রমজান মাস হচ্ছে রহমতের মাস। আমরা জানি সাধারণত রোজায় অসুস্থ মানুষও সুস্থ থাকেন আর যে কোনো মানুষই চাইলে সুস্থ থাকতে পারেন তবে সেটা অবশ্যই সঠিক নিয়ম মেনে চলার পর।
কিন্তু যদি তা মানা না হয় তাহলে ভালোর চাইতে খারাপই হয়। তাই এই রমজান মাসে ভালো থাকার জন্য কিছু স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরামর্শ দিচ্ছি যা খাদ্যাভ্যাস ও দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রণালীর সামান্য কিছু পরিবর্তন এনে তা মেনে চললে স্বাস্থ্য ভালো থাকার পাশাপাশি পুষ্টিও নিশ্চিত হবে।
১) অনেকেই রোজায় খুব অলস জীবন যাপন করেন। যার ফলে ওজন বেড়ে যায়। তাই একটু কর্মক্ষম থাকা উচিত। অতিরিক্ত ক্যালরি ক্ষয় করার জন্য ইফতারের পর একটু হাঁটলে খাবারগুলো ভালো ভাবে হজম হয়।
২) সবসময় যারা ব্যায়াম করেন তারা রোজায় অনেক সময় বুঝতে পারেন না ঠিক কখন করবেন। তারা ইফতারের আগে ব্যায়ামের কাজটা সেরে নিতে পারেন। যেন ব্যায়াম শেষ করার কিছুক্ষণ পরই ইফতার করতে পারেন এবং শরীরকে হাইড্রেট করে নিতে পারেন।
৩) অনেকেরই রোজার সময় ইফতারে অনেক বেশি খাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয় যার ফলে ওজন বৃদ্ধি পায়। তাই ফল ও সবজির সমন্বয়ে তৈরি স্বাস্থ্যসম্মত ইফতার করা, মিষ্টি পানীয় যতদুর সম্ভব এড়িয়ে চললে এবং কর্মব্যস্ত থাকলে সুস্থ থাকা ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
৪) মাথা ব্যাথা বা ঘুম এড়ানোর জন্য কফি খাওয়ার অভ্যাস থাকলে রোজায় চেষ্টা করুন সেটা বাদ দিয়ে দিতে বা কমিয়ে দিতে।
৫) ইফতারে মাগরিবের নামাজের আগে সব খাবার এতো দ্রুত খাওয়া সম্ভব হয়না তাই প্রথমে খেজুর, স্যুপ, ফল, সালাদ ইত্যাদি খেয়ে নামাজের পরে অন্য খাবার খেলে এই সময়ের মাঝে খাবারগুলো হজম হয়। এর ফলে বেশি খাবার খেয়ে ফেলার অস্বস্তি থাকে না।
৬) রোজায় সেহেরীর খাবার অনেকেই খান না, যা ঠিক নয়। কারন সেহেরীর খাবারটা সারাদিনের রোজাকে সহজ ও সহনীয় করতে এবং জীবনীশক্তি ও কাজের শক্তি বজায় রাখার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। তাই এই সময়ের খাবারে ভাত, রুটি বা ধীরে ধীরে শোষিত হয় এমন শর্করা সমৃদ্ধ খাবার নিশ্চিত করুন।
৭) বিভিন্ন লবন জাতীয় খাবার ও টিনজাত বা প্রসেসড খাবার, লবনাক্ত বাদাম, আচার, অতিরিক্ত ঝাল খাবার ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো কারন এই গুলো খেলে সারাদিন তৃষ্ণা অনুভব করবেন। এছাড়া অন্যান্য খাবারে লবনের পরিমান কমিয়ে আনতে চেষ্টা করুন এর পরিবর্তে খাবারের স্বাদ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সবজি ও ভেষজ মশলা ব্যবহার করুন।
৮) রোজার সময় যারা রক্তের শর্করার মাত্রা কমে যাওয়ার জন্য মাথা ব্যাথা করে বা মাথা ঘোরায় তারা ইফতারের শুরুতেই ২-৩ টি খেজুর খেয়ে নিতে পারেন, ফলে তারা কিছুটা সুস্থ বোধ করবেন।
৯) ইফতার ধীরে ধীরে সময় নিয়ে চিবিয়ে খেতে হবে। যার ফলে মিষ্টি জাতীয় খাবার ও অন্য খাবার বেশি খাওয়া হবে না।
১০) বিভিন্ন ধরনের রকমারি ইফতার রোজায় প্রত্যেকেরই খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু শরীরের সুস্থতা বজায় রাখতে চাইলে সেগুলো প্রতিদিন খাওয়া চলবেনা। খুব যদি ইচ্ছে করলে সপ্তাহে একদিন, অন্যান্য সুষম খাবারের সাথে পছন্দনীয় খাবার খুব কম পরিমানে খেতে পারেন।
১১) চেষ্টা করুন রোজায় প্রতিদিনের খাবারে অল্প পরিমান খেজুর, বাদাম ও শুকনো ফল রাখতে যা সারাদিনের প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রদানের পাশাপাশি শরীরকে সতেজ ও জীবনীশক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
১২) রোজায় সারাদিন সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকার জন্য সেহেরীতে এমন শর্করা সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে যেগুলো ধীর গতিতে হজম হয়। যেমন ভাত, রুটি বা চাইলে বিভিন্ন সিরিয়ালও খেতে পারেন। যার ফলে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
১৩) রোজায় খাবার ও দৈনন্দিন জীবনের কর্মকাণ্ডে পরিবর্তন আসে। যার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। তাই প্রতিদিনের খাবারে ফল, সবজি, ডাল ও পানি রাখতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে কর্মচঞ্চল থাকার।
১৪) রোজায় স্বাস্থ্যসম্মত ইফতার সুস্থতার জন্য খুবই জরুরি। দুইটি খেজুর, এক গ্লাস পানি, বাসায় তৈরি যেকোনো ফলের জুস, এক বাটি গরম স্যুপ, সালাদ এবং কিছু পরিমান শর্করা যেমন ভাত, পাস্তা বা আলুর তৈরি কিছু খাবার থাকলে ভালো, সেই সাথে মাংস, মুরগি বা মাসের তৈরি কিছু খাবার রাখতে পারেন। তবে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে।
১৫) গরম স্যুপ দিয়ে ইফতার শুরু করলে সারাদিন রোজা রাখার পর তা আপনার দেহকে সতেজ করে এবং পরিপাকতন্ত্রকে খাবার হজমের জন্য তৈরি করে।
১৬) প্রচুর পান করতে হবে ইফতারের সময় থেকে সেহেরি খাওয়া পর্যন্ত, কমপক্ষে ৮ গ্লাস। তবে একসাথে বেশি না খেয়ে কম কম করে খেতে হবে। অনেকেই সেহেরীর সময় বেশি করে পানি পান করে নেন সারাদিনের পিপাসা থেকে মুক্ত থাকার জন্য কিন্তু সেটা ঠিক না, এতে পেটে ব্যাথা বা অস্বস্তি হতে পারে।
১৭) ইফতারের তেলে ভাজা খাবার বাদ দেয়াই উচিত কারন এগুলো খাওয়ার ফলে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বেশি তেল মশলাযুক্ত ভারী খাবারের পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর হাল্কা খাবার বাছাই করুন এবং স্বাস্থ্যকর উপায়ে রান্না করা যেমন বেক, গ্রীল, সেদ্ধ বা স্টীম করা খাবার খান।
১৮) ইফতারের পর রাতে ঘুমাতে যাবার আগে কিছু খেতে চাইলে ভারী খাবার না খেয়ে হাল্কা খাবার খেতে পারেন যেমন ফল, টকদই বা শুকনো ফল। এছাড়া সেহেরীতে রাখতে পারেন ডাল জাতীয় খাবার। খেতে পারেন এক গ্লাস লো ফ্যাট দুধ।
১৯) মিষ্টি জাতীয় খাবার যদি খেতেই হয় তাহলে বাইরে থেকে না কিনে বাসায় তৈরি করুন। লো ফ্যাট দুধ, কম চিনি ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে খাবারের ক্যালরির পরিমান কমে আসবে। আর ইফতারের প্রথমেই মিষ্টি খাবার খেলে তাতে পেট ভরে যাবার সম্ভাবনা থাকে এবং খাবার হজমে দেরি হতে পারে। এছাড়াও এতে রক্তের শর্করার মাত্রা উঠানামা বেড়ে গিয়ে আর মিষ্টি খাবারের ইচ্ছাকে বাড়াতে পারে।
২০) মাংস,ডাল, ডিম, দুধের তৈরি জিনিসগুলো প্রোটিনের খুব ভালো উৎস। চেষ্টা করুন এর যেকোনো একটি প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখার জন্য। কারন প্রোটিন দেহের কোষের জন্য খুব প্রয়োজনীয়। এর ফলে মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ার ইচ্ছেটা কম থাকবে।
২১) সালাদ বা স্বাস্থ্যকর খাবারে সৃজনশীল হোন। তেলে ভাজা বা ভারী খাবার না খেয়ে খাবারে বৈচিত্র আনতে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত নিত্য নতুন খাবার তৈরি করুন। বিভিন্ন ধরনের ও রঙের সবজি ও ফল দিয়ে বিভিন্ন সালাদ তৈরি করে খান। যার ফলে পুষ্টি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের সমন্বয় হবে যা আপনার দেহকে এবং দেহ কোষকে এই মাসে ভালো রাখতে সাহায্য করবে।
আশা করি সবাই রোজায় সুস্থ থাকবেন এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাবেন।
লেখিকা : শওকত আরা সাঈদা(লোপা)
জনস্বাস্থ্য পুষ্টিবিদ এক্স ডায়েটিশিয়ান,পারসোনা হেল্থ
খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান(স্নাতকোত্তর)(এমপিএইচ)
(সূত্র- প্রিয় ডট কম)