Home / ফিচার / যে কারনে দাড়ি-টুপি ওয়ালাদের আমরা করোনাযোদ্ধা বলতে চাই না
প্রবাসী বাংলাদেশির মৃত্যু
ফাইল ছবি

যে কারনে দাড়ি-টুপি ওয়ালাদের আমরা করোনাযোদ্ধা বলতে চাই না

অনালোচ্য ছবির এই মানুষগুলোর অনেক বড় দুটো খারাপ পরিচয় আছে। যা আপনি-আমি জানি, কিন্তু কখনো কখনো সাহস করে বলি না। আমি আজ তাদের খারাপ পরিচয় নিয়ে কিছু কথা বলবো। তবে কারো খারাপটা বলবার আগে ভালোটা বলে নিলে সুবিধে হয়। তাই লেখাটা ভালো দিয়েই শুরু করা যাক।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার এই দুর্যোগে ছবির মনুষগুলো এই দেশে অনেকগুলো ভালো কাজ করে যাচ্ছেন। তারা করোনাকালের শুরুতেই কোনো কোনো রাজনীতিক ও সামাজিক সংগঠনের আগে সচেতনাতা সৃষ্টিতে এগিয়ে এসেছেন। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে মাক্স- বিতরণ করেছেন। চাল, ডাল, তেল, অালু, নুনসহ খাদ্য সহায়তা প্রদান করেছেন। করোনায় শ্রমিকের অভাবে ধান কাটতে না পারা কৃষকের ধান কেটে ঘরে তুলে দিয়েছে। এখনো দিচ্ছেন।

এরপর সারাদেশে যখন করোনার আগ্রাসণ বেড়ে যায়, বেড়ে যায় মানুষের মৃত্যর মিছিল, যখন আল্লাহকে ভয় না করা মানুষেরা করোনাকে ভয় করে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করা লাশের দাফনেও মুখ ফিরিয়ে নেয়। মায়ের লাশ বাগানে রেখে, স্বজন- প্রতিবেশীর লাশ পথেঘাটে রেখে পালিয়ে যায়। মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়- ওমুক ব্যক্তি করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন, কেউ তার দাফনে বা জানাযায় যাবেন না; ঠিক সেই নির্মম পরিস্থিতিতে ছবির এই মানুষগুলো সামনে এগিয়ে আসেন ফেরেস্তার মতো, দেবদূতের মতো, এযুগের মর্ডানদের ভাষায় কথিত এলিয়েনের মতো। তারা টিম গঠন করে- ছবি ফোন নাম্বার দিয়ে করোনাক্রান্ত রোগীর জানাজা ও দাফনের দায়িত্ব নেবার ঘোষণা দিয়েছেন।

চাঁদপুরে এই টিমটি ইতোমধ্যই প্রায় ১৫/২০ জন মৃত ব্যক্তির জানাজা ও দফন করেছেন। যাদের সিংহভাগ করোনাক্রান্ত ছিলেন না। এটা জানবার পরেও ওই মৃতব্যক্তির স্বজন, প্রতিবেশী, সহকর্মী, দলের লোক, ধর্মের লোক, মতের লোকেরা জানাজায় আসেননি, দাফন করতে কবরে নামেননি। অথচ ছবির এই মানুষগুলোরও করোনায় আক্রান্তের সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের পরিবারেও মা-বাবা, স্ত্রী আছে, কোমলমতি সন্তান আছে। এইসব ভয়, মায়া-মমতাকে পেছনে ফেলে, দল-মত, আদর্শকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, তারা মৃতব্যক্তির শেষকৃত্য সম্পন্ন করছেন, করে যাচ্ছেন। তাদের টিম প্রধান জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন করেছেন। নির্বাচনে তিনি বিজয়ী তো দূরে থাক, দ্বিতীয় হতে পারেননি। গায়েবী ভোটের আগামী নির্বাচনে অংশ নিলে তাঁর জামানত থাকবে কি না- তারও নিশ্চয়তা নেই। তবুও তিনি করোনাক্রান্তের জানাজায় ইমামতি করছেন, দাফন করছেন। অথচ যারা ভোটে জয়ী হয়েছেন, দ্বিতীয় হয়েছেন- তারা কেউ মাঠে নেই। কেবল এসি রুমে বসে কর্মীদের নির্দেশনা দিচ্ছেন।

অথচ এতোকিছুর পরেও পত্রিকায়-মিডিয়ায় তাঁদের নিয়ে খুব একটা মাতামাতি নেই। শিরোনামে কিংবা প্রধান খবরে তাদের স্থান নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হলো ফেইসবুকের নেশাগ্রস্ত বাঙালি ফেইসবুকেও গণহারে তাদের ছবি ভাইরাল হয়না। যেখানে এমপি-মন্ত্রী, সরকারি আমলা, জনপ্রতিনিধি, ছাত্রসংগঠনের লিফলেট বিতরণ কিংবা ধানকাটার ছবি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। এক ঘন্টায় হাজার হাজার লাইক, কমেন্ট, সেয়ার হয়; সেখানে নিজের বাবা-মায়ের জানাযা-দাফন করানোর পরেও ভুক্তভোগী ব্যক্তির ফেইসবুক ওয়ালে এই মানুষগুলোকে ধন্যবাদ জানান না।

এর প্রধান কারন হলো, তারা যতোটা না ভালো কাজ করছেন তারচেয়ে বহুগুণ খারাপ কাজ করেছেন- একটি ইসলামিক রাজনীতিক দল করে। তাদের আরো শতগুণ খারাপ কথা হলো- তারা পাঞ্জাবি পরেন, তাদের দাড়ি-টুপি আছে। ৯২ ভাগ মুসলমানের এই দেশে অমুসলিম ভাইরা এবং তাদের তরিকার শিক্ষিত মুসলিম ভাইয়েরা যাদেরকে কথায় কথায় কাঠমোল্লা বলে আরাম করে চিকনে একটা গালি দেন। কারণ এরা ইসলিম রাষ্ট্র কায়েম করতে চান। ইসলামি আইন চান, পৃথিবীর মালিক আল্লাহকে নিয়ে কটুক্তি করলে, আল্লাহর প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল কোরআন, সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে অবমাননাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করেন।

এখন কথা হলো এই রাজনীতির দেশে কোন মানুষটা রাজনীতি ছাড়া, আদর্শ ছাড়া!। যে ব্যক্তিটি কোনো দল করেন না, নিজেকে নিরপেক্ষ দাবী করেন- তারও কী একটা দল, একটা মত, একটা পক্ষ নেই?। এই যে তিনি নিজেকে নিরপেক্ষ বা অরাজনৈতিক দাবী করেন এই মতের অন্য মানুষগুলো কি তার দলের নয়?। তাহলে নিরপেক্ষ বা অরাজনৈতিকদেরও একটা দল আছে! আচ্ছা এই দেশের কোন মানুষটা তার পছন্দের দলটাকে ক্ষমতায় দেখতে বা রাখতে না চায়? এই দেশের সংখ্যালঘু ভাইরা কি মনে মনে চান না, তাদের ধর্মের কেউ একজন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হোক? অবশ্যই চান কিন্তু সেটি প্রকাশ করার সাহস তাদের নেই। কারণ তারা সংখ্যালঘু। তবে মনের ভেতরের চাওয়াটাকে, রাজনীতিক অাদর্শকে প্রকাশ করবার একটা সৎ সাহস সবার থাকা চাই। কিন্তু এই দেশের লোকেদের মাঝে সেই মানসিকতা এখনো গড়ে উঠেনি। যার কারণ ক্ষমতার স্বাধ পাওয়া দলগুলো এখানে সেই পরিবেশ গড়ে উঠতে দেয়নি। এই দেশে আমরা যতোটা না মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছি তারচেয়ে বেশি বিভিন্ন দলের, মতের মতাদর্শী হয়ে উঠছি। আর এজন্যেই হযতো আমিও আমার মনের চাওয়াকে প্রকাশ করবার সাহস দেখাই না।

কিন্তু এক্ষেত্রে ছবির এই মানুষগুলো স্বার্থক-সাহসী। তারা তাদের মনের চাওয়ার কথা, আদর্শের কথা জানান দিতে পারছেন। আর হ্যাঁ, পেরেছেন এই জন্যে যে, এই দেশে তাদের মতের না হোক, ধর্মের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বেশি বলে। ধর্মীয় সংখাগরিষ্ঠতায় তারাও হিন্দু ভাইদের সমান হলে তমনে মনে চাইতেন, প্রকাশ্যে নয়।

এবার আসল কথায় আসা যাক। এই দুর্যোগে ত্রাণ দেয়া, ধানকাটা, মৃতের গোসর, জানাজা, দাফন দেয়াসহ এতো কিছু ভালো কাজের পরেও ছবির এই মানুষগুলোকে আমরা বাহবা দিতে কৃপণতা করছি। তাদের করোনা যোদ্ধা বলতে বা মানতে পারছি না। কারন তারা ইসলামি দল করেন, কারণ তাদের দাড়ি-টুপি আছে। ধরে নিন আগামী কয়েক বছরে এই মহামারি থামবে না। ধরে নিন এই মৃত্যুে মিছিলে আপনি-আমি, আমার-আপনার পরিবারের কেউ নাম লিখাবেন; তখন নিশ্চই ডাক দেবার আগেই এই পাঞ্জাবীপরা, দাড়ি-টুপি ওয়ালা মানুষগুলো ছুটে আসবেন জানাযা-দাফন করতে। তাই দল কিংবা মতকে পছন্দ না করলেও আসুন না, এই মানুষগুলোকে এমন ভালো কাজের জন্যে মন থেকে অন্তত একটিবার ধন্যবাদ জানাই, স্যালুট করি।

লেখাটা পড়তে পড়তে কেউ কেউ হয়তো এতক্ষণে ধরেই নিয়েছেন যে আমি ইসলামি আন্দোলন দলের সাথে সম্পৃক্ত, অথবা তাদের দলীয় লেখক। অপনার ভাবনা একান্তই আপনার। মানুষ হিসেবে আমি কারো ভাবনাকে অশ্রদ্ধা করি না। ধরে নিন, এই সময়ে আমার স্বাভাবিক মৃত্যু হলো, তখন আপনি না আসলেও ছবির এই মানুষগুলো নিশ্চিত ছুটে আসবেন। একজন মুসলমান হিসেবে আমিও চাই মৃত্যুর পর আমার শেষ গোসল হোক, জানাজা-দাফন হোক। আর এই কাজগুলো সম্পন্ন করতে এই মানুষগুলো ছুটে আসুক। কোনো পশুর মতো আমার শেষকৃত্য না হোক। তাই ধরে নিন, এই লেখাটা ভালোকাজের মানুষগুলোকে আমার একপ্রকার আগাম প্রণোদনা। কী চমকে গেলেন! জীবন নিয়া, ক্ষমতা নিয়া- দেমাগ দেখান ছেড়ে দিন মিয়া ভাই!

পরিশেষে ছবির এই ভাইদের প্রতি অনেক অনেক শ্রদ্ধা, অফুরান ভালোবাসা আর স্যালুট রইলো।

লেখক
আশিক বিন রহিম
সংবাদ ও সাহিত্যকর্মী।
প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, সাহিত্য মঞ্চ।