সারাদেশ

বিয়ে করে বউ বিক্রি করেন তিনি!

পোশাককর্মীর সঙ্গে প্রথমে সখ্য গড়ে তোলেন তিনি। এরপর বন্ধুত্ব আর বিশ্বাস অর্জন। পরের ধাপে প্রেম নিবেদন। রাজি না হলে বিয়ের প্রস্তাব। ওই কর্মীর স্বজনদের সঙ্গেও এমন সম্পর্ক স্থাপন করেন যে, স্বজনরা প্রস্তাবে না করেন না।

বিয়ে হলেই ওই পোশাককর্মীর জীবন তাঁর হাতের মুঠোয় চলে আসে। এরপর ওই পোশাককর্মীর জীবনে নেমে আসে দুর্দশা। ভারতে পাচারের শিকার হন। ভারতের কোনো পতিতালয়ে স্থান হয় ওই নারীর। আর এসবের ব্যবস্থা করেন তাঁরই স্বামী!

সম্প্রতি এ রকম একজন পোশাককর্মী ভারতের মুম্বাই শহর থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছেন। মাদারীপুরে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) ক্যাম্পে এসে বিস্তারিত তথ্য দেন তিনি। এরই সূত্র ধরে আনিচ শেখ ও তাঁর মা রেহানা বেগমকে আটক করেছে র‍্যাব। আনিচ শেখ ওই পোশাককর্মীকে বিয়ের পর ভারতে পাচার করে দেন।

মাদারীপুরে র‍্যাব ৮-এর ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মো. রাকিব এ তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানান, মাত্র দুই মাসের পরিচয়ে ঢাকার সাভারের এক গার্মেন্টসকর্মীকে বিয়ে করে ভারতে পাচার করে দেন আনিচ। আনিচ পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত। এ চক্রের সঙ্গে কাজ করেন আনিচের মা রেহানাও।

মেজর রাকিব জানান, এ ধরনের চক্রের ‘টার্গেট’ থাকে গ্রামের এবং গার্মেন্টসে কাজ করা মেয়ে। বিয়ের করার পর মধুচন্দ্রিমার কথা বলে সীমান্ত এলাকায় নিয়ে এরা মেয়েদের পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়।

তিনি আরো জানান, শুধু নারী না, চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে একাধিক দম্পতিকেও ওই চক্র সীমান্তের ওপারে পাচার করে দেয়। অনুপ্রবেশের অভিযোগে স্বামীকে আটকে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। স্ত্রীকে নানা কায়দায় ছাড়িয়ে বিক্রি করে দেয় পতিতালয়ে।

জানা যায়, মুম্বাই থেকে পালিয়ে আসা ওই গার্মেন্টসকর্মী গোপালগঞ্জ জেলার বাসিন্দা। সাভারের একটি গার্মেন্টসে প্রায় দেড় বছর কাজ করেছিলেন তিনি। ওই গার্মেন্টসে মাত্র দুই মাস কাজ নিয়ে আনিচ শেখ মেয়েটির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। প্রায়ই ভাড়া বাসায় গিয়ে মেয়েটির মাসহ স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন।

প্রথমে আনিচ মেয়েটিকে প্রেমের প্রস্তাব দিলে তিনি রাজি হননি। পরে আনিচ দফায় দফায় অনুনয় বিনয় করে মেয়েটির মাসহ স্বজনদের রাজি করান। আনিচের অভিভাবক ছাড়াই এবং কোনো যাচাই বাছাই না করেই ২০১৪ সালে মেয়েটির সঙ্গে আনিচের বিয়ে দেন স্বজনরা।

বিয়ের এক মাস ২০ দিন পর মেয়েটিকে নিজের বাড়ি নড়াইলে নেওয়ার কথা বলে আনিচ তাঁর মা রেহানা বেগমের সহায়তায় ভারতে নিয়ে যান। সেখানে আনিচ সহযোগীদের সাহায্যে মুম্বাইয়ের দালালদের কাছে মেয়েটিকে বিক্রি করে দেন। ছয় মাস ভারতের বিভিন্ন হোটেলে কাটাতে হয় মেয়েটিকে।

এরপর পালিয়ে বাংলাদেশের দিকে চলে আসেন তিনি। দেশে ফিরে র‍্যাবের কাছে অভিযোগ করেন তিনি। গত ১১ আগস্ট আনিচ ও তাঁর মা রেহানাকে আটক করে র‍্যাব। উভয়কে আটক করতে সাহায্য করেন তিনি।

ওই মেয়ের সাহসিকতার কারণে পাচারকারীদের কলাকৌশল সম্পর্কে ধারণা পায় র‍্যাব। র‍্যাব জানায়, আনিচের দলে ভারতীয় সহযোগী ছাড়াও দেশে কালাম সরদার, ইউনুছ শেখ, রাহুল নামের ছদ্মবেশীরা রয়েছে।

ভারত থেকে পালিয়ে আসা মেয়েটির মা বলেন, ‘আমাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে আমার মেয়েকে বিয়ে করে ভারত নিয়ে পতিতালয়ে বিক্রি করেছিল জামাইরূপী ওই নরপশু। ওদের পুরো পরিবারই এই অপকর্মের সাথে জড়িত। আমি ওদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’

ভারত থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতিত মেয়েটি জানান, ওরা এভাবে শুধু স্ত্রীকেই বিক্রি করে না, এই চক্রটি বাংলাদেশ থেকে ভালো বেতনের চাকরির কথা বলে একসঙ্গে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই ভারত নিয়ে যায়। ভারত নেওয়ার পর কৌশলে স্বামীকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে পুলিশে ধরিয়ে দেয় আর স্ত্রীকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়।

মেয়েটি আরো জানান, তাঁর মতো শতাধিক বাংলাদেশি মেয়ে ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়ে বন্দি আছে। এই চক্রটি বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে।

র‍্যাব জানায়, ভারত থেকে ফিরে আসা ওই পোশাককর্মী জানিয়েছেন, কেবল নারী না, চাকরির লোভ দেখিয়ে একাধিক দম্পতিকেও ওই চক্র ভারতে পাচার করেছে। পরে ওই স্বামীর ভাগ্যে জুটেছে জেল, আর স্ত্রীর ঠাঁই হয়েছে পতিতালয়ে। ওই পোশাককর্মীর সঙ্গে পাচারের শিকার হন মোংলার এক দম্পতি।

মোংলার ওই স্ত্রীও দেশে পালিয়ে এসেছেন। তাঁর স্বামী এখনো বন্দি। তিনি জানান, ভালো বেতনের কথা বলে তাঁদের ভারতে নিয়ে যায় ওই চক্র। সেখানে গিয়ে একদিন পরই তাঁর স্বামীকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তাঁকে বিক্রি করে দেওয়া হয় পতিতালয়ে। ছয় মাস পর তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

র‌্যাব-৮ মাদারীপুর ক্যাম্প কমান্ডার মেজর রাকিব বলেন, ‘এই চক্রটির দুই সদস্যকে আটকের পর নারী পাচারের অভিনব পন্থা ও মূল হোতাদের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। এই চক্রটির সদস্যরা দেশের বিভিন্ন গার্মেন্টসে, গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে। এরা প্রথমত মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ির কথা বলে বেনাপোল পার হয়ে বিক্রি করে দেয়।’

মেজর মো. রাকিব আরো বলেন, ‘এরা ভুয়া নাম, পরিচয়ে এই প্রতারণা করে থাকে। এদের পুরো চক্রটি ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ ১১ : ০৩ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সোমবার
এইউ

Share