চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক | আপডেট: ০৩:২৮ অপরাহ্ণ, ১৪ আগস্ট ২০১৫, শুক্রবার
সরকারের দেওয়া সুবিধার কোনো সুফল পাচ্ছে না মৎস্য উৎপাদনকারী চাষী। এদিকে চাহিদা অনুযায়ী গুণমান-সম্পন্ন মাছের খাবারের অভাব ও অতিরিক্ত দামের কারণে দেশের মাছ চাষ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। মাছের খাদ্যের ঊর্ধ্বমূল্যের জন্য প্রতিকূল অবস্থার মুখে পড়ে ক্ষুদ্র চাষীরা মাছ চাষে উৎসাহ হারাচ্ছে। মৎস্য অধিদফতরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও মাছ চাষীদের সঙ্গে আলাপ করে এ সব তথ্য জানা গেছে।
মৎস্য বিভাগ ও ক্ষুদ্র চাষীদের সূত্রে জানা গেছে, প্রতিকূল অবস্থা ও লোকসানের মুখে পড়ে দেশের ক্ষুদ্র মৎস্য-চাষীদের অনেকে এরই মধ্যে মাছ চাষ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে একদিকে ক্ষুদ্র মৎস্য-চাষীরা যেমন পেশা থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে ক্রমান্বয়ে দেশের মাছ চাষ অনেকটাই দখলে চলে যাচ্ছে টাকাওয়ালা বা সামর্থবানদের হাতে।
যশোরের বেনাপোলের মাছ চাষী ঈশা খান বলেন, ‘মাছের খাদ্যের দাম কমাতে সরকার যে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে, তা আমরা মাছ চাষীরা কোনো সময়ই পাইনি। এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো প্রণোদনাও নেই। উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে বাজারে মাছের বিক্রি দাম কম থাকে। প্রতিকূল অবস্থায় অনেক চাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মাছ চাষ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। দিনে দিনে তা ধনীদের হাতে চলে যাচ্ছে।’
এদিকে ক্রমবর্ধমান মাছের খাবারের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশের মৎস্য কর্মকর্তারাও কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন।
মৎস্য-চাষীরা সরকারি উদ্যোগের কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না— এ বিষয়টি স্বীকার করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হক বলেন, ‘শুল্ক ছাড়ের কোনো সুবিধা মাছ উৎপাদনকারীরা পায়নি। মাছের খাদ্যের দাম না কমলে সরকার এ শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহার করে নেবে।’
মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, ‘মাছের খাবারের দাম কমানোর জন্য বিভিন্ন ইনগ্রিডেন্টের (উপাদান) ওপর সরকার শুল্ক মুক্ত সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু বাজারে মাছের খাবারের দাম ৫০ পয়সাও কমেনি। এতে মৎস্য উৎপাদনকারীরা কোনো সুফল পায়নি।’
সৈয়দ আরিফ আজাদ আরও বলেন, ‘বাজারে মাছের খাবারের গুণগত মান নিয়েও সমস্যা রয়েছে। গুণগত খাবারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা ও দামের ব্যাপারে আমরা চ্যালেঞ্জের মুখে আছি। অনেক চেষ্টা করেও এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা যাচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত মৎস্য-চাষীদের সহযোগিতার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেওয়া যায় কিনা, সে ব্যাপারেও আমাদের চিন্তা-ভাবনা রয়েছে।’
মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশের মোট একশত ছেচল্লিশ লাখ ৯৭ হাজার মাছ-চাষী বছরে সাত লাখ বিরাশি হাজার পাঁচশত ৫৯ হেক্টর বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করে আঠারো লাখ উনষাট হাজার আটশত ৮ টন বিভিন্ন ধরনের মাছ উৎপাদন করেন।
মাছের চাহিদা পূরণের জন্য মানুষ নানাবিধ পদ্ধতিতে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। বিগত দু’দশকে সারা বিশ্বে চাষ করা মাছের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। মাছ চাষ মৎস্যখাদ্যের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে। আর মৎস্যখাদ্যের উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ নির্বিচারে আহরণের ফলে মাছের প্রাপ্যতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
বিভিন্নভাবে মাছের আবাসস্থল, বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তা ছাড়া মাছের পুকুরে দেওয়া অতিরিক্ত ও অব্যবহৃত সম্পূরক খাদ্যের পচন এবং চাষ করা মাছের বর্জ্যের কারণেও পানি দূষণ হয়। দূষিত পানির মাধ্যমে প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদের প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে। নিবিড় ও আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষে ব্যবহৃত সম্পূরক খাদ্যে ভেজালের ফলে একদিকে চাষীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অপরদিকে ভেজাল ও দূষিত খাদ্যের বর্জে মাছের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন ব্যবহত হচ্ছে। জলাশয়ে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে।
মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাপী এক জরিপে জানা যায়, ৩৭ লাখ ২৪ হাজার টন শুঁটকি মাছ ও চার লাখ ২৫ হাজার টন মাছের তেল নিবিড় মাছ চাষে খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা ১৬.৬ মিলিয়ন টন ভাসমান মাছের সমতুল্য। উল্লেখ্য, শুধু ১৯৭১ সালেই ১ কোটি ৩০ লাখ টন এ্যানচোভি নামের ছোট মাছ ধরা হয়। এরপর থেকে এ মাছের প্রজাতিটি দিন দিন কমতে থাকে এবং ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী এ মাছের মোট উৎপাদন দাঁড়ায় মাত্র ৮০ লাখ টন। এভাবে ক্রমশ উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকলে মাছ চাষে অবশ্যই ধস নামবে।
এ সব সমস্যা হতে পরিত্রাণের জন্য মানুষ শুঁটকি মাছের বিকল্প অনুসন্ধানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন প্রকার দানাদার শস্য, সয়াবিন, সানফ্লাওয়ার, কসাইখানার বর্জ্য, কৃষি উপজাত, অধিক পরিমাণ ডিমধারণকারী শসা মাছ, জলজ আগাছা, ব্যাকটেরিয়াল কলোনি এবং সর্বশেষ কালো সৈনিক পোকার লার্ভা মাছের খাদ্য হিসেবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে। কালো সৈনিক পোকার লার্ভা দিয়ে তৈরি খাবার মাছের খাদ্য সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি শহর অঞ্চলের বর্জ্য পরিশোধনেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশে মোট বদ্ধ জলাশয় ৭ লাখ ৮২ হাজার ৫৫৯ হেক্টর। এর মধ্যে, পুকুর ৩ লাখ ৭১ হাজার ৩০৯ হেক্টর, লেক ও বাঁওড় ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর, চিংড়ি খামার ২ লাখ ৭৫ হাজার ২৭৪ হেক্টর, মৌসুমী জলাশয় এক লাখ ৩০ হাজার ৪৮৮ হেক্টর।
উন্মুক্ত জলাশয় ৩৯ লাখ ১৬ হাজার ৮২৮ হেক্টর। এর মধ্যে ৮ লাখ ৫৩ হাজার ৮৬৩ হেক্টর নদী ও মোহনা, সুন্দরবন এক লাখ ৭৭ হাজার ৭০০ হেক্টর, বিল এক লাখ ১৪ হাজার ১৬১ হেক্টর, কাপ্তাই লেক ৬ লাখ ৮ হাজার ৮০০ হেক্টর, প্লাবন ভূমি ২৭ লাখ ২ হাজার ৩০৪ হেক্টর। উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তৃতি ৭১০ কিলোমিটার, মোট জেলের সংখ্যা ১৩ লাখ ১৬ হাজার, অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের জেলে ৮ লাখ, সামুদ্রিক জেলে ৫ লাখ ১৬ লাখ। মোট মৎস্য-চাষী ১৪৬ লাখ ৯৭ হাজার। এর মধ্যে মৎস্য-চাষী ১৩৮ লাখ ৬৪ হাজার ও চিংড়ি চাষী ৮ লাখ ৩৩ হাজার।
জানা যায়, দেশে মোট মৎস্য উৎপাদন ৩৪ লাখ ১০ হাজার ২৫৪ টন। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের মৎস্য ২৮ লাখ ২১ হাজার ২৬৬ টন। উন্মুক্ত জলাশয় থেকে আহরিত ৯ লাখ ৬১ হাজার ৪৫৮ টন, বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা মৎস্য ১৮ লাখ ৫৯ হাজার ৮০৮ টন ও সামুদ্রিক মাছ মোট ৫ লাখ ৮৮ হাজার ৯৮৮ টন।
মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য রফতানি করা হয় ৮৪,৯০৫ মেট্রিক টন। যার দাম ৪,৩১২.৬১ কোটি টাকা। মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট মোট ১০০টি (ইইউ অনুমোদিত-৭৫)। জাতীয় মোট রফতানিতে বৈদেশিক মুদ্রার অবদান শতকরা ২.০১ ভাগ। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান; জিডিপিতে ২০১১-১২ সালে শতকরা ৪.৩৭ ভাগ ও কৃষি খাতে ২৩.৩৭ ভাগ।
দেশে বছরে জনপ্রতি মাছের চাহিদা ২১.৯০ কেজি। এখন যোগান দেওয়া হচ্ছে ১৯.৩০ কেজি। মাছের বাৎসরিক চাহিদা ৩৭.৯২ লাখ টন। প্রাণীজ আমিষ সরবরাহের অবদান শতকরা ৬০ ভাগ।
মৎস্য হ্যাচারি ৯৩৬টি, বছরে হ্যাচারিতে রেণু উৎপাদন হয় চার লাখ ৮৭ হাজার ৪৯৮ কেজি। প্রাকৃতিক উৎস থেকে রেণু সংগ্রহ হয় ৩৩২ কেজি।
মৎস্য অধিদফতরের উপ-পরিচালক (মৎস্য চাষ) ড. মো. গোলজার হোসেন বলেন, ‘দেশে বছরে ২০ লাখ মেট্রিক টন মাছের খাবারের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ১০ লাখ মেট্রিক টনের মতো।’
মো. গোলজার হোসেন আরও বলেন, ‘দেশের মাছের খাবারের সম্পূর্ণটাই বেসরকারিভাবে উৎপাদন ও বিপণন করা হয়। ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে ১১৫টি মৎস্য খাবার উৎপাদনকারী ও বিপণন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৭৩টি প্রতিষ্ঠান খাদ্য উৎপাদন করে থাকে। মৎস্য মন্ত্রণালয় ও মৎস্য অধিদফতর মৎস্য খাদ্য ও পশু খাদ্য আইন ২০১০, মৎস্য খাদ্য বিধিমালা ২০১১, মৎস্য হ্যাচারি আইন ২০১০ ও মৎস্য হ্যাচারি বিধিমালা ২০১১ অনুযায়ী মাছের খাবার উৎপাদন ও বিপণন বিষয়টি পরিচালিত হয়।’
তিনি বলেন, ‘বাজারের যে সব মাছের খাদ্য পাওয়া যায়, তা কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুণমান সম্পন্ন নয়। মাছ উৎপাদনকারীরা সরকারের সুবিধা পায় না। এতে চাষীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে।’
চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫