কবির হোসেন মিজি=>
একটা সময় ছিল, যখন বিকেল হলেই শিশুরা দলবেঁধে মাঠে ছুটে যেতো, লুকোচুরি, দাড়িয়াবান্ধা, কাবাডি কিংবা ক্রিকেট-ফুটবল খেলায় মেতে উঠতো। আর এখন? এখন বিকেল মানেই এক কোণে কিংবা নির্জনস্থানে বসে থাকা, হাতে মোবাইল, চোখে ঘোর, টিকটক, পাবজি, ফ্রি ফায়ার কিংবা ইউটিউব-ফেসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকা। প্রশ্ন জাগে, এটাই কি আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চেয়েছিলাম?
বর্তমানে মোবাইল ফোন শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং বিনোদন, শিক্ষা, এমনকি জীবনের নানা কার্যক্রমের সঙ্গী। কিন্তু এই প্রযুক্তির অপব্যবহার যখন শিশু-কিশোর ও তরুণদের মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক বিকাশে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা এক গভীর সংকটের জন্ম দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে শিশু-কিশোরদের একটি বড় অংশ দৈনিক ৫ থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত মোবাইল ব্যবহার করে থাকে। এর মধ্যে অধিকাংশ সময়ই তারা ভিডিও গেমস, সোশ্যাল মিডিয়া বা ইউটিউব কনটেন্টে সময় ব্যয় করেন। যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য, লেখাপড়া, ঘুম ও পারিবারিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
আসক্তির কারণে কী কী ক্ষতি হচ্ছে?
১. মানসিক স্বাস্থ্যহানি: মোবাইল ফোনে অতিরিক্ত সময় কাটানোর ফলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্নতা, অস্থিরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা দেখা দেয়। বিশেষ করে গেমিং অ্যাডিকশন তাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশে বাঁধা সৃষ্টি করে।
২. শারীরিক সমস্যায় ভোগা: দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোন ব্যবহারে চোখের দৃষ্টি কমে যাওয়া, মাথাব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, ঘুমের সমস্যা এবং স্থূলতা দেখা দেয়। অনেকেই রাত জেগে ফোন ব্যবহার করে, ফলে দিনের বেলা ক্লান্তি ও মনোযোগহীনতা ভোগায়।
৩. অভ্যাসগত পরিবর্তন: আসক্ত শিশু-কিশোররা বাস্তব জীবনে বন্ধুত্ব, সামাজিকতা ও পারিবারিক সম্পর্ক থেকে সরে যায়। তারা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, রাগপ্রবণ হয়ে পড়ে এবং কথাবার্তায় আগ্রাসী হয়ে ওঠে।
৪. শিক্ষাজীবনে ধ্বস: মোবাইল ফোনে মগ্ন থাকা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগ থাকে না। তাদের সৃজনশীলতা ও চিন্তাশক্তি লোপ পায়, পরীক্ষার ফল খারাপ হয়।
আসক্তির মূল কারণগুলো কী?
প্রযুক্তির সহজলভ্যতা
ব্যস্ত মা-বাবার পর্যবেক্ষণের অভাব
নিরাপদ খেলার মাঠের অভাব
অনলাইন গেম ও ভিডিও কনটেন্টের চটকদার আকর্ষণ
অসচেতন অভিভাবকদের দ্বারা ছোট বয়সে স্মার্টফোন হাতে তুলে দেওয়া
মোবাইল আসক্তির ক্ষতি
১. মনোজগতে অস্থিরতা: শিশুরা ধৈর্য হারায়, অল্পতেই রেগে যায়, বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
২. শরীরের ক্ষয়: চোখের সমস্যা, নিদ্রাহীনতা, মোটা হয়ে যাওয়া, ঘাড় ও কাঁধে ব্যথা।
৩. সামাজিকতা হারানো: পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় না কাটিয়ে একা হয়ে যাওয়া।
৪. শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া: মনোযোগ কমে যাওয়া, পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল।
৫. সৃজনশীলতার বিলুপ্তি: ভাবনার জগতে সংকীর্ণতা, কল্পনার অভাব।
প্রতিকার ও করণীয় কী হতে পারে?
১. পরিবারের সক্রিয় ভূমিকা: অভিভাবকদের উচিত শিশুদের সময় দেওয়া, তাদের সঙ্গে কথা বলা, গল্প করা ও খেলাধুলায় উৎসাহ দেওয়া। শিশুদের হাতে যখন-তখন মোবাইল তুলে না দিয়ে, নির্দিষ্ট সময় ও সীমার মধ্যে ব্যবহার করতে দিতে হবে।
২. ডিজিটাল ডিটক্সের চর্চা: সপ্তাহে অন্তত একদিন পরিবারিকভাবে ‘মোবাইল ফ্রি ডে’ পালন করা যেতে পারে। এই দিনে সবাই বই পড়া, গল্প বলা, রান্না, হাঁটাহাঁটি বা খেলাধুলার মতো কাজে যুক্ত থাকবে।
৩. বিকল্প আনন্দদায়ী কার্যক্রম: শিশুকে বই পড়া, চিত্রাঙ্কন, গান, খেলাধুলা, বাদ্যযন্ত্র শেখার মতো কাজে যুক্ত করা যেতে পারে। এতে তাদের মনোযোগ ইতিবাচক দিকে যাবে।
৪. স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা: শিক্ষকদের উচিত মোবাইল ব্যবহারের কুফল নিয়ে আলোচনা করা এবং ছাত্রদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। পাঠ্যসূচিতে ডিজিটাল সুরক্ষা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
৫. সরকারি ও সামাজিক উদ্যোগ: গণমাধ্যমে সচেতনতা প্রচার, তথ্যচিত্র, পোস্টার, সামাজিক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে এই সমস্যা নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার।
মোবাইল ফোন আধুনিক জীবনের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ, এটা সত্যি। কিন্তু অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার আমাদের সন্তানদের শৈশব কেড়ে নিচ্ছে, তাদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে তুলছে। আসক্তির এই দৌড় যদি এখনই থামানো না যায়, তাহলে একদিন আমরা পেছনে ফিরে তাকিয়ে শুধু আফসোসই করবো।
তাই এখনই সময়, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র মিলে শিশু-কিশোরদের সুস্থ মানসিক ও সামাজিক বিকাশে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। সময়োপযোগী সচেতনতা, কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আর ভালোবাসা দিয়েই গড়ে তোলা সম্ভব প্রযুক্তির সঙ্গে সহাবস্থানের এক স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ।
একটা প্রজন্ম শুধু পরীক্ষার ফল নয়, মানসিক সুস্থতা, মানবিকতা আর সৃজনশীলতা দিয়েও তৈরি হয়। সেই প্রজন্ম যদি এক স্ক্রিনের পেছনে ডুবে থেকে জীবনের আসল রঙগুলো দেখতে না পায়, তবে সেটি সমাজের জন্য এক চরম ব্যর্থতা।
আমরা চাই না, আমাদের সন্তানরা কেবল ভার্চুয়াল জীবনের বাসিন্দা হোক। আমরা চাই তারা আকাশ দেখুক, পাখির ডাক শুনুক, হাত মেলে খেলুক, পড়ুক, স্বপ্ন দেখুক। আর বড় হয়ে হোক একজন সৃষ্টিশীল, ভারসাম্যপূর্ণ ও মানবিক মানুষ।
তাই এখনই সময়, মোবাইল আসক্তির বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত প্রতিবাদ গড়ার, নতুন করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র মিলে শিশু-কিশোরদের জন্য একটি সুন্দর, সুস্থ, পরিমিত ডিজিটাল পরিবেশ তৈরি করার।
এই সমাজকে, এই ভবিষ্যৎকে আমাদেরকেই বাঁচাতে হবে, ভালোবাসা দিয়ে, সময় দিয়ে, সচেতনতার আলো দিয়ে।
পরিচিতি : সংবাদকর্মী, গীতিকার ও লেখক। সম্পাদক সাহিত্য ম্যাগাজিন জানালা।
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur