সারাদেশ

মুকুটহীন সম্রাটের মতোই খেতাব হীন মুক্তিযোদ্ধা আলফু মিয়া

বিচিত্র এই পৃথিবীর বিচিত্র সব মানুষ, আরও বিচিত্র মানুষের স্বভাব-চরিত্র, চালচলন। কখনযে কার মাথায় কি করার ইচ্ছে চেপে বসে, তা বলা মুশকিল। কেউ লম্বা দাড়িগোঁফ, কেউবা লম্বা চুল রাখতে পছন্দ করে। কেউ বাহারি পোশাক পরে সেজেগুজে থাকতে পছন্দ কেরন। কেউবা আবার উদোম গায়ে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

হ্যাঁ এমনই একজন উদোম মানুষের দেখা মিলবে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার সদরে। তিনি শখের বসে কিনা কে জানে, তবে কনকনে শীতে প্রচণ্ড গরমে কোনো ঋতুতেই গায়ে কাপড় জড়ানা। শুধু মাত্র এক টুকরো গামছা তাঁর একমাত্র পরিধেয় বসন। আর তাও হয়তো লজ্জা নিবারণের জন্যেই।

বয়স আশি ছুঁইছুঁই এই বৃদ্ধের নাম আলফু মিয়া। সবাই তাঁকে আলফু ফকির নামেই চেনেন। কে জানে ফকির নামের আড়ালেই কিনা চাপা পড়ে আছে তাঁর আরেকটি বড় পরিচয়? আর সেই পরিচয়টি হলো, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে রয়েছে তাঁর সাহসীপূর্ণ ভূমিকা। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক্কালে দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ এর ভয়াবহ যুদ্ধের কথা অনেকেরেই জানা।

২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাবার পর ৩১ মার্চ জাফরগঞ্জ হানাদার বাহিনীর সাথে নিরস্ত্র বাঙালিদের মুখোমুখি সংঘর্ষে শহীদ হন ৩৩ জন বীর বাঙালি। এসময় নিহত হয় ১৫ জন হানাদার সদস্যও। এসময় টগবগে তরুণ আলফু মিয়াও হানাদারের গুলির আঘাতে গুরুতর আহত হন।

আলফু মিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার বয়স ছিল ২৮ বছর। তখন জাফরগঞ্জ বাজারে একজন সাধারন পান দোকানি আমি। ৩১ মার্চ একদল সশস্ত্র হানাদার বাহিনী জাফরগঞ্জ আসার পর স্থানীয় হাজারো জনতা তাড়া করে তাদের।

এসময় ২৮ বছরের তরুণ এই আমিসহ (আলফু মিয়া) স্থানীয় জনতা কৌশলে সৈন্যদের ঘেরাও করি। পাকহানাদার সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে দৌড়ে গিয়ে শ্রী পুকুরপাড় পশ্চিম মসজিদের ভেতর আশ্রয় নেয়। এসময় মসজিদের দরজা জানালা বাহির থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়। ক্ষুব্ধ জনতা মসজিদের ছাদ ছিদ্র করে ভেতরের মরিচের গুঁড়া, কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে তাদের মারার চেষ্টা করি।

আলফু মিয়া বলেন, তখন আমি টগবগে তরুণ। সবার সাথে আমিও অংশ নেই হানাদার নিধনে। শুকনা মরিচের বস্তায় আগুন লাগিয়ে কেরোসিন ঢেলে সজিদের ভেতরে পাক সৈন্যদের কাবু করি। এদিকে হানাদার সদস্যরাও মসজিদের দেয়াল ভেদ করে গুলি বর্ষণ করতে থাকে, নিরস্ত্র বাঙালির জনতার ওপর। একপর্যায়ে হানাদাররা আত্মসমর্পণে বাধ্য হলেও, ইতিমধ্যেই তাদের গুলিতে শহীদ হন ৩৩ নিরস্ত্র বাঙ্গালী।

সৈন্যরা গুলি করে বন্ধ দরজা ভেংগে বাইরে এলে বাংগালীরা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে ১৫ শত্রুকে হত্যা করে। এ অপারেশনে পাকিস্তানীদের গুলিতে আলফু মিয়াসহ তিন জন আহত হন।

আলফু মিয়া বলেন, রেহাই পায়নি আমিও। হানাদারদের ছোঁড়া বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আমার ডান বাহু। বিচূর্ণ হয়ে যায় হাঁড়। অপর দুজনের গুলি যেহেতু পেটে ও বুকে লেগেছিল তারা পরবর্তীতে মারা যান।

তিনি বলেন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ভয়ে তখন কোন ডাক্তার আহতদের চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি। আমি বিভিন্ন গাছের পাতা গুলিবিদ্ধ ডান বাহুতে পেঁচিয়ে কোন রকমে নয়টি মাস পার করি। পরে কুমিল্লায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। অবশেষে আংশিক সুস্থ হলেও পূর্ণাঙ্গ শক্তি ফিরে পাইনি এই হাতের।

আলফু মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, নয় মাসের যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলেও পরবর্তীতে অনেক অ-মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধার খেতাব, সম্মানীভাতা ভোগ করছে। অথচ অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকেই সরকার যথাযথ মূল্যায়ন করেনি বা করতে পারেনি।
দেবিদ্বার উপজেলার বাজেবাখর নগর গ্রামের প্রয়াতঃ চান মিয়া এবং চন্দ্রবান বিবির ছেলে আলফু মিয়া। বিয়ে করলেন, সংসারী হলেন, দুই সন্তানের জনক হলেন আলফু মিয়া। মুরিদ হলেন এলাহী সাহের, পেলেন ফকির খেতাব। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রেখে আহত হয়েও পেলেননা মুক্তিযুদ্ধের খেতাব। তা-ই মুক্তিযোদ্ধা আলফু মিয়া আক্ষেপ।

জাফরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের একটা সনদ ছাড়া তাঁর কাছে আর কোন দলিল নেই, তাঁর এ বীরত্বগাথা্ কাহিনী প্রমানের জন্য। এ জন্যেই এ সনদ তিনি বুকে আগলে রাখেন সব সময়, আর অপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটু স্বীকৃতি পাবার জন্য।

জীবনের শেষপ্রান্তে এসে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজ নামটি লিখাতে চান এই যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল,২৬ মার্চ ২০২০

Share