চাঁদপুর

মেঘনায় ভাঙনের কবলে রাজরাজেশ্বর : অর্ধশত পরিবারের আর্তনাদ

উত্তাল পদ্মা-মেঘনার প্রবল স্রোতে ভাঙনের কবলে পড়ে ভিটেমাটি হারিয়ে আর্তনাদ করছেন চাঁদপুর সদর উপজেলার ১৪ নং রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশত পরিবার। আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন এদিক সেদিক, কিন্তু চারদিকেই তো উত্তাল নদী ঘেরা। কোথায় যাবেন পরিবার-পরিজন ও গবাদি পশু সহ ভাঙ্গন কবলিতরা নানা চিন্তায় অসহায় হয়ে পড়েছেন।

বৃহস্পতিবার (২৮ জুলাই ) সকাল ১০ টায় মেঘনা পাড়ি দিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে গিয়ে দেখা যায়, পদ্মা-মেঘনার ভয়ংকর স্রোতের কবলে রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের গোয়ল নগর চোকদার কান্দি, ৬ নং ওয়ার্ডের লগিগমারা চরের বেপারী কান্দি ও বালিয়ার চরের দেওয়ান কান্দি এ ৩টি ওয়ার্ড প্রায় সম্পূর্ণ ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে।

নতুন করে মাথা গোজার ঠাঁই তৈরি এবং বেঁচে থাকার জন্য প্রশাসনসহ সকলের সাহায্য সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন তারা। গত ক’দিন ধরে ভাঙনের কবলেও পড়লেও প্রশাসনের কর্তাব্যাক্তি কেউই কোনো আশ্বাস তাদের এখনো দেননি।

আশপাশের আরোও কয়েকটি ওয়ার্ডও এর সাথে যুক্ত হচ্ছে।

ইউনিয়নের বাসিন্দারা অনেকে তাদের স্থাপনা সরিয়ে নিয়েছে। আবার অনেকে এখনো নতুন ঠিকানা খুঁজে না পাওয়ায় কি করবে কিছু ঠিক করতে পারছে না।

৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মহিলা মেম্বার শাহিদা বেগম চাঁদপুর টাইমস জানান, ‘আমি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত। ছোট বাগাদির বালিয়ার চরের একজন বাসিন্দা। এ এলাকায় ১০ বছর যাবৎ বসবাস করছি। নদীর ভাঙনের কারণে আমার বসত বাড়ি হুমকিতে পড়েছে। এর পূর্বে আমি ইউনয়নের চৌকদার কান্দি এলাকায় গোয়াল নগর চরে ৫ নং ওয়ার্ডে ১৩ বছর বসবাস করেছিঃ। সে স্থানটি নদী তলিয়ে নিয়ে যাওয়ায় এ স্থানে এসে বসতি স্থাপন করি, এখন এখানেও ভাঙন শুরু হয়েছে।’

বসত ঘর রক্ষায় বাঁশ দিয়ে ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছে একটি পরিবার।- ছবি : চাঁদপুর টাইমস

সাবেক এ জনপ্রতিনিধি, স্থানীয়দের সহযোগিতা তো দূরে কথা, নিজের ২ ছেলে ও ২ মেয়ে নিয়ে এখন কি করবো বা কোথায় গিয়ে উঠবে? সে নিয়ে বিষয়ে চিন্তায় পড়ে গেছেন।

ছোট বাগাদির কৃষক চাঁন মিয়া চাঁদপুর টাইমসকে জানান, এ চরে তিনি প্রায় ৭ বছর ধরে বসবাস করছেন। এর পুর্বে জাহাজমারা চরে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। এখন নদী ভাঙনের কবলে পড়ে পুনরায় জাহাজ মারা চরের দিকে ফিরে যেতে হচ্ছে। কিন্তু তার হাতে এখন নগদ অর্থ নেই। সে সাথে ৪ মেয়ে ও ১ ছেলে স্ত্রী নিয়ে যাতায়াত ও খাবার নিয়েও চিন্তার কথা জানান এ কৃষক।

স্থানীয় আরোও কয়েকজন জানান, ‘ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ মৎস্য আহরণ, গরুর দুধ বিক্রি ও কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। মূল জেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন এ ইউনিয়নটি এর আগেও নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে কযেকটি ওয়ার্ড হারিয়ে গেছে। নদীর উত্তাল ঢেউ সরাসরি ইউনিয়ন ভূখণ্ডে আঘাত হানায় নদীর স্রোতধারা দু ভাগে বিভক্ত হয়ে এক ভাগ মেঘনায় ও অন্যভাগ পদ্মা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে করে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধ কিছুটা হলেও রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের কারনে রক্ষা পাচ্ছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। যদি কোনভাবে রাজরাজেশ্বর ইউনিয়ন বিলীন হয়ে যায় তাহলে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধ ও পুরাণ বাজার পুরোপুরি হুমকীর মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

নদী ভাঙনে রোজরাজেশ্বর ওমর আলী উচ্চ বিদ্যালয়, রাজরাজেশ্বর লগ্গিমারা মোজাফফরিয়া দাখিল মাদ্রাসা, বালিয়ারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোয়াল নগর এম ভি কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লগ্গিমারা আশ্রায়ন প্রকল্প, বালিয়া ঢালি কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হুমকীতে রয়েছে।

রাজরাজেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো: মিজানুর রহমানের সাথে ইউনিয়ন ভূখণ্ড নিয়ে আলাপাকালে তিনি চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘১৯৮৮ সালে প্রথম এ চরটি পদ্মা-মেঘনার বুকে ভেসে উঠে। এরপর ১৯৮৯-৯০ এর মাঝামাঝি সময়ে চরটি মেঘনা পদ্মায় আবার বিলীন হয়ে যায়। পুনরায় ১৯৯৮ সালে আবার একই স্থানে জেগে উঠে রাজরাজেশ্বর চর।’

চরে লোকজন চাঁদপুরের অন্যান্য চর ও উপজেলা সদর থেকে এসে বসতি স্থাপন শুরু করে। চরটির আয়তন ৩৮ বর্গ কি:মি:। মৌজা ৯টি এবং গ্রাম ১৩ টি। বিভিন্ন সময়ে নদীর ভাঙ্গনে চরটি দু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একভাগের কিছু অংশ ২ টি ওয়ার্ড শরিয়তপুর সীমানার সাথে রয়েছে ও অন্যভাগ রাজরাজেশ্বর চর নামে পরিচিতি পায়।

ভাঙনকবলিত একটি পরিবার তাদের বসতঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। এ সময় তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান হজরত আলী বেপারী।- ছবি: চাঁদপুর টাইমস

এ চরে মোট লোকসংখ্যা রয়েছে ১৮ হাজার ৯৬ জন। এদের মধ্যে ভোটার সংখ্যা ১১ হাজার ২শ। মোট ৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১ টি কমিউনিটি বিদ্যালয়, আরো ২টি কমিউনিটি বিদ্যালয় স্থাপন চলমান, ১ টি উচ্চ বিদ্যালয়, ১ টি দাখিল মাদ্রাসা, ১ টি এবতেদায়ী মাদ্রাসা, ৩ টি এমদাদিয়া দাখিল মাদ্রাসা, ১টি সাইক্লোন সেন্টার, ৮টি ঈদ গা, ৪০ টি মসজীদ, পোষ্টঅফিস ১ টা, আশ্রায়ন প্রকল্প রয়েছে ১ টি ও কবরস্থান রয়েছে ১ টি।

রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান হজরত আলী বেপারী চাঁদপুর টাইমসকে জানান, চলতি ইউনিয়ন নির্বাচনে এ এলাকার জনগণের ভোটে রায় পেয়ে নির্বাচিত হয়েছি। নির্বাচিত হওয়ার পর পরই বর্ষার আগমন। বর্ষার শুরুতেই ৩ টি ওয়ার্ড নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। এ ব্যপারে জেলা প্রশাসক, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যানকে অবহিত করেছি। এ মুহূর্তে ভাঙন কবলিত মানুষদের জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ ও নগদ অর্থের প্রয়োজন। ভিটে মাটি ভাঙনের কবলে পড়ে নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে।’

তাঁর দাবি, ‘সঠিক সময়ে ত্রাণ ও নগদ অর্থ দিতে না পারলে, লোকজন তাদের বসত ঘর সরাতে পারবে না, এতে করে ভিটে মাটির সাথে বসতঘরও তলিয়ে যাবে।’

অন্য এক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদে তথ্য সেবা কেন্দ্রটি বজ্রপাতে পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তথ্য সেবা কেন্দ্রটিও পুনরায় স্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।’

About The Author

ছবি ও প্রতিবেদন- মাজহারুল ইসলাম অনিক
Share