Saturday, 01 August, 2015 04:44:48 AM
তামান্না সেতু :
সিক্সে পড়ার সময় আমার ঋতুস্রাব হয়। বর্ষার কোন এক তারিখে। আগে থেকে এ সম্পর্কে কোন ধারনা না থাকায় ভয়েই মরে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে টিফিন পিরিয়ডে মাঠে বসার সময় নিশ্চয়ই পেটের ভেতর জোঁক জাতীয় কিছু একটা ঢুকে নাড়ি কেটে দিয়েছে। আমি বরাবর মামাদের লাগোয়া। তাই দৌরে মা কে পাশ কাটিয়ে মাসুমের ( আমার মামা) কাছে যেয়ে বললাম – “আমি তো কিছুক্ষনের মধ্যে মারা যাবরে মামা”।
মামা সবটা শুনে আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। মা পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলল আর আমি মাসুমের কোলে বসে শুনলাম। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোল মা কথাগুল বলার সময় মামা সামনেই ছিল। আমাদের পরিবার এমনটাই।
বিয়ের আগে স্যানিটারি প্যাড আনার জন্য মামাদেরকেই বেশি বলতাম। ৭ মামার ভেতর ৪ জনের ওষুধের দোকান। ওরা দোকান থেকে আসার সময় নিয়ে আসতো। ঐ দিনগুলো নিশানের (ছোট মামা) সাথে সাইকেল চালানোর সময় ও একটু আস্তে চালাত আমার সাথে তাল মেলাতে। আমাদের পরিবারের সকল পুরুষদের দেখেছি এ সময়ে মেয়েদের কাজে সাহায্য করে।
অথচ আমার অনেক বান্ধবীকে এই ঋতুস্রাব নিয়ে নানান দুঃখের কথা বলতে শুনেছি- “এই ক’দিন মা বলেছে কিছু ধরবি না” , “জামার পেছনে একটু দাগ লেগেছিল বলে রাস্তায় ছেলেরা বাজে ইঙ্গিত করেছে” , “খালা বলেছে এখন থেকে ছেলেদের সাথে খুব সাবধানে মিশবি” ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরাফ (আমার ছেলে) যখন সিক্সে উঠল আমি একদিন ওকে কাছে নিয়ে বসলাম, আমার দুখী বান্ধবীর কথা মনে করে কারণ আমার ছেলে কোন মেয়ের জামাত পেছনে দাগ দেখে বাজে ইঙ্গিত করবে এটা হতে পারে না। বিষয়টা তাই আমার কাছ থেকেই তার জেনে নেয়া উচিত।
আরাফের তখনও আন্ডার আর্মস হেয়ার উঠতে শুরু করেনি যদিও তবুও মনে হোল এখনি বলা দরকার। ভীষণ হাসি হাসি মুখে তাকে আমার সিক্সে পড়ার সময়ের সেই গল্পটা বললাম। আরও বললাম
– ” বাবাই, তোমার বাবাকে দেখেছ তার গালে কত দাড়ি? তোমারও কিন্তু অমন হবে। বড় হলে ছেলেদের অমন হয়। গালে হয়, বগলের নিচে হয়।
– সবার হয় মা? তোমার কেন হয় নাই?
– আমি যে মেয়ে তাই হয় নি। মেয়েদের অন্য রকম একটা পরিবর্তন হয়। এতক্ষণ তোমাকে শোনালাম না সে গল্প?
– কি মা? বুঝিয়ে বল।
– মেয়েদের ১২ বছর বয়স হলে প্রতিমাসে একবার কয়েকটা দিন প্রসাবের পথ দিয়ে খুব রক্ত যায়।
-অনেক কষ্ট মা? তোমারও তো হয়? আমাকে আগে বল নাই কেন? আমি তাহলে তোমাকে কোন কাজ করতে দিতাম না।
– হ্যা বাবা আমারও হয়।
আমার পরিষ্কার মনে আছে আরাফ সেদিন কেঁদেছিল। আমাকে জরিয়ে ধরে বসে বলল -এখন থেকে তুমি অমন হলে আমাকে বলবে। কোন কাজ করবে না।
-আচ্ছা বাবা, করব না। কিন্তু এখন তুমি কিছু জরুরি কথা শোন।
– বল মা।
– তোমার স্কুলে তোমার কোন কোন বান্ধবীরও নিশ্চয়ই এমন হয়েছে বা হবে। তাদের জামাতে কখনো দাগ দেখলে তুমি কি করবে?
– আমি ওদেরও কোন কাজ করতে দেব না। ক্যান্টিন থেকে টিফিন ও এনে দেব মা?
– সেটা তো করতেই পারো কিন্তু অন্য বন্ধুরা যদি এটা নিয়ে কোন দুষ্টামি করে তাহলে তাদেরকে আমি তোমাকে যা বলেছি সেটা বলবে। বলবে তাদের মামনিরও এটা হয়। এটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়।
– অনেক কষ্ট না মা?
– নারে বাবা একটুও কষ্ট না। এই যে তুই কাঁদছিস আর আমার কষ্ট থাকে বল?
এরপর বেশ কিছু বছর গিয়েছে। আরাফ এখনো ঐ দিনগুলোতে আলাদা করে আমার খোঁজ নেয়। ধ্রুব এবার ফাইভে পড়ে। সামনের বছর আমি আরাফ একসাথে তাকে বিষয়টা জানাবো।
মায়ের মুখ থেকেই তো নারীর সম্মানের প্রথম শিক্ষাটা নিতে হবে।
যুদ্ধটা তো ঘর থেকেই শুরু করতে হবে, না কি?
একজন আরাফ একজন ধ্রুব একজন মাসুম/নিশান একদিন এ দেশটা বদলে দেবে। কিন্তু শুরুটা ঘর থেকেই করতে হবে।
আমি তো মা। আমার এই পেটের থেকেই তো দুটো ভবিষ্যতের পুরুষকে জন্ম দিয়েছি। ছ’টা মাস আরাফ আমার স্তন ছাড়া আর কিছু পান করেনি আর তাই হয়ত পুরুষ বলতেই আমি একটি গুপ্তাঙ্গ ভাবতে পারি না। তাহলে যে মায়ের পেট থেকে জন্ম নেয়া, যে মায়ের স্তন পান করে বেড়ে ওঠা সেই মায়ের মতন আরেকটি শরীর কিভাবে একটি পুরুষের কাছে নানান গুপ্তাঙ্গের খনি হয়ে ওঠে?
আপনার সন্তানটিকে তাই আপনিই পুরুষ হবার আগে মানুষ করে তুলুন।
আপনিই পারেন। আমরাই পারি। বিশ্বাস করুন পারি।
লেখক: তামান্না সেতু, পরিচালক- বাতিঘর,
শিশুদের সাংস্কৃতিক বিদ্যালয়