সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রেরণায় নিজের জীবনী খাতায় লিখেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবশ্য তাকে তার বন্ধুবান্ধব সহকর্মীরাও জীবনী লেখার কথা বলেছিলেন।
বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের সম্পর্কে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- বন্ধুবান্ধবরা বলে, ‘‘তোমার জীবনী লেখ।’’ সহকর্মীরা বলে, ‘‘রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাবলি লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’’
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন- আমার সহধর্মিণী একদিন জেল গেটে এসে বলল- ‘‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনি।’’
তখন বঙ্গবন্ধু তার সহধর্মিণীকে উদ্দেশ্য করে যা বলেছিলেন তার বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। বইয়ে লিখেছেন- বললাম ‘লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি যে লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।
বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণীর ডাক নাম ছিল রেণু। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেন ‘ আমার স্ত্রীর ডাক নাম রেণু- আমাকে কয়েকটা খাতাও জেল গেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।
খাতায় লেখা এই জীবনকাহিনি যেভাবে গন্থে রূপ পায়
শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা চারটি খাতা ২০০৪ সালে আকস্মিকভাবে তার কন্যা শেখ হাসিনার হাতে আসে। খাতাগুলো অতি পুরানো, পাতাগুলো জীর্ণপ্রায় এবং লেখা প্রায়শ অস্পষ্ট। মূল্যবান সেই খাতাগুলো পাঠ করে জানা গেল, এটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, যা তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। জেল-জুলুম, নিগ্রহ-নিপীড়ন যাকে সদা তাড়া করে ফিরেছে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উৎসর্গীকৃত-প্রাণ, সদাব্যস্ত বঙ্গবন্ধু যে আত্মজীবনী লেখায় হাত দিয়েছিলেন এবং কিছুটা লিখেছেনও, এই বইটি তার স্বাক্ষর বহন করছে।
বইটিতে আত্মজীবনী লেখার প্রেক্ষাপট, বঙ্গবন্ধুর বংশপরিচয়, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, কলকাতাকেন্দ্রিক প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, দেশ বিভাগের পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি পূর্ব বাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, আদমজীর দাঙ্গা, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণ এবং এসব বিষয়ে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে। আছে লেখকের কারাজীবন, বাবা-মা, সন্তান-সন্ততি ও সর্বোপরি সর্বংসহা সহধর্মিণীর কথা, যিনি তার রাজনৈতিক জীবনে সহায়ক শক্তি হিসেবে সব দুঃসময়ে অবিচল পাশে ছিলেন। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুরি চীন, ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণের বর্ণনাও বইটিকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে।
২০১২ সালে বইটি প্রকাশ করে দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। এই বইটি ইংরেজি, উর্দু, জাপানি, চীনা, আরবি, ফরাসি, হিন্দি ও তুর্কি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।