চারবছর পর আবারও শুরু হয়েছে পৃথিবীনামক গ্রহের সবচেয়ে বড় উৎসবমুখর আয়োজন ফুটবল বিশ^কাপ। বিশ^কাপে খেলছে মাত্র ৩২টি দল, কিন্তু সেই উত্তেজনা ছুঁয়ে যাচ্ছে সারাবিশ^কে।
এমন একটি দেশও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে দেশকে ফুটবল বিশ্বকাপ আলোড়িত করেনি। সেজন্যে বিশ^কাপ শুরুর আগে থেকেই শুরু হয়েছিল ক্ষণ গণনা।
আর ১৪ জুন থেকে শুরু হওয়া ফুটবল বিশ^কাপের উন্মাদনায় এখন কাঁপছে গোটা বিশ^। ফুটবল জ¦রে আক্রান্ত হয়েছে পৃথিবীর কয়েকশ’ কোটি মানুষ। বাংলাদেশেও বিশ^কাপের দমকা হাওয়ায় পতপত উড়ছে সমর্থকদের প্রিয় দলের পতাকা। ঘরে-বাইরে, দোকানে-বাজারে, স্কুলে-ক্লাসে, অফিসে-আড্ডায় সবখানে চলছে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও বিশ্লেষণ।
প্রতিদিনই বিশ^কাপ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় ওঠাচ্ছেন ফুটবলপ্রেমী অসংখ্য মানুষ।
বাংলাদেশে ফুটবল বিশ^কাপ নিয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে উষ্ণ লড়াই। এ দুটি দলের সমর্থকই বাংলাদেশে বেশি।
খেলার বিষয়ে বলতে গেলে দুদলই আপোষহীন ও ঈর্ষাকাতর। সুযোগ পেলেই তারা পরস্পরকে খোঁচা মারার সুযোগটি হাতছাড়া করতে চান না। সামনের ম্যাচগুলোতেও যে এই খুনসুঁটি অব্যাহত থাকবে তা শতভাগ নিশ্চিত। অন্যদিকে ফুটবল জ¦রে শহরে-গ্রামে চলছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল প্রীতি ম্যাচ!
মূলত এ দু দলের সমর্থকরা নিজেরা দল গঠন করে স্থানীয়ভাবে ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করছে। এসব ম্যাচগুলোও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে চলছে সমর্থক দলের পতাকা বানানোর তুমুল প্রতিযোগিতাও। কার দলের পতাকা কত বড়Ñসেটিও দেখার ও দেখানোর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাসা-বাড়ির ছাদে, রাস্তার পাশে, পাড়ার প্রবেশমুখে উড়ছে প্রিয় দলের পতাকা।
কোনো কোনো সমর্থক তার দলের পতাকা দিয়ে তোরণ বানিয়েছেন। কেউ কেউ দলের খেলোয়াড়দের ছবিসহ ব্যানার লাগিয়েছেন জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে। আবার কোনো কোনো সমর্থক পুরো বাড়ির দেয়ালে রঙ করে তৈরি করেছেন আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলের পতাকা। আমাদের ফুটবল উন্মাদনা এতই উপচেপড়া যে, কেউ কেউ জায়গাজমি বিক্রি করেও বিশাল পতাকা বানিয়েছেন। এবারের বিশ^কাপে জার্মানিভক্ত মাগুরার আমজাদ হোসেনের কথাও আমরা জানি।
তিনি জমি বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে জার্মানির পতাকা তৈরি করেছেন। তার সেই পতাকা দেখতে মাগুরায় গিয়েছেন বাংলাদেশস্থ জার্মানি দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ।
তরুণরা স্বাভাবিকভাবেই বিশ^কাপ জ¦রে আক্রান্ত বেশি। প্রিয় দলের জার্সি পরে তারা খেলা দেখতে বসেন। প্রিয়জনকেও উপহার দেন সমর্থন করা দলের জার্সি কিংবা পতাকা। খেলার মাঠে বড় পর্দায় খেলা দেখেন অনেকে। কোনো কোনো দলের সমর্থকরা তাদের দলের ম্যাচের দিন খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও করে থাকেন। প্রিয় দল হারলে তাদের মন খারাপ হয়। আবার জিতলে চলে উল্লাস ও উদ্যাপন। খেলার পরদিন ঘরে ঘরে চলে কে ভালো করলো, কে খারাপ খেললো তার পর্যালোচনা। এসব কিছুর মধ্যে মেসি, রোনালদো, নেইমারের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি তো রয়েছেই। বিশ^কাপের উন্মাদনায় ভুগছে টিভি চ্যানেল, দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকাগুলো।
প্রতিদিনই বিশ^কাপ উপলক্ষে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে থাকছে নানা আয়োজন। কুইজ কনটেস্ট, টকশো, বিনোদন অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিদিনই খেলোয়াড়দের কলাম, বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ প্রকাশ হচ্ছে মিডিয়াতে। বিশ^কাপের উত্তাপে বেশি আক্রান্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। বিশ^কাপ খেলা নিয়ে ভার্চুয়াল এ জগতে মন্তব্য, ট্রল, দলের ছবি, পর্যবেক্ষণ, সমালোচনা দেখছি আমরা। ফেসবুকে ব্যঙ্গ কার্টুন, বিদ্রুপ সম্বলিত ছবিও পোস্ট হচ্ছে অনেক।
ফুটবল বিশ^কাপ বাংলাদেশে যেমন আনন্দ, উৎসব নিয়ে আসে, তেমনি বেদনার ঘটনাও কম নিয়ে আসে না। খেলাকে খেলার মাঠে, খুনসুঁটিতে সীমাবদ্ধ রাখতে পারি না আমরা। তাই বিশ^কাপ উত্তেজনা হানাহানি ও রক্তারক্তিতে রূপ নেয় কখনো কখনো। ১৮ জুন দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘আর্জেন্টিনা সমর্থক দম্পতিকে কোপালো ব্রাজিল সমর্থকরা’। ১৯ জুন দৈনিক যুগান্তরের একটি সংবাদের শিরোনাম : ‘তাড়াশে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের হামলায় আহত ৭ : সেনবাগে সংঘর্ষ’। বিশ^কাপ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই এমন হানাহানির ঘটনা কোথাও না কোথাও ঘটছে। এটি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক বিষয়। এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা কোনো সচেতন মানুষ প্রত্যাশা করে না। এই মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া দরকার।
ফুটবল বিশ^কাপ নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে : কার হাতে উঠছে এবারের বিশ^কাপ? বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলেছে এবার চ্যাম্পিয়ন হবে বেলজিয়াম। ভারতীয় প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ গ্রিনস্টোন লোবো বলেছেন, এবার আর্জেন্টিনার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
পৃথিবী জুড়েই বিশ^কাপ চ্যাম্পিয়ন কে হবে তা নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করা হচ্ছে। যদিও এ প্রশ্নের উত্তরে সমর্থকরা তাদের প্রিয় দলের নামই উপরে রাখছেন। কিন্তু এর সঠিক উত্তর ১৫ জুলাই ফাইনাল হওয়ার পরই পাওয়া যাবে। সে পর্যন্ত বিশ^কাপের উন্মাদনায় আমোদিত হোক বাংলাদেশীরা, উদ্যাপন হোক নির্বিঘ্নে উৎসবে মাতুক ক্রীড়ামোদীরা এই প্রত্যাশা করছি।
লেখক : মুহাম্মদ ফরিদ হাসান,
গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur