Home / শিল্প-সাহিত্য / মানুষের ভেতর ও বাইরের স্বরূপ মূল্যায়ন
মানুষের ভেতর ও বাইরের স্বরূপ মূল্যায়ন

মানুষের ভেতর ও বাইরের স্বরূপ মূল্যায়ন

সুখ এবং দুঃখ দুটোই মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই সাথে আরো কিছু উপসর্গ যোগ হয় কষ্ট, যন্ত্রণা, হাহাকার আর অমানিশা।

এর বিপরীতে কারো কারো জীবনে নিয়তই আসে প্রাচুর্য্য, বিলাসিতা, ভোগ-সুখ, উচ্চাকাঙ্খা ও বসন্তের কোকিলের কুহুতান।

একজন মানুষ যখন এসবের মধ্যে আকণ্ঠ ডুবে থাকবে তখন সে অন্য পৃথিবীর জরা-যন্ত্রণা টের পাবে না। সে সুখের প্রাচুর্য্যরে কালে সামনে পাবে মোহনীয়-মোহময়ী সুন্দরী পৃথিবীর সব চাকচিক্যময় উপাদান।

তাকে হাতছানি দেবে জীবনের আরাধ্য সব সুখ্যাতি- সম্মান।

কিন্তু মাঝে মাঝে ‘বিনা মেঘে বজ্রপাতে’র মতো যখন তার জীবন থেকে ‘কর্পুরের মতো উবে যাবে’ সম্পদ, ধন-জন তখন তার ডাকে কেউ আসবে না ছুঁটে।

‘একেলা চলো রে ..’ নীতি গ্রহণ করে একেলাই এগিয়ে যেতে হবে জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাক্সক্ষার মূলে কুঠারাঘাত করে।

‘‘মানুষ জীবনে যা চায়, তা পায় না’’ এমন কথা সবক্ষেত্রে সত্য নয়, এর বিপরীতও ঘটে। আবেগ-অনুভূতি, সুখানুভূতি মানুষ মাত্রই থাকবে। মাঝে মাঝে আবেগের ঘটঘটা জলাঞ্জলি দিয়ে যখন প্রতিজ্ঞা থেকে ‘মেদ-ভূড়ি’ ফেলে দিয়ে জীবনকে অনন্যতায় ভরিয়ে দিতে পারবেন, তখন আপনার জীবনে তা-ই ঘটবে যা প্রত্যাশিত।

‘মানুষ সাধারণত স্বার্থপর’। একথা শুনলে যে কেউ-ই ক্ষেপে ওঠবে। কেউ নিজকে স্বার্থপর হিসেবে কলঙ্কিত করতে চায় না। তবে এটাই সত্য যে, মানুষ নিজের স্বার্থের বাইরে কিছুই করতে চায় না। এক পা’ও বা এক কদমও এগুতে চায় না নিজের স্বার্থ ছাড়া।

মানুষ যখন দান করবে, সেখানেও স্বার্থ থাকবে। ¯্রষ্টাকে স্মরণ করবে তাতে পূণ্যের আশা। রাজনীতি-সমাজনীতি, বিয়েশাদী, ঘরসংসার, ব্যবসা-বাণিজ্যÑ সবকিছুতেই মানুষের স্বার্থ সম্পর্কিত। বলা যায়, পৃথিবীতে বেশিরভাগ কাজই স্বার্থের গ-ির আওতায়।

তবুও এ সমাজে মানুষ এসব স্বার্থের কথা কখনই স্বীকার করতে চায় না। আমরা সব সময়ই ‘সাধুবেশী পাকা চোর’ অথবা ‘সর্ষের ভেতরই ভূত’ নিয়ে সমাজ-সংসারে সর্বদা একে অপরের জয়গান গেয়ে যাচ্ছি। হাততালি দিয়ে ‘দু’মুখো সাপ’দের বাহবা দিয়ে যাচ্ছি অবলীলায়। তেলওয়ালার মাথায় কীভাবে আরো তেল মর্দন করা যায়, সেই চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়।

এ সমাজে সব সময়ই ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’ বা ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’ জন্মায়। এটি করতে আমরা বেশি পারঙ্গম। সেই সাথে নিজকে ‘বিশ্বনায়ক’ আর অপরকে ‘খলনায়ক’ ভাবতেই বা প্রমাণিত করতেই আমরা বেশি পছন্দ করি।

এই লেখাটা আমি জ্বরের ঘোরে লিখছি। কারণ আমিও এই দলেরই একজন। জ্বরের ঘোরে লেখায় ‘নির্জলা কিছু সত্য কথা’ লিখে ‘বর্ণচোরা মানুষের’ স্বরূপ উন্মোচনো যে ‘অপরাধ’ করে ফেললাম, তার জন্য মূলত আমিও নিজকে দায়ী করতে চাই না। দায় নেবে এই একশ’ ছয় ডিগ্রি জ্বরটা। সে-ই আমাকে এক প্রকার ‘আছর’ করে এসব না বলা কথা বলিয়েছে।

শুরুতে যা বলেছিলাম, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার কথা। মানব জীবনের এই অংশে ‘কখনও রোদ, কখনও বৃষ্টি’। কখনও অমানিশা কখনও মায়াময় সৃষ্টি। এখানেই মানুষের আসল স্বরূপ প্রকাশিত হয়। রাস্তায় যখন এক টাকা পড়ে থাকে তখন অনেকেই ‘কার টাকা’ ‘কার টাকা’ বলে চিল্লায়, অপরদিকে যখন এক লাখ, দুলাখ বা এক কোটি টাকা রাস্তাঘাটে পাওয়া যায় তখন প্রকৃত মানুষের প্রকৃত স্বরূপ চেনা যায়। চেহারা দেখে আসল নকল চেনা খুব কঠিন।

যদিও মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বার্থপরতায় নিমগ্ন কিন্তু মাঝে মাঝে ‘ভুল করে’ অথবা মনের অগোচরে কিছু স্বার্থহীন কাজ করে ফেলে। যেমন গত শনিবার আমার ছোট মেয়েটা ‘এক্সিডেন্ট’ হলো। তাকে অটোচালক রক্তমাখা অবস্থায় কষ্ট করে বাসায় পৌঁছে দিলেন। এখানে কী তার স্বার্থ তা বুঝা না গেলেও যে ট্রাফিকের হাতের রোলারের আঘাতে ওই অটো চালকের অটোবাইকের পেছনের গ্লাস ভেঙ্গে আমার মেয়েটার হাত কেটে রক্তক্ষরণ হয়েছিল এবং ওই ট্রাফিকের হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি এবং ফোন করে ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে অন্তর্নিহিত ‘স্বার্থহীন ভালো মানুষ’ হওয়ার কথা প্রকট হয়েছে।

সাহিত্যেÑ গল্প-কবিতায় লেখক সব সময়ই স্বাথের বাইরে থেকে লেখার চেষ্টা করেন। গল্পের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-যন্ত্রণায় তিনি অংশগ্রহণ গ্রহণ করেন না। নির্মোহভাবে লিখে সমাজস্বরূপ উদ্ঘাটন করেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি ও এসবের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন কি? পারলেও বা কতটুকু?

গল্পের লেখকও যেহেতু একজন মানুষ, তাই তাকেও পৃথিবীর সব দৃশ্য-অদৃশ্যমান বিষয় স্পর্শ করে।

আমরা প্রতিটি মানুষের জীবনের সবক’টি অধ্যায়, পরিণতি, সৃষ্টি, সূচনা একসঙ্গে দেখতে পাই না। তাই আমরা একে অপরকে খ-িতভাবে তড়িঘড়ি মূল্যায়ন করে ফেলিÑ সেই ‘দশ অন্ধের হাতী দেখা’র মতো। দশ অন্ধ যেমন হাতী দেখতে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে একেকজন এসে হাতী একেকপ্রকার বলে মন্তব্য করেছিলেন, ঠিক তেমনি এই সমাজ-সংসারে আমরা অপরকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও যেমন মানসিক অবস্থান ঠিক সেভাবেই মূল্যায়ন করে ফেলি সহজেই।

এ পৃথিবীতে কোনো মানুষ অপরকে মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে একশ’ ভাগ মূল্যায়ন করতে পারে না। মূল্যায়ন করতে গিয়ে স্বার্থের বিষবাষ্প উগড়ে দিয়ে বিষাক্ত ফণার অতলে তলিয়ে যায়।

মানুষ অপরকে সেভাবেই মূল্যায়ন করে যেভাবে যে চোখে সে বিশ্বকে দেখে।

মিজানুর রহমান রানা, প্রধান সম্পাদক, চাঁদপুর টাইমস

 

|| আপডেট: ০৫:৩০ অপরাহ্ন, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, সোমবার

এমআরআর