মিজানুর রহমান রানা | আপডেট: ০৮:১৪ অপরাহ্ণ, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫, শুক্রবার
বাংলাদেশে জালের মতো বিরাজমান নদ-নদীগুলোই ছিলো আমাদের অন্তরাত্মা। আজ সেই নদীগুলোর কোনোটা গেছে শুকিয়ে, হয়েছে বিরাণ মরুভূমি- আর যেগুলো কোনোরকমে বেঁচে আছে, সেগুলো বিষাক্ত বর্জ্যরে অভিশাপ সর্বাঙ্গে বয়ে বেড়াচ্ছে। তেমনিই একটি নদীর নাম বুড়িগঙ্গা। যে নদীটির গর্ভমূলে জমে থাকা বিষাক্ত বর্জ্য সব নদীতেই ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে, ফলে বিপণœ হচ্ছে মানুষের জীবন আর সেই সাথে বিপণন হচ্ছে অতি মূল্যবান ইলিশের রেণু।
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ সুস্বাদু রূপালি ইলিশ। ইলিশ মাছ রপ্তানি করে আমরা প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি। কিন্তু বুড়িগঙ্গা নদীর বিষাক্ত পানি সব নদীতে ছড়িয়ে পড়ার কারণে অন্যান্য নদীগুলোও বুড়িগঙ্গার বিষাক্ত পানি ধারণ করে বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে মানুষের জীবন এবং রূপালি ইলিশের রেণুর মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভরা মৌসুমেও বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো ইলিশশূন্য হওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে।
বুড়িগঙ্গা নদীটি অল্প সময়ে এমন বিষাক্ত আকার ধারণ করেনি। এমন একদিন ছিলো, যখন বুড়িগঙ্গার নির্মল বায়ু সেবন ও এর মনোহর দৃশ্য অবলোকনের জন্যে আশপাশের মানুষ বিকেল-সন্ধ্যায় ছুটে যেতো। আগেরকার সদরঘাট, সোয়ারীঘাট কিংবা বাকল্যান্ডের বাঁধের ধারে ভ্রমণ আর নির্মল বায়ু সেবন এখন অকল্পনীয়। বর্তমানে সদরঘাটসহ নদীর আশপাশে কেউ প্রবেশ করলে নাকে রুমাল গোঁজা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় থাকে না। আজ বুড়িগঙ্গার পানি বিষাক্ত। একদিন হয়তো সেই বিষেই এককালের খরস্রোতা ‘রাজধানীর হৃৎপিণ্ড’ বুড়িগঙ্গা মরে যাবে। সেই সাথে ওই নদীর আশেপাশের মানুষের জীবনপ্রবাহ এবং আমাদের বিখ্যাত রূপালি ইলিশও যাবে চিরতরে হারিয়ে। কারণ, পরিবেশ অধিদফতর ১০ বছর আগেই বুড়িগঙ্গার পানি যে কোনো কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ করে তা’ ব্যবহার অনুপযোগী হিসেবে ঘোষণা করেছে। বুড়িগঙ্গা নদীতে মাত্রাতিরিক্ত পলিথিন, ট্যানারিসহ শিল্প-কারখানার বর্জ্য, হাসপাতাল-ক্লিনিকের পরিত্যক্ত কেমিক্যাল, লঞ্চ-জাহাজের পোড়া তেল-মবিল, টনকে টন বিষ্ঠা বুড়িগঙ্গাকে যেনো একপ্রকার বিষে জর্জরিত করে চলেছে। নিক্ষিপ্ত বর্জ্যরে চাপে এ নদীর স্বাভাবিক জীবনধারা বিনষ্ট, পাড়ের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ, সেই সাথে এ নদীর বর্জ্যযুক্ত পানি ইলিশ মাছকে করতে চিরতরে বিতাড়িত। তাই নদীটিকে বর্জ্যমুক্ত করতে না পারলে রাজধানী ও আশপাশের নাগরিক জীবনেও নেমে আসবে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়। সেই সাথে বুড়িগঙ্গার পানি যে সব নদীতে গিয়ে মিশবে সেসব নদীতে ইলিশ কোনোদিন রেণু ছাড়তে আসবে না। ফলে বাংলাদেশের নদীগুলো হয়ে যাবে রূপালি ইলিশশূন্য। আর আমরা হারাবো আমাদের এ জাতীয় সম্পদ ইলিশকে চিরদিনের জন্যে।
এ ব্যাপারে তাই এখনই যথেষ্ট কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ দরকার। বুড়িগঙ্গা আকারে অনেক বড় না হলেও ৪ শ’ বছরের পুরনো রাজধানী ঢাকার পাদদেশে পানি সিঞ্চন করে ইতিহাসে উজ্জ্বল স্থান করে নিয়েছে। নিকট অতীতেও এ নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে রূপালি ইলিশ আসতো। কিন্তু আজ অবস্থা এমন হয়েছে যে, ইলিশ তো দূরের কথা, ওই পানিতে এখন অন্য কোনো মাছেরই বিচরণ নেই বললেই চলে। কারণ, বিগত সময়ে বুড়িগঙ্গায় জমে থাকা বিষাক্ত বর্জ্যরে জন্যে নদীটি আজ রূপ-রস ও ঐতিহ্য হারিয়ে মরা, আবর্জনার ভাগাড় ও বিষাক্ত নদীতে পরিণত হয়েছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ৪৯টি রুটের প্রায় ১৭৫টির বেশি লঞ্চ, স্টিমার বুড়িগঙ্গা নদীতে ১ দশমিক ৭০ থেকে ২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন টন বর্জ্য ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই পরিমাণ বর্জ্য থেকে টনকে টন রাসায়নিক পদার্থ পলি হিসেবে নদীর তলদেশে জমা হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার তলদেশে প্রায় ১০ ফুট পলিথিনের স্তর জমে গেছে। সাধারণত প্রতি লিটার পানিতে ৬ মিলিগ্রামের নিচে বায়োলজিক্যাল ডিমান্ড (বিওডি) থাকার কথা। বিওডি ৬ মিলিগ্রামের বেশি হয়ে গেলে সেখানে কোনো জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী বেঁচে থাকবে না। ডিও থাকার কথা প্রতি লিটার পানিতে ৪ মিলিগ্রামের ওপরে। এর নিচে নেমে গেলে তা প্রাণীর জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। পরিবেশ অধিদফতর বুড়িগঙ্গা নদীর পানি পরীক্ষা করে দেখেছে প্রতি লিটার পানিতে বিওডি যথাক্রমে ৩৬ দশমিক ২, ১৮ দশমিক ৬, ২২, ২৪, ২৬ দশমিক ২, ২৮ দশমিক ৪, ১২ দশমিক ৮, ৩০, ৪৫, ৩৩ মিলিগ্রাম। এ ছাড়া যেখানে ডিজলভড অপ্টিজেন থাকার কথা প্রতি লিটার পানিতে ৪ মিলিগ্রামের বেশি সেখানে বর্তমানে বুড়িগঙ্গার পানিতে কোনো ডিজলভড অপ্টিজেন নেই বললেই চলে। শুধু চীন মৈত্রী সেতুর কাছের পানি পরীক্ষা করে দশমিক ৮ মিলিগ্রাম অপ্টিজেন পাওয়া গেছে। রিপোর্টে দেখা গেছে, মানব স্বাস্থ্যের জন্যে ভয়াবহ ক্ষতিকর সিসার পরিমাণ পানিতে বেড়ে চলেছে। ফলে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি এখন শুধু মাছের জন্যেই হুমকি স্বরূপ নয়, বরং ওই পানি এখন মানুষের জীবনের জন্যেও হুমকি হয়ে পড়েছে।
প্রতিদিন ১০ হাজার ঘনমিটারের বেশি শিল্পবর্জ্যসহ কাঁচাবাজার, গৃহস্থালি ও হাসপাতালের বর্জ্য, নগরীর সোয়া ১ কোটির বেশি মানুষের পয়ঃবর্জ্য প্রতিদিন ৭ হাজার টনের বেশি বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। এরমধ্যে ৬৩ শতাংশ অপরিশোধিত সলিড বর্জ্য বিভিন্ন সংযোগ খালের মধ্য দিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। এ ছাড়া ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম এমনকি পারদের মতো ক্ষতিকর বিষাক্ত বর্জ্যের ভারে নদীর অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে পরিশোধন করেও এর পানি পান করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আজ বুড়িগঙ্গার এ পানি দূষণ মানুষের জীবনকে যেমন করেছে উদ্বেগপূর্ণ তেমনি, আজ নদীতে বসবাসকারী মূল্যবান ইলিশের রেণুর জন্যেও হয়েছে চরম হুমকি স্বরূপ।
পরিবেশ অধিদফতর, বুয়েট ও ঢাকা ওয়াসার একাধিক জরিপ থেকে জানা যায়, অপরিকল্পিত উপায়ে ২৫ হেক্টর জমির ওপর হাজারীবাগে গড়ে ওঠেছে দু’শতাধিক ট্যানারি। যা থেকে প্রত্যহ বুড়িগঙ্গায় নিক্ষিপ্ত হচ্ছে সাড়ে ৪৭ লাখ মিটার তরল বর্জ্য এবং ৯৫ টন কঠিন বর্জ্য। ট্যানারি বর্জ্য অত্যন্ত বিষাক্ত। এ শিল্প থেকে নির্গত কঠিন বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে লেদার কাটিং, ফ্লেশিং, লোম, চুন ও ক্রোমিয়াম। তরল বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে দ্রবীভূত চুন, হাইড্রোজেন সালফাইড এসিড, ক্রোমিয়াম, তেল ও গ্রিজ জাতীয় পদার্থ। ওই বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক বর্জ্য কোনোরূপ শোধন ছাড়াই সরাসরি নদীতে নিক্ষিপ্ত হওয়ায় পানি ভয়াবহ দূষিত ও বিষাক্ত হয়ে মানুষ ও ইলিশের রেণুর জন্যে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সোয়ারীঘাটের মাছের আড়ত, বাদামতলী ও শ্যামবাজারের ছোট-বড় অনেক ফলের আড়ত এবং নদীর তীরবর্তী অসংখ্য হাট-বাজারের আবর্জনা, পাগলার কাছে বুড়িগঙ্গার উভয় পাড়ে দু’শতাধিক ইটের ভাটার আবর্জনা ও ভাঙা ইটের টুকরায় নদীর পানি দূষণসহ তলদেশ ক্রমশঃ ভরাট হচ্ছে। এ ছাড়াও শ্যামপুর, ফতুল্লাসহ নদীর দু’পাড়ের অসংখ্য বিপণি কেন্দ্র, প্রিন্টিং ডাইং, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বসতবাড়ি, কল-কারখানা, কাঁচা পায়খানা, অসংখ্য নৌযান থেকে নির্গত তেল, মবিল, ডিজেলসহ হাজার হাজার টন দূষিত ও বিষাক্ত আবর্জনা বুড়িগঙ্গার পানিকে বিষিয়ে তুলেছে। এভাবে নানাবিধ দূষণের ফলে বর্তমানে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি এতো কালো বর্ণ ধারণ করেছে যে, স্বাভাবিকভাবে পানির দিকে তাকানো কষ্টকর। ওই পানি গায়ে লাগলে চুলকানি শুরু হয়ে যায়। নদীর দুই পাড়ের মানুষ এ পানি ব্যবহার করার কারণে প্রায় সবাই নানা ধরনের চর্মরোগে ভুগছেন। অনেকের হাতে-পায়ে ঘা হয়ে গেছে। আগে এই নদীতে অনেক ধরনের মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু অতিমাত্রায় বর্জ্য দূষণে বুড়িগঙ্গা এখন মাছশূন্য। সেই সাথে ওই নদীর পানি এখন মানুষসহ যে কোনো জলজপ্রাণীরই বসবাস ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বুড়িগঙ্গার নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি নির্ধারিত এলাকা থেকে বর্জ্য উত্তোলন করে কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল, অর্থ বরাদ্দ, যন্ত্রপাতি ও দক্ষতা না থাকায় তা’ মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায়। বুড়িগঙ্গা দূষণে প্রধান দায়ী হাজারীবাগের ট্যানারি-শিল্প সাভারে স্থানান্তরের উদ্যোগে ভাটা পড়ে গেছে।
আশার কথা, যমুনা থেকে পানি এনে বুড়িগঙ্গা নদীর সব বর্জ্য ফ্ল্যাশ করে মেঘনায় ফেলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী ২০১৩ সালের মধ্যে পুরোপুরি দূষণমুক্ত হবে বুড়িগঙ্গা। সেই সঙ্গে এর প্রবাহ বাড়বে বলেও দাবি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)। ইতিমধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। বুড়িগঙ্গার তলদেশ থেকে পলিথিন তোলা হচ্ছে। সরকার ড্রেজারের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা খনন করে পানির প্রবাহ বাড়াবে। তবে এই ব্যবস্থা নিয়েও কথা ওঠছে সর্বমহলে। কারণ বুড়িগঙ্গা নদীর বর্জ্য ফ্ল্যাশ করে মেঘনায় ফেলে দেয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার তাতে মেঘনাও বুড়িগঙ্গার বর্জ্যরে ভারে দূষিত হয়ে মানুষসহ ইলিশ মাছ ও এর রেণুর জন্যে হবে অত্যন্ত ক্ষতির বিষয়। সুতরাং বিষয়টি ভেবে দেখা অত্যন্ত জরুরি। কারণ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে বুড়িগঙ্গাকে বিষাক্ত বর্জ্যরে ভার থেকে রক্ষা করতে গিয়ে মেঘনাকে যেনো কলুষিত করা না হয়।
মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি ডিমওয়ালা মা ইলিশ থেকে রেণু বা জাটকা হয় ৩ থেকে ১৯ লাখ পর্যন্ত। এটি একটি আশাব্যঞ্জক চিত্র। কিন্তু যদি বুড়িগঙ্গার উপরিবর্ণিত হাল-হকিকত দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে এসব বর্জ্যরে বিষক্রিয়ার প্রভাবে একদিকে যেমন আমাদের রূপালি ইলিশের রেণু প্রসবের জন্যে ডিমওয়ালা মা ইলিশ নদীগুলো বর্জন করবে তেমনি মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারাও হয়ে যাবে বাধাগ্রস্ত। তাই জরুরিভিত্তিতে বুড়িগঙ্গা নদীর বিষাক্ত বর্জ্য হতে মানুষের জীবন ও ইলিশের রেণু রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি।
চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/ এমআরআর/২০১৫