কামিজটি উল্টানো ছিলো, এবং নাকে-মুখে এবং চোখে জখমের চিহ্ন ছিলো। ওই সময়ে সেখান থেকে পুলিশ একটি টর্চ লাইট উদ্ধার করেছে। প্রথমে এলাকাবাসী বলে মারজানাকে ভূতে মেরেছে। তাই আমরা লাশ ময়না তদন্ত না করে দাফন করেছিলাম। পরে লাশ গোসল করানো মহিলা যখন বললো মারজানার গোপনস্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিলো তারপরে আমরা নিশ্চিত হলাম আমার মেয়েকে খারাপ কাজ করে হত্যা করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘যাদের আসামী করা হয়েছে তারা প্রায় স্কুলে যাওয়ার সময় মারজানাসহ অন্যান্য স্কুল ছাত্রীদের প্রায় উক্তত্ত করতো। এই ঘটনার পরে আসামীদের পরিবারের পক্ষ থেকে আপোশ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এই ঘটনার কয়েক মাস পরে গত মে মাসে হাইমচর থানা পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহভাজন হিসেবে আওলাদ (২১) নামে একজনকে আটক করে। পরবর্তিতে আদালত তাকে তিন দিনের রিমান্ড দেয়। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে ১৫ জুলাই আওলাদ জামিনে বেরিয়ে আসে।

মোকশেদ হাওলাদার বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি পুলিশ সুপার স্যারের সাথেও দেখা করেছি।আমাদের দেশ এতো উন্নত হয়েছে অথচ পুলিশ তিনজন আসামীকে ৭মাসেও অটক করতে পারেনি। আর কতদিন অপেক্ষা করলে আমি আমার মেয়ের হত্যার বিচার পাবো।’

এদিকে ১৮ জুলাই চাঁদপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার পিপিএম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং মারজানার পরিবার ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলেন। পুলিশ সুপার জানিয়েছেন অপরাধী যে হোক না কেনো দোষী প্রমানিত হলে তাদের শাস্তি পেতে হবে।

এ বিষয়ে হাইমচর থানার ওসি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। তদন্তের স্বার্থে এখনো সব কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে অপরাধীদের ছাড় পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

এ সংক্রান্ত আগের প্রতিবেদন- হাইমচরে স্কুলছাত্রীর লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পুনরায় দাফন

প্রতিবেদক- আশিক বিন রহিম
২২ ডিসেম্বর,২০১৮

Share