গাজীপুরের শ্রীপুরের প্রতিটি অলিগলি যেন তার পরিচিত, এ পথ ধরেই গত ৮ বছর ধরে বাল্যবিয়ে ছুটে চলেছেন ২৫ বছর বয়সী আশিক। সামাজিক সচেতনতায় কাজ করতে গিয়ে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে, হতে হয়েছে শারীরিক নির্যাতনের শিকার। তবুও দমে যাননি তিনি। তার অদম্য প্রচেষ্টা ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় গত এক বছরে উপজেলায় বন্ধ হয়েছে ৪৩টি বাল্যবিয়ে।
গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর এলাকার ১নং ওয়ার্ডের শ্রীপুর গ্রামের ফখরুল ইসলামের ছেলে মেহেদী হাসান আশিক। বাবার দারিদ্র্যতা তার পড়ালেখার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ভাংনাহাটি রহমানিয়া কামিল মাদরাসা থেকে ২০০৯ সালে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় বন্ধ হয়ে যায় পড়ালেখা।
ছোট থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন আশিক। ২০০৮ সালে তার গ্রামে এক কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার হয়, কিশোরীটি শ্বশুড়বাড়ির লোকজনের হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই বাবার সংসারে ফিরে আসে। এ ঘটনা তাকে বেশ পীড়া দেয়। এরপরই আশিক নারী ও শিশু কল্যাণ সমিতি নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে নেমে পড়েন বাল্যবিয়ে বন্ধের কাজে।
২০০৯ সাল থেকে উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে বাল্যবিয়ের খবরাখবর সংগ্রহ করে তা প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা ছিল তার। গত ৯ বছরে তিনি প্রায় সাড়ে পাঁচশ বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজ করেছেন। এছাড়াও তার চোখের আড়ালে যেসব কিশোরীর বাল্যবিয়ে হয়ে যেত তাদের পরিবারকে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে বুঝিয়ে স্বামীর সংসার থেকে পূর্ণাঙ্গ বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত বাবার সংসারে ফিরিয়ে আনা কিশোরীর সংখ্যাও পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। আর এতে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনা আকতার, শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমান, পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর কামরুজ্জামান মন্ডল ও ফাইজুল্লাহ্ সরকার সবচেয়ে বেশি উৎসাহ প্রদান করেছেন।
কথা হলে আশিক জানান, সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে প্রত্যেকটা মানুষের সামাজিক কিছু দায়িত্ব আছে। দারিদ্র্যতার কারণে পড়ালেখা করতে পারিনি, তাই বলে সামাজিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
জীবিকার তাগিদে তাকে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয়। কিন্তু ছুটির দিনসহ কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময় পেলেই বেড়িয়ে পড়েন বাল্যবিয়ে প্রতিরোধসহ সামাজিক সচেতনতায়। স্থানীয় প্রশাসনের সার্বক্ষণিক সহযোগিতায় সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে তিনি শ্রীপুর নারী ও শিশু কল্যাণ সমিতির সদস্যদের সহায়তায় বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে প্রচারণা চালাচ্ছেন। আগে হেঁটে হেঁটে কাজ করলেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে একটি বাইসাইকেল ও একটি মুঠোফোন দেয়ার তার কাজে অন্যরকম গতি এসেছে।
আশিকের বিষয়ে শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমান জানান, আশিক হতদরিদ্র পরিবারের একজন সন্তান হয়েও নিজের জন্য পরিবারের জন্য কিছু না ভেবে শুধু সামাজিক নিরাপত্তা, নারী ও শিশু সুরক্ষায় কাজ করছেন। তিনি সকলের অনুকরণীয়। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে পৌরসভার পক্ষ থেকে তাকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে উৎসাহ প্রদান করা হয়।
শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনা আকতার জানান, বাল্যবিয়ে আমাদের সমাজের একটি ব্যাধি, ধীরে ধীরে আমরা এ ব্যাধি থেকে বেরিয়ে আসছি। বেরিয়ে আসার মূলে রয়েছে সামাজিক প্রচারণা। এ কাজে আশিকের ভূমিকা প্রশংসনীয়। গত এক বছরে আশিকের সহযোগিতায় উপজেলায় ৪৩টির মতো বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ হয়েছে।