Home / স্বাস্থ্য / খাবার হলুদে ভয়াবহ মাত্রায় সিসা!
Holud

খাবার হলুদে ভয়াবহ মাত্রায় সিসা!

বাংলাদেশে হলুদ উৎপাদনকারী ৯টি অঞ্চলের হলুদে লিড বা সিসার উপস্থিতি বিধিবদ্ধ মাত্রার চেয়ে প্রায় ৫০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। গড়ে প্রতি গ্রাম হলুদে ৬৯০ মাইক্রোগ্রাম সিসার অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। মানবদেহে প্রতি ডেসিলিটারে সর্বোচ্চ ৫ মাইক্রোগ্রাম সিসা সহনীয় মাত্রায় ধরা হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৫২৪টি হলুদের উপকরণ নিয়ে কেমিক্যাল এনালাইসিস করে এই ভয়াবহ মাত্রায় সিসার উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছে খাবার হলুদে। (বাংলাদেশ প্রতিদিন)

বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ এ সংক্রান্ত একাধিক গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে হলুদের ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং এই সমস্যা মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণ করতে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে তারা।

ওই চিঠি পাওয়ার পর গত ৫ ডিসেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা করেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাখাওয়াত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে ৪টি। সিদ্ধান্তগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে শাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশে অবাধে বিষাক্ত সিসা (লিড ক্রোমেট) আমদানি না করার বিষয়ে নিয়ন্ত্রণমূলক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

কৃষি বা উৎপাদক পর্যায়েও হলুদের রং গাঢ় করার জন্য বিষাক্ত সিসা মেশানোর অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়টি স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধের লক্ষ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই কমিটি সচেতনতামূলক কার্যক্রম ছাড়াও বিভিন্ন সময় হলুদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ছাড়া কিছু এলাকার মাটিতে অতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি রয়েছে। ওইসব অঞ্চলের মাটি পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছিল, হলুদে সিসা মিশ্রণজনিত ভেজালের ফলে দেশের জনগণ বিশেষ করে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। পাশাপাশি আমাদের মসলা রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জনস্বাস্থ্যে হুমকির বিষয়টি উল্লেখ করে চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মানুষের দেহে সিসার সহনীয় মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম। বাংলাদেশের একটি জেলার একটি গ্রামে ২০-৪০ মাস বয়সী শিশুদের শতকরা ৭৮ ভাগের রক্তে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় সিসা পাওয়া গেছে এবং গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এটা ছিল শতকরা ৩০ ভাগের মতো। সিসা পূর্ণবয়স্কদের হৃদরোগ ও মস্তিষ্কজনিত রোগের ঝুঁকি বাড়ায় এবং শিশুদের মেধা বাধাগ্রস্ত করে। হলুদ পুরনো হলে সিসার প্রভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেড়ে যায় বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। রপ্তানিতে প্রভাব সম্পর্কে

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বলেছে, বিশ্বে হলুদ আমদানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ দেশ, যার বার্ষিক আমদানি ব্যয় ৩৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি। বিশ্বের ৮০ শতাংশের বেশি হলুদ ভারতে উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশ বিশ্বে হলুদ উৎপাদনে ৫ম। এ অবস্থায় বাংলাদেশের হলুদে সিসার উপস্থিতি ও পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সতর্ক না হলে তা রপ্তানিকৃত অন্যান্য পণ্যসামগ্রীতে বিষয়টি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠি পাওয়ার পর তারা সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে যে সভা করেন ওই সভায় পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রতিনিধি জানান, বাংলাদেশের হলুদে বিএসটিআই মান অনুযায়ী ২ দশমিক ৫ পিপিএম মাত্রার সিসা সহনীয় ধরা হয়। বিভিন্ন সময় পরীক্ষায় তারা ০ দশমিক ২ থেকে ৪৮ পিপিএম পর্যন্ত সিসার উপস্থিতি পেয়েছেন। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের প্রতিনিধি জানান, তাদের কাছে পাঠানো নমুনার প্রায় ৫০ শতাংশ হলুদে সিসার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ২০ শতাংশ হলুদে সিসার অস্তিত্ব ছিল সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেকগুণ বেশি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, হলুদে কীভাবে সিসা মেশানো হচ্ছে এ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন তারা। এর উত্তরে কৃষি বিপণন অধিদফতর জানিয়েছে, রাজশাহী, পাবনা ও পার্বত্য জেলাগুলোতে বেশির ভাগ হলুদ উৎপাদন হয়। তবে কৃষক পর্যায়ে হলুদে কোনো রং মেশানো হয় না। তবে এর বিরোধিতা করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।

সংস্থাটির প্রতিনিধি জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষক পর্যায়ে বিষাক্ত সিসা মেশানো হয়। তারা ঢাকার পাইকারি আড়ত শ্যামবাজারের হলুদের নমুনা পরীক্ষা করে বেশির ভাগ হলুদে বিষাক্ত সিসার অস্তিত্ব পেয়েছেন এবং সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে বলে সভায় জানিয়েছেন।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সৈয়দা সারওয়ার জাহান বলেন, হলুদে মাত্রাতিরিক্ত সিসার অস্তিত্ব নিয়ে আমরা ভোক্তা, উৎপাদক এবং ব্যবসায়ী সবাইকে সচেতন করার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছি। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্যে কৃষক ও খোলাবাজারে গুঁড়া হলুদের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে ব্যবসায়ীরা যাতে বিষাক্ত সিসা ব্যবহার না করেন সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছি।

এ ছাড়া ব্র্যান্ড এবং নন ব্র্যান্ড উভয় ধরনের গুঁড়া হলুদ পরীক্ষার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বলেন, এতদিন আইসিডিডিআরবির মেশিন নিয়ে আমরা হলুদের পরীক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছি। এখন তারা সেটি দিচ্ছেন না। আমরা মেশিন আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মূলত হলুদের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে যে রং ব্যবহার করা হয় সেখান থেকেই বিষাক্ত সিসার অস্তিত্ব মেলে। এক্ষেত্রে শুধু ভোক্তা নয়, ব্যবসায়ী এবং উৎপাদক এই তিন শ্রেণিকেই সচেতন করার দিকে নজর দিতে হবে সরকারকে। শুধু শাস্তি দিয়ে হয়তো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, কিন্তু বিষের উপস্থিতি নির্মূল করার জন্য সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।