Home / ফিচার / শনিবারের শনির দশা : মা বাবা হোক সন্তানের পার্থিব স্বর্গস্থান
Hai rommo

শনিবারের শনির দশা : মা বাবা হোক সন্তানের পার্থিব স্বর্গস্থান

শনিবারের শনির দশা উপ-শিরোনামে মা বাবা হোক সন্তানের পার্থিব স্বর্গস্থান নামে একটি রচনা লিখেছেন উপ-সচিব মোহাম্মদ আবদুল হাই। এ পর্বে বিষয় হলো দু’জন পিতা-মাতা ও তার সন্তাদের ইতিকথা। চাঁদপুর টাইমস পাঠকদের জন্যে তা তুলে ধরা হলো।

জন্মদাতা ও জন্মদাত্রী পিতামাতা যে সন্তানের আপনজন তা সবার অনুমেয় । মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেস্ত এটি ইসলাম ধর্মে স্বীকৃত । ইসলাম ধর্মে পিতামাতার মধ্যে মাকে সর্বোচ্ছ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং পিতাকেও মায়ের পরে স্থান দেয়া হয়েছে ।

বলা হয়েছে, যে সন্তান পিতা মাতা উভয়কে বা তাদের কোন একজনকে জীবিতাবস্থায় পেল কিন্তু সেবা করে ইহকালে বেহেস্ত কনফার্ম করতে পারেনি তারমতো হতভাগা আর কেহ নাই । কিন্তু বর্তমান সমাজে মডার্ন পাংকু মার্কা, মুখে মশুর ডাল ও ব্লীচ, চোখে শশা লাগানো, চুলে কালার, লম্বা নখে গাঢ় প্রলেপের আলকাতরা লাগানো সর্বোপোরি মুখ হতে গলা পর্যন্ত সাদা কিন্তু পা ও হাত অরজিনাল কাইল্যা বা শ্যামলা রং সমৃদ্ধ অনেক স্ত্রীর কারণে বৃদ্ধ বাবা মা খোঁজ খবর বিহীন বা বৃদ্ধশ্রমে !

মডার্ন সুনসান আলিশান ফ্লাটে তাদের চরম বেমানান ! নাতি নাতনীকে দেখার বিরল সৌভাগ্য অনেক বৃদ্ধ পিতামাতার কপালে থাকে না । পিতামাতা অসুস্থ হলে সূর্য দর্শনের ছলে চাদ হতে ফেলে দিলে সহজে লেটা চুকে যায় যা সম্প্রতি ভারতে ঘটেছে !

অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, মনে হয় মডার্ন কোন ছেলে মেয়ে অদুর ভবিষ্যতে বৃদ্ধ হবে না । তারা এখন যাদের কাছে ডেডি বা মম শুনে, সময় বলে দিবে যুগের আবর্তে তারাও হতভাগা পিতামাতার বদদোয়ায় ডেডি হতে ডেড(Dead) এবং মম হতে মমি হবার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হতে বাধ্য ।

আমাদের এলাকায় ছোটকালে মুরব্বীদের বলতে শুনেছি যে, শীপে যারা চাকরি করে তারা বৃদ্ধকালে খাবারে কষ্ট করে। কারণ তারা নাকি জাহাজে চাকরিকালীন প্রচুর খাবার নষ্ট করে! বিষয়টির সত্যতা যাচাই করার সুযোগ হয়নি তবে স্বচক্ষে দেখা এক জাহাজীওয়ালার করুন মৃত্যুর কাহিনী এখনো মনকে নাড়া দেয়।

আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র । জাহাজীওয়ালা মফিজ (চদ্ম নাম) চরম অসহায় । জাহাজে চাকরি করে অনেক টাকা কামিয়েছেন কিন্তু পাঁচ পুত্র একটাও মানুষ হয়নি । খেয়ে ধেয়ে সব শেষ । বৃদ্ধ পিতা ও চোখে চানি পড়া মা আলাদা থাকে । সন্তানরা সবাই বিয়ে সাদি করে আলাদা থাকে । বাবা মার খোঁজ খবর বা ভরণপোষণে সন্তানরা নেই । এক চোখ কানা চোখে চানি পড়া বৃদ্ধ মহিলা মানুষের বাড়িতে কাজ করে রাতে একটু ভাত তরকারি এনে স্বামীকে খাওয়ায় ।

বৃদ্ধ মফিজের গায়ে তেমন শক্তি নেই , একটি লাটিতে ভর করে হেঁটে হেঁটে প্রতিদিন দোকানে আসতো ! অপলোক চোখে এক কাপ দুধ চা আর একটি বেলা বিস্কুট প্রাপ্তির আকাঙ্খা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার সমতুল্য ছিল ! কোন কারণ ছাড়াই বিনে পয়সায় আমি যে তাকে কত দুধ চা আর বেলা বিস্কুট খাইয়েছি তার ইয়ত্তা নেই । চা খেতে খেতে উত্তাল ও ঝান্জা বিক্ষুব্ধ সাগরের যে রোমান্চকর ও ভীতিপ্রদ গল্প শুনেছি তা হাজার কাপ ফ্রি চায়ের বিনিময়েও যে পাওয়া যাবেনা তা এখন বুঝি । যৌবনের উত্তাল সময়ে জাহাজে করে কত দেশ যে ঘুরেছেন, কত দেশের কত রকম খাবার খেয়েছেন, কত মানুষ যে টাকা ধার নিয়ে আজো শোধ করেনি এ সব তার কাছে এখন দু:খে মেশানো সুখময় স্মৃতি ! সময়ের আবর্তে এখন কেউ তার পাশে নেই ! নেই নিজের ঔরসজাত সন্তান ! আছে কেবল কানা বৃদ্ধ স্ত্রী । বৃদ্ধ স্ত্রীরা যে কেন কানা, লুলা, অন্ধ, অবস, অসাড় , অচল ও নিশ্চল স্বামীদের আমৃত্যু সেবা করে তা কেবল বিধাতাই ভালো জানে !

তো এ বৃদ্ধ মফিজ হঠাৎ ঘরবটে (বিছানা হতে উঠতে না পারা) হয়ে গেলেন । আমার সাথে আর দেখা হয় না । সবাই বলে আর বেশি দিন বাঁচবে না । বৃদ্ধের অনেক দিনের ইচ্ছা গরুর কলিজা দিয়ে গরম পরোটা খাবেন । কিন্তু গরীব বলে কেউ আর খাওয়াইনি ! বৃদ্ধ পিতার এ ইচ্ছাটি পাঁচ সন্তানও জানলো । কিন্তু নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত কোন সন্তানের হাতে সময় ছিলো না! কানা স্ত্রী এখনো অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা পায় তা দিয়ে বৃদ্ধার সেবা করে যাচ্ছে !

এভাবে প্রায় ছয়মাস অতিবাহিত হলো । অবশেষে আজরাইল সিগনাল দিলো ! বৃদ্ধার দম নিতে কষ্ট হচ্ছে , বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে, চোখ বড় বড় করে পৃথিবীকে দেখার প্রানান্তকর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চলছে !

প্রতিবেশিরা বৃদ্ধার সন্তানদের খবর দিলো বাবাকে শেষ বারের মতো দেখতে চাইলে আসতে । হঠাৎ বড় সন্তান বেশ আবেগী হয়ে গেল । দৌড়ে বাজারে গেল ! ভাই ভাই হোটেল হতে গরম পরোটা আর গরুর কলিজা নিয়ে আসলো ! বাড়িতে যখন প্রতিবেশিরা চামচে করে পানি মুখে দিয়ে বৃদ্ধার কলিজা ঠান্ডা করছিলো তখন বড় ছেলে গরম পরোটা আর রান্না করা সুস্বাদু কলিজা বৃদ্ধার মুখে ঠেসে দিয়ে অন্তিম ইচ্ছার স্বপ্নীল সমাধি রচনা করলো !

গরম কলিজার স্বাদে দম আটকে বৃদ্ধা শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলো (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। এর কিছু দিন পরে কানা স্ত্রীও প্রতিবেশির চামচের পানি আর সন্তানের হাতে গরম পরোটা ও কলিজা ঠেসে খাওয়ার স্বাদ অপূর্ণ রেখে ঘুমের ঘোরে ইহধাম ত্যাগ করে সকালে প্রতিবেশির কৃপায় স্বামীর পাশের কবরে শুয়ে পড়লো !

কেন জানি মনে হয় কানা বুড়ি আর বুড়া কবরে বেশ আহ্লাদে আছে মহান স্রষ্টার কৃপায় ! মহান আল্লাহ তাদের বেহেস্ত নসিব করুন ।

লেখক- প্রাক্তন এডিসি ও ডিডিএলজি, চাঁদপুর।
বর্তমানে ডেপুটি প্রজেক্ট ডাইরেক্টর(স্মার্ট কার্ড),
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, ঢাকা
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ২:০৩ এএম, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮, শনিবার
ডিএইচ