চাঁদপুর

ভর্তি ও ফল পরিবর্তনের প্রতারণায় অর্ধশতাধিক ছাত্রীর সর্বনাশ, রিমান্ডে চাঁদপুরের রাফসান

বোর্ড পরীক্ষায় ফল পরিবর্তন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়ায় প্রলোভন দেখান চাঁদপুরের রাফসান চৌধুরী। ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের। ১০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত নেন কাজ করার জন্য।

এছাড়া ওই সময়ে পরিচয়ের সুযোগ নিয়ে অনেক তরুণীকে প্রেমে ফাঁসিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেন প্রতারক রাফসান। গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, এ পর্যন্ত অন্তত ৫০ তরুণীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে রাফসান।

এসব অভিযোগে ১১ মার্চ বৃস্পতিবার খিলগাঁও শান্তিপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর রাফসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে শুক্রবার খিলগাঁও থানায় মাদক ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দু’টি মামলা করেছে ডিবি। এরমধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় দু’দিনের রিমান্ড চলছে তার।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু প্রার্থী। তাদের প্রত্যেকের অভিযোগ প্রায় একই। বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাইয়ে দেয়া ও পরীক্ষার ফল পরিবর্তন করে দেয়ার লোভ দেখানো হয়েছে। আদতে কোনো প্রশ্নপত্র বা ফল পরিবর্তন করে দেয়া হয়নি। বরং সেই সুযোগে ফেসবুক মেসেঞ্জারে চ্যাটিং করা হয়। কৌশলে মোবাইল নম্বর নিয়ে নানা তথ্য, পরামর্শ উপদেশ দেয়া হয়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা হয়।

বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে প্রেমের ফাঁদ তৈরি করে খোলামেলাভাবে ভিডিও কলে আসার অনুরোধ জানায়। ভিডিও কল চলাকালে স্ক্রিন রেকর্ডার দিয়ে সেই দৃশ্য ধারণ করে। পরে সেই ভিডিও ও ছবি ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ভার্চ্যুয়াল সেক্স ও টাকা আদায় করা হতো।

২০২০ সালে এইচএসসি পাস করেন বিথি (ছদ্মনাম)। বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল তাকে মেডিকেলে ভর্তি করার। ফেসবুকে রাফসানের বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেন ব্যাংক কর্মকর্তা বাবা ও স্কুল শিক্ষক মা। পরে বিথির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করেন রাফসান।

ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী জানান, আমার একটা গ্রুপ ছিলো। সেটাতে পোস্ট করেছিলাম পরে সে ওখানে আমাকে নক দেয় এবং ভিডিও কলে কথা হয়। এরপর আমাকে ভর্তির কথা বলে একটা বিকাশ নম্বর দেয় এবং টাকা পাঠাতে বলে।

পরে প্রতারিত হয়ে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে যান অভিভাবক। আবেদন জানান ব্যবস্থা নেয়ার। ২ মাস ধরে তদন্ত করে খোঁজ মেলে রাফসানের। গ্রেপ্তার করা হয় দক্ষিণ গোড়ান থেকে।

রাফসানের বাড়ি চাঁদপুর। ২০০৮ সালে এসএসসি ফেল করেন। এরপর পড়ালেখায় না এগিয়ে, শুরু করেন প্রতারণা। ২০১৬ সাল থেকে নামে-বেনামে ৮-১০টি ফেসবুক গ্রুপ খোলেন। ৩টি ফেসবুক অ্যাকউন্ট থেকে মেডিকেল-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ সব বোর্ড পরীক্ষার ফল পরিবর্তনের বিজ্ঞাপন দেন।

গোয়েন্দারা বলছেন, অনেক শিক্ষিত অভিভাবকও রাফসানের ফাঁদে পা দিয়েছেন। ৫ বছরে ৩ বার গ্রেপ্তার হয়েছে সে। অন্তত ৫০ তরুণীকে ফাঁসিয়েছে সে।

এবিষয়ে ডিএমপি গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ফল পরিবর্তন করা ছাড়াও মাদব ক্রয় বিক্রয়ের সঙ্গেও রাফসান জড়িত। আর এসবের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্যতম বিষয় হলো সে তরুণীদের আপত্তিজনক ছবি ফাঁসের কথা বলে ব্ল্যাকমেইল করে।

ডিবি সূত্র জানায়, রাফসান চৌধুরীর জন্ম চাঁদপুর সদরে। তবে বেড়ে উঠেছে ঢাকার খিলগাঁও এলাকায়। ছোটবেলা থেকে বেপরোয়া কিসিমের জীবনযাপন করতো। ২০০৯ সালে এসএসসি ফেল করার পর থেকে বেপরোয়া জীবনযাপনের জন্য পরিবার থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন ছিল। ২০১৬ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেকবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। ২০১৮ সালের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার একটি মামলায় ৭ মাস জেলে ছিল। এর আগে ২০১৬ সালে সবুজবাগ থানার একটি মামলায় আর এক বছর জেল খেটেছে। রাফসান চৌধুরী ইয়াবা আসক্ত। এই আসক্তি থেকেই সে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। খিলগাঁও, সবুজবাগ, শাহাজানপুরসহ আশেপাশের এলাকার নারীদের কাছে ইয়াবা বিক্রি করতো। নারীরা সহজেই বাইরে থেকে ইয়াবা কিনতে পারতো না। তাই সে নিজেই বেশি টাকার বিনিময়ে বাসায়-বাসায় ইয়াবা পৌঁছে দিতো। গ্রেপ্তারের সময় রাফসানের কাছে ৪০০ পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে। রাফসান ডিবিকে জানিয়েছে, ইয়াবা আসক্তি থেকে তার ইয়াবা ব্যবসার প্রতি আগ্রহ আসে। আর নিয়মিত ইয়াবা সেবনের জন্য তার সব সময় যৌন আকাঙ্ক্ষা থাকতো। যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটাতে গিয়ে ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে সে এমন করতো। ওই শিক্ষার্থীরা ভিডিও কলে আসার পরে বস্ত্রহীন করাতো। এসব দৃশ্যের স্ক্রিন শর্ট রাখতো। আবার স্ক্রিন রেকর্ডার দিয়ে ভিডিও করতো। যখন ইয়াবার নেশায় ধরতো এবং তার কাছে টাকা থাকতো না তখনই রাফসান এসব ভিডিও ও ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা চাইতো। আবার প্রশ্নপত্র দিবে বলে অগ্রিম টাকা নিতো। এছাড়া রাফসান বিভিন্ন মাধ্যম থেকে মানবিক সহযোগিতা চাইছে এমন লেখা বা মানবিক ছবি সংগ্রহ করে রাখতো। এসব ছবি ও লেখা বিশিষ্ট ব্যক্তি বা বিভিন্ন শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে টাকা নিতো।

রাফসান যেসব পেইজ থেকে প্রতারণা করতো সেগুলো হলো- এইচএসসি রেজাল্ট চেইঞ্জ হেল্প লাইন বিডি, দিনাজপুর এডুকেশন বোর্ড রেজাল্ট হেল্প হান্ডেড পার্সেন্ট, এসএসসি-এইচএসসি এডুকেশন বোর্ড রেজাল্ট চেইঞ্জ হেল্প, পিএসসি-জেএসসি-এসএসসি, এইচএসসি, মেডিকেল-ডেন্টাল এডমিশন টেস্ট কুয়েকশন রেজাল্ট হেল্প, এইচএসসি এডুকেশন বোর্ড চ্যালেঞ্জ রেজাল্ট হেল্প লাইন, দিনাজপুর রেজাল্ট হেল্প এডুকেশন বোর্ড হান্ডেড পার্সেন্ট, দিনাজপুর এডুকেশন বোর্ড চ্যালেঞ্জ রেজাল্ট হেল্প, বাংলাদেশ স্টুডেন্টস, এইচএসসি এডুকেশন বোর্ড চ্যালেঞ্জ রেজাল্ট হেল্প লাইন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল এডমিশন টেস্ট কুয়েকশন হেল্প লাইন।

এছাড়া সে বিভিন্ন নামে বেশ কয়েকটি গ্রুপেরও এডমিন। প্রতিটা গ্রুপ ও পেইজে সর্বোচ্চ ২০ হাজার পর্যন্ত সদস্য আছেন। এসব পেইজে এডমিন হিসেবে নাম লেখা থাকতো রচি হোসাইন তানভির বা তানভির হোসাইন রচি। বিজ্ঞাপন হিসেবে লেখা থাকতো- ‘স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল, চাকরি পরীক্ষার জন্য কোনো ধরনের সাহায্য দরকার? সরকারি যেকোনো কাজে যদি কারো সাহায্য লাগে তাহলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। টাকার বিনিময়ে কাজ করে দেয়া হবে। এছাড়া রেজাল্ট পরিবর্তনের বিজ্ঞাপনে লেখা থাকতো পরীক্ষার্থীরা তোমাদের যাদের পরীক্ষা খারাপ হয়েছে বা পরীক্ষায় ফেল হয়েছো, তোমাদের কোনো চিন্তা নেই। আমি বিগত বছরগুলোয় রেজাল্ট পরিবর্তন করে এনে দিয়েছি। তাই যারা রেজাল্ট পরিবর্তন করতে চাও কুইক মেসেজ দাও। সময় কিন্তু আর বেশি নেই। তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করো, যাচাই করে কাজ করাবেন।’

ডিবির গুলশান বিভাগের ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এসএম রেজাউল হক বলেন, রাফসান মাদকসেবী। নিয়মিত মাদক সেবনের টাকার জন্য হন্য হয়ে থাকতো। দিনে তার ২-৩টা ইয়াবা লাগতো। ইয়াবা কেনার টাকার জন্য মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। এক সময় সে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। তার মূল ক্রেতা ছিল নারীরা। যখন সে ইয়াবা সেবন করে তখন তার মধ্যে একটা যৌনাকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। সেটি মেটাতে গিয়েই ওই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল সেক্স করতো। আমরা তার মেসেঞ্জার ঘেঁটে অন্তত হাজারখানেক মেয়ের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে- এমন তথ্য পেয়েছি। অনেক মেয়ের সঙ্গে সে অন্তরঙ্গ ও ভিডিও কলে কথা বলেছে এমন প্রমাণ পেয়েছি। তিনি বলেন, মূলত মাদকের কুফলের কারণে রাফসান এ ধরনের প্রতারণায় যুক্ত হয়েছে। তাই মাদক থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে।

এ ধরণের প্রতারণা থেকে বাঁচতে নিজেদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ঢাকা ব্যুরো চীফ,১৬ মার্চ ২০২১

Share