Home / স্বাস্থ্য / ডেঙ্গু জ্বরে মাতৃমৃত্যু থেকে বাঁচতে হলে
ডেঙ্গু জ্বরে

ডেঙ্গু জ্বরে মাতৃমৃত্যু থেকে বাঁচতে হলে

প্রসব-পরবর্তী সময়ে কোনো কারণ ছাড়া জ্বর এলে ডেঙ্গু ধরে নিতে হবে। এ সময় রোগীর ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং কম বা বেশি–দুটোই ক্ষতিকর। তাই অবশ্যই রোগীকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বরে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি তিন গুণ বেড়ে যায়। আর যদি ডেঙ্গু হেমোরেজিক হয়,সে ক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যায় ৪৫০ গুণ। সময়মতো রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা পেলে এই মারাত্মক জটিলতা বা মৃত্যুহার ১ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব।প্রায় ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর তেমন উপসর্গ থাকে না। উপসর্গের ধরন অনুযায়ী একে তিন ভাগে ভাগ করা হয়।

গ্রুপ এ : যাঁদের সাধারণ জ্বরের মতো থাকে কিন্তু অন্য কোনো উপসর্গ থাকে না, তাঁদের বাসায় চিকিৎসা নিতে বলা হয় এবং বমি, তলপেটে ব্যথা, পাতলা পায়খানা, রক্ত পড়া ইত্যাদি বিপদচিহ্ন থাকলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলা হয়।

গ্রুপ বি : মডারেট বা মাঝারি ডেঙ্গু। তাঁদের কারও বিপদচিহ্নের সঙ্গে হালকা রক্তপাত থাকতে পারে আবার না-ও পারে। কারও আবার তেমন কিছুই থাকে না। তবে হৃৎপিণ্ড ও কিডনির রোগ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে অথবা রোগী গর্ভবতী হলে তাঁদের এই গ্রুপের আওতায় ধরা হয়; অর্থাৎ প্রসবের তারিখ যা-ই থাক, গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু হলে প্রটোকল অনুসারে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

গ্রুপ সি :সিভিয়ার বা জটিল ডেঙ্গু জ্বর। এই পর্যায়ে রোগীর লক্ষণীয় মাত্রায় রক্তপাত হতে পারে, শক বা অজ্ঞান হতে পারে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। এই গ্রুপের রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসাব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে সেবা দিতে হবে।

 

উপসর্গ : উচ্চ তাপমাত্রা, হাড় ভেঙে যাওয়ার মতো ব্যথার অনুভূতি। কিন্তু ভাইরাসের গঠন পরিবর্তনের কারণে উপসর্গের ধরনও বদলে যায়। এ সময় খুব জ্বর না থাকলেও পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া ও বমি থাকতে পারে।

 

রোগনির্ণয় : রোগীর উপসর্গের সঙ্গে রক্তের কিছু পরীক্ষা করাতে হবে।ডেঙ্গু এনএস১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা: জ্বরের এক থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে। সঙ্গে সিবিসি, এসজিপিটি,এসজিওটি পরীক্ষা।  ডেঙ্গু আইজিএম ও আইজিএম অ্যান্টিবডি: জ্বরের পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হবে।গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গুর প্রভাবে শিশুর ওজন কম হতে পারে ।

 

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে,রক্তে হেমাটোক্রিট যদি ২০ % বেড়ে যায়,পালস প্রেশার যদি কমে যায়, শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ ৫ হাজারের নিচে নেমে আসে, রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট ১ লাখের নিচে থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে রোগীর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যাকে বলে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার।

 

গর্ভাবস্থায় রক্তরসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এইচসিটি কম থাকে আবার প্রেশার একটু বেশি থাকে। সে জন্য পরপর কয়েকটি পরীক্ষা করাতে হয়।

গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গুর প্রভাব : গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে কোনো নারী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তাঁর গর্ভপাতের ঝুঁকি থাকে ৩ থেকে ১৩ %। মস্তিষ্কের গঠনে সমস্যা হতে পারে।

গর্ভের মধ্য ও শেষ ভাগে হলে সময়ের আগে পানি ভেঙে যাওয়া বা প্রসবের ঘটনা ঘটতে পারে।
শিশুর ওজন কম হওয়া, এমনকি পেটে সন্তান মারাও যেতে পরে।

 

প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হতে পারে। প্রসবের আগে যোনিপথে রক্তক্ষরণ, বিশেষ করে পিপিএইচ বা প্রসবের পরে রক্তক্ষরণ হয়ে শক, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

 

গর্ভাবস্থায় শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের কারণে খুব দ্রুত ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং একসঙ্গে অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

 

জ্বর ও ব্যথা প্রশমন করতে হবে। প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে। অ্যাসপিরিন বা অন্য কোনো ব্যথানাশক খাওয়া যাবে না।

 

বেশি করে স্যালাইন, শরবত, ফলের রস, ভাতের মাড়, ডাবের পানি ইত্যাদি তরলজাতীয় খাবার খেতে হবে। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করতে হবে।ঠিকমতো প্রস্রাব হচ্ছে কি না, খেয়াল রাখতে হবে।

 

অবশ্যই গর্ভবতীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে মৃদু জ্বর বা উপসর্গ দেখা না দিলেও।

 

সাধারণত পাঁচ থেকে ষষ্ঠ দিনে যখন জ্বর ছাড়তে শুরু করে, সেই সময় কাপিলারি লিকেজ, অর্থাৎ কোষ থেকে ফ্লুইড বের হতে থাকে এবং এটি ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ সময় শরীরে পানি বা ফ্লুইড পরিমিত পরিমাণে যেন থাকে, সেটা খেয়াল করতে হবে।

 

 

৭ম দিন, অর্থাৎ বিপজ্জনক সময়ের পরপরই আবার কোষে পানি আসা শুরু হয়। তাই তখন অতিরিক্ত ফ্লুইড দেওয়া যাবে না। দিলে ফুসফুসে পানি জমে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

 

মারাত্মকভাবে প্লাটিলেট কমে গেলে ক্লিনিক্যাল অবস্থা দেখে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে প্লাটিলেট দিতে হবে। প্লাটিলেট সিঙ্গেল ডোনার থেকে দেওয়া ভালো। প্লাটিলেট ও রক্ত দিতে হবে কি না, সে বিষয়ে চিকিৎসক পরামর্শ দেবেন।

 

মনে রাখতে হবে, একান্ত প্রয়োজন না হলে কোনো ধরনের সার্জিক্যাল ইন্টারভেনশনে বা অপারেশনে যাওয়া উচিত হবে না।

 

প্রতিবেদক : ডা. আরিফা শারমিন মায়া , জেনারেল গাইনি ও প্রসূতি এবং ফিটোমেটারনাল মেডিসিন, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভরোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন, কনসালট্যান্ট, গাইনি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

সম্পাদনায় :আবদুল গনি
২ সেপ্টেম্বর ২০২৩