Home / ইসলাম / রমজান সম্পর্কিত জরুরি মাসায়িল

রমজান সম্পর্কিত জরুরি মাসায়িল

চাঁদপুর টাইমস ইসলাম ডেস্ক :

রমজান মাস হল বরকতের মাস। এ মাসের শেষ পর্যায়ে এসেও দেখা যায় মানুষের মাঝে রমজানের মাসআলা-মাসায়িল জানার প্রবল আগ্রহ। যা আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহ বৈ কিছুই নয়। দুনিয়াবির বিষয়ে মানুষের আগ্রহ থাকে শুরুর দিকে। অথচ রমজানের বিষয়াবলী সম্পর্কিত মাসায়েল জানা আগ্রহ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাইতো আজ কিছু জটিল বিষয় জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য শেয়ার করছি-

১. কেউ যদি রমজানের ৩০ দিন সাওম পূর্ণ করে এমন দেশে গমন করে যেখানে রমজান মাস এখনো চলছে তাহলে ওই এলাকায় পৌছার পর বর্ধিত দিনে নফল হিসেবে সাওম পালন করবে সম্ভব না হলে চুপিসারে সাওম ভঙ্গ করবে। কিন্তু যদি ২৮ রমজান পূর্ণ করে এমন দেশে গমন করে যেখানে রমজানের মাস শেষ হয়ে গেল এবং ঈদের দিন চলছে তাহলে ওই এলাকার লোকদের সাথে ঈদ করবে এবং ওই এলাকার রমজান যদি ২৯ দিনের হয় তাহলে ১টি সাওম এবং ৩০ দিনের হয় তাহলে ২টি সাওম ঈদের পর কাজা করবে। (মাজমুঈ ফাতাওয়া)

২. গরমের তীব্রতা বা দিন বড় হওয়ার কারণে সাওম পালন না করার উদ্দেশ্যে সফর করে পরে শীতের মৌসুমে আদায় করে দেবে এমন সফর হারাম। ( উছাইমীন); কোনো ব্যক্তি সফরের নিয়ত করলেই রমজানের সাওম ভঙ্গ করবে না বরং সওম পালন শুরু করবে। যখনই সফরের উদ্দেশ্যে বের হবে তখন ইচ্ছে করলে সাওম পালন করবে প্রয়োজন হলে ভঙ্গ করবে। কারণ হয়তো কোনো কারণে সফর না হতে পারে। সেজন্য আগে থেকে সাওম পালন বন্ধ করবে না। কেউ যদি সাওম পালন না করে সফরও না করে তাহলে ঐ দিনের ক্বাযা এবং কাফফারা দুটি আদায় করতে হবে । ( আল আসলুল মারুফ বিল মাবসুত, ইদারাতুল কোরআন)

৩. রমজানরে সাওম পালনের জন্য হায়েজ (ঋতুস্রাব) বন্ধ করার ট্যাবলেট/বড়ি (চরষষ) খাওয়া উচিত নয়। কারণ এতে শরীরের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে কেউ এ ধরনের বড়ি বা ঔষধ গ্রহণ করলে এবং মাসিকের রক্ত বন্ধ হলে সাওম পালন করতে হবে। (উছাইমীন)

৪. গেসট্রোসক্রপি এক প্রকার এন্ডোস্কোপি যাতে মুখ দিয়ে ছোট পাইপ ঢুকিয়ে স্টমাক ও নাডিভুড়ির ছবি ধারণ করে রোগ পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় এবং ক’লোনোস্কপি যাতে ক্যামেরা সহ ছোট পাইপ পায়ু পথে ঢুকিয়ে ভিতরের ছবি ধারণ করে রোগ নির্ণয় করা হয়। এগুলোতে যদি কোনো ধরণের পানি বা তেল জাতীয় জিনিস অথবা খাবার পেটে পৌঁছানো হয় তাহলে সাওম ভেঙ্গে যাবে। আর যদি কোন তেল বা পানি জাতীয় কোন জিনিস প্রবেশ করানো না হয় তাহলে সাওম ভঙ্গ হবে না। তবে সতর্কতার জন্য সাওম পালন অবস্থায় এটা না করা ভাল। যদি করে থাকে তাহলে ঐ দিনের সাওম পরে আদায় করে দিবে। বাহ্যিক পরীক্ষা নিরীক্ষাতে সাওম নষ্ট হয় না। ( আহকামুন মু’আসিরাতুন ফী আল সিয়াম মিন নাহিয়াতিন তিব্বিয়াতিন, মাজমুঈ ফতওয়া)

৫. নাকের ড্রপ যদি পেটে যায় তাহলে সাওম ভেঙ্গে যাবে। কারণ পেটের ভেতরে কিছু প্রবেশের জন্য নাক একটা বিকল্প পথ।

৬. কান ও চোখের ড্রপ ব্যবহার করলে সাওম ভঙ্গ হবে না। কারণ পেটে কোনো জিনিষ প্রবেশের জন্য কান ও চোখ বিকল্প কোনো পথ নয়। তবে কতিপয় স্কলারের মতে সাওম ভেঙ্গে যাবে। ( মাজমুঈ ফাতওয়া)

৭. এনেসথেসিয়ার কারণে যদি পুরো দিন অচেতন থাকে তাহলে একদল আলেম বলেছেন সাওম ভেঙ্গে যাবে। কেউ কেউ বলেছেন যখনই হুশ ফিরে পাবে তখনই সাওম এর নিয়ত করে নিবে। আবার কেউ বলেছেন এতে পানাহারের কোন সম্পর্ক নেই। তাই সাওম ভঙ্গের কোন কারণ নেই। অর্থাৎ এনেসথেসিয়াতে সাওম ভঙ্গ হবে না।

৮. যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে রমজানের সাওম ভঙ্গ করেছে তাকে কাযা হিসেবে একদিন এবং কাফফারা হিসেবে ধারাবাহিক দুমাস সাওম পালন করবে যদি ধারাবাহিক দুমাস সাওম পালন করতে অক্ষম হয় তাহলে ষাট জন মিসকিনের প্রত্যেককে দেশীয় খাদ্য শস্যের প্রায় ২ কেজী খাবার প্রদান করবে বা সম পরিমাণ মূল্য প্রদান করবে।

৯. কারো উপর গোসল ফরজ হলে গোসল করার আগে সাহরি খেতে অসুবিধা নেই। আর ঐ অপবিত্র অবস্থায় ফজরের আজান হয়ে গেলেও সাওমের কোন ক্ষতি হবে না। (আল মুয়াত্তা)

১০. তারাবিহের সালাতে রাকাত নিয়ে মতভেদ থাকলেও ২০ রাকাত সালাত আদায় করার ব্যাপারে সাহাবীদের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই ওযর ব্যতীত ২০ রাকাত তারাবিহের সালাত আদায়ে অবহেলা করা উচিত নয়। (আল সারাখসী, বাদায়ে সানায়েফি তারতীব আল শারইয়ে এবং আল লুবাব ফিআল জামঈ বায়না আল সুন্নাহ ওয়াল কিতাব)

১১. রমজানে তারাবিহের সালাতে কুরআন খতম করা সুন্নাত। এক্ষেত্রে প্রতি দশ দিনে একবার করে খতম দেওয়া উত্তম। অন্তত: পুরো মাসে একবার খতম যেন দেওয়া হয়। (সারাখসী)

১২. তারাবিহের সালাত কিয়ামুল লাইলের অন্তর্ভুক্ত। যা এশার সালাতের পরে আদায় করা হয়। তাই কেউ যদি জামাতে শামিল হওয়ার জন্য এসে দেখে যে এশার জামাত শেষ হয়ে তারাবিহের জামাতে চলছে তাহলে সে প্রথমে এশার সালাত আদায় করবে তারপর তারাবিহের জামাতে শামিল হবে। ( মাজমাউল আনহার ফী শরহে মুলতাকা আল আবহার)

১৩. তারাবিহের সালাতে প্রতি রাকাতে ভারসাম্য পূর্ণ তিলাওয়াত করা উচিত। তিলাওয়াত দীর্ঘায়িত করে মুসল্লিদের কষ্ট দেওয়া সমীচীন নয়। এটা শুধু তারাবিহের ক্ষেত্রে নয় বরং সব সালাতে ইমামের উচিত মুকতাদিদের প্রতি খেয়াল রেখে তিলাওয়াতের ভারসাম্য রক্ষা করা। এত দ্রুত তিলাওয়াত করা জায়েয নেই যাতে অর্থ পরিবর্তন হওয়ার সম্ভবনা থাকে এবং মুক্তাদিরা বুঝতে অসুবিধা হয়।

১৪. কেউ দেরিতে আসার কারণে কয়েক রাকাত তারাবিহের সালাত জামায়াতের সাথে না পেলে, জামায়াতের সাথে বিতরের সালাত আদায় করে পরে ছুটে যাওয়া রাকাতগুলো আদায় করতে পারে। রাতে কোনো কারণে তারাবীহের সালাত আদায় করতে না পারলে পরবর্তী দিনের তারাবিহের সালাত আদায়ের আগ পর্যন্ত দিনের যে কোনো সময় আদায় করতে পারবে। তবে বাধ্যতামূলক নয়। (আল মাওসুআত আল ফিকহিয়্যা)

১৫. তারাবিহের সালাতে কুরআন তিলাওয়াতের জন্য বিনিময় গ্রহণ করার প্রসঙ্গে আলেমদের মতভেদ আছে। তবে বিনিময় না নেওয়ার মতটা প্রবল। তাই কুরআনের হাফেজ ও ইমামদের এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি এবং কেবল পরকালীন প্রতিদান এবং আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের জন্য তিলাওয়াত ও ইমামতি করা উচিত। কর্তৃপক্ষ হাদিয়া দিলে নিতে অসুবিধা নেই। এ ক্ষেত্রে কমার্শিয়াল বা দুনিয়াবী চিন্তা করে পরকালীন বিশাল বেনিফিট হারানো উচিত নয়। (হাশিয়াতু রদ্দুল মুখতার আলা দররুল মুখতার)

১৬. রমজানে তারাবিহের সালাত সুন্নাহ, কেউ আদায় করলে সাওয়াব পাবে। আর আদায় না করলেও সাওম পালন করতে হবে। কেউ সফরে সাওম পালন করতে না পারলেও তারাবিহের সালাত জামাত বা একাকী আদায় করলে সাওয়াব পাবে। (ফাতাওয়া আল লাজনাতু আল দায়েমাত)

১৭. লাইলাতুল ক্বদর নির্দিষ্ট করে কোনো নফল ইবাদত নেই। এ রাত্রে ১২, ২০ বা ১০০ রাকাত নামায আদায় করা নির্দিষ্ট করে নেয়া ব্যক্তিগত আমল বৈ কিছু নয়। এ রাতে ইচ্ছানুযায়ী নফল সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির, দরূদ শরীফ, বিভিন্ন মাসনুন দোয়া, ইসতেগফার করা যেতে পারে। এ রাতে উত্তম দোয়া হলো: “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা‘ফু আন্নী। অর্থাৎ হে আল্লাহ ! নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসো। সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। এ দোয়াটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে শিখিয়ে ছিলেন। (মাওসুয়াতুল ফিকাহিয়্যা, ওযারাতুল আওকাফ)

১৮. রমজানরে শেষ দশ দিনের ই`তেকাফকারী রমাদানের ২০ তম দিনের আসরের পর সূর্যাস্তের পূর্বে ই`তেকাফের স্থানে প্রবেশ করবে। এবং রমজান মাস শেষ হয়ে শাওয়ালের চাঁদ উদিত হলে ই`তেকাফের সময় শেষ হবে।

১৯. ই`তেকাফকারী যদি নির্ধারিত মুয়াজ্জিন না হন তাহলে আযান দেওয়ার জন্য মাসজিদ থেকে বের হতে পারবেন না। জানাযাতে অংশ গ্রহণ করা, রোগী দেখার জন্য জন্য বের হওয়া বা কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে বের হওয়া, কাউকে কোন কাজে সাহায্য করতে বের হওয়া মুতাকিফের জন্য নিষেধ। বের হলে ই`তেকাফ ভেঙ্গে যাবে। (বাহার আল রাইক শরহে কনয আল দাকাইক)

২০. ই`তেকাফকারী মাসজিদ থেকে ক্রয় বিক্রয়ের নির্দেশনা দিতে পারবে। তবে মাল বা বস্তু মাসজিদে আনতে পারবে না। তবে এ সমস্ত কাজে ব্যস্ত হওয়া উচিত নয়। প্রয়োজনীয় কথা ও দ্বীনি কথা ছাড়া কথা বলবে না । চুপ ও বসে থাকবে না বরং কুরআন তিলাওযাত, অধ্যয়ন, যিকির, দরূদ শরীফ, নফল সালাত ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকবে। (আল লুবাব ফি শরহে আল কিতাব)

২১. ই`তেকাফের জন্য উত্তম হলো প্রথমত মাসজিদুল হারাম, দ্বিতীয়ত মাসজিদে নববী, তৃতীয়ত মাসজিদুল আকসা, চতুর্থত জামে মাসজিদ এরপর পাঞ্জেগানা মাসজিদ যেখানে জুমা হয় না তবে নির্ধারিত ইমাম ও মুয়াজ্জিন আছে। এরপর ঘরের মাসজিদ তথা ঘরের ইবাদতের স্থান যেখানে কেবল মহিলারা ইতিকাফ করবে। (বাহার আল রাইক শরহে কনয আল দাকাইক)

২২. সাদাকাতুল ফিত্বর প্রত্যেক মুসলমান চাই সে স্বাধীন হোক বা পরাধীন হোক, পুরুষ হোক বা মহিলা হোক, ছোট হোক বা বড় হোক সবার উপর ওয়াজিব। (হুমাইদী) গম, চাউল, যব, খেজুর, ও কিসমিস, ও পনির ইত্যাদির মাধ্যমে সাদকাতুল ফিত্বর আদায় করা যাবে। পনির, যব, খেজুর, কিসমিস এক ‘সা’; গম, চাউল বা আটা অর্ধ ‘সা’। আরবি ‘সা’ এর পরিমাপ নিয়ে মতভেদ আছে তবে সতর্কতার জন্য এক ‘সা’ এর ক্ষেত্রে ৪ কেজি আর অর্ধ ‘সা’ এর ক্ষেত্রে ২ কেজি হিসাব করা উত্তম। (তানকীহত তাহকীক ফি আহাদিসিত তালীক)

২৩. সাদাকাতুল ফিত্বর নিজের কর্মচারীদের বোনাস হিসেবে, শিক্ষককে ভাতা হিসেবে দেওয়া জায়েজ নেই। এই সাদাকা কেবল যারা যাকাত খেতে পারবে তাদেরকে দিতে পারবে। তবে এর বিনিময়ে তাদের থেকে কোনো উপকার নেয়া যাবে না। সদাকাতুল ফিত্বর ঈদের নামাজের পূর্বেই আদায় করতে হবে। এবং যারা যাকাত খেতে পারেন তারাই এ ফিত্বরার হকদার। (জামে উল উসুল ফি আহাদিস আল রাসুল)

আল্লাহ উপরোক্ত মাসআলাগুলো অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। রমজানের অফুরন্ত রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাতের সন্ধানে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দান করুন। আমীন।

চাঁদপুর টাইমস ডটকমের সঙ্গে থাকুন। রমজান সম্পর্কিত সুন্দর সুন্দর ইসলামী আলোচনা পড়ুন। কুরআন-হাদীস মোতাবেক আমলী জিন্দেগী যাপন করে রমজানের রহমত, বরকত ও মাগফেরাত অর্জন করুন। আমীন, ছুম্মা আমীন

আপডেট :   বাংলাদেশ সময় : ০৩:৩৪ অপরাহ্ন, ২৪ আষাঢ় ১৪২২ বঙ্গাব্দ, বৃহস্পতিবার ০৮ জুলাই ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ

 

চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫

চাঁদপুর টাইমস ডট কমপ্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি