Home / চাঁদপুর / বন্ধ হয়ে গেছে চাঁদপুরের ৭ সিনেমা হল
সিনেমা

বন্ধ হয়ে গেছে চাঁদপুরের ৭ সিনেমা হল

একটা সময় দেশের মফস্বল শহরেও সিনেমাপ্রেমী দর্শকের হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকতো পুরো সিনেমা পাড়া। সময়ের কাটা হিসেবে করে দিনরাত চলতো একের পর এক শো। দর্শকের চাপ সামলাতে হলের সামনে সাইনবোর্ডে টানানো হতো ‘হাউসফুল’। এ জন্যই নব্বইয়ের দশক ছিলো বাংলা সিনেমার সোনালী যুগ।

তবে সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে সিনেমার কদর এবং সিনেমা হলের যৌবন-জৌলুশ। নব্বই দশকের শেষ দিকে অশ্লীলতা, নকল আর পাইরেসি দর্শকদের সিনেমা হল ছাড়তে বাধ্য করে।

এরপর গেল এক দশকে সিনেমা শিল্পের উন্নয়নে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিলেও এ শিল্পের সাথে জড়িতদের নানা কারণে মতের অমিল, বয়কট এবং অভিনেতার চেয়ে সমিতির নেতা হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় পর্যাপ্ত ও মানসম্মত সিনেমা নির্মাণ মুখ থুবড়ে পড়ে। যার ফলে মানসম্মত সিনেসা না পাওয়ায় লোকসানের কবলে পড়েছে সিনেমা হলগুলো। এতে করে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের প্রায় অধিকাংশ সিনেমা হল।

এমন সঙ্কটে পিছিয়ে নেই ২৭ লক্ষাধিক মানুষের জেলা চাঁদপুরও। জেলার ৮টি সিনেমা হলের মধ্যে বর্তমানে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে মতলব উপজেলার কাজলী সিনেমা হল। বাকি সবগুলোই গত ১দশক সময়ে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক সিনেমা হলের অস্তিত্বও নেই। সেখানে গড়ে উঠেছে বানিজ্যিক ভবন।

এর মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজারে অবস্থিত কোহিনূর সিনেমা হল এখন ভিঙ্গারী মালের দোকান হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। একের পর এক লসের কারনে করোনাকালীন সময়ে বন্ধ হওয়া সিনেমা হলের নামটিও শেওলা জমে বিলীন হতে বসেছে।

বন্ধ হয়ে যাওয়া একাধিক সিনেমা হলের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাঁদপুর জেলার চিত্রলেখা ও ছায়াবাণী হলই ছিল জেলার দর্শকদের পছন্দের তালিকায়। এসব হলে প্রতি শোতে ৪০০-৫০০ টিকিট বিক্রি হতো। অন্য সিনেমা হলগুলোতে দর্শকসমাগম কিছুটা কম হতো। তবে সেগুলোতেও প্রতি শোতে যথেষ্ট দর্শকের সমাগম ঘটত। এছাড়া মতলব দক্ষিণ উপজেলার রাজমহল ও কাজলী নামে দুটি সিনেমা হলে প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ হাজার দর্শক বিনোদনের সুবিধা পেত। বর্তমানে শুধু ‘কাজলী’ সিনেমা হলটি কোনোমতে টিকে আছে। তবে এখানেও বছরের পর বছর লোকসান গুনছে মালিকপক্ষ।

খোঁজ জানা যায়, প্রায় শত বছর পূর্বে চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজারে ৫২ শতাংশ জায়গার উপর নির্মিত হয় কোহিনূর সিনেমা হল। যা এক সময়ের জেলার জনপ্রিয় সিনেমা হল হিসেবে পরিচিত ছিলো। দর্শকের চাপে হলের সামনে হাউসফুল সাইবোর্ড টানিয়ে দিতে হতো। এক সময়ের জনপ্রিয় সিনেমা হল এখন ভাঙ্গারী ব্যবসায়ীর গোডাউন হিসেবে পড়ে আছে।

এই বেহাল দশা নিয়ে হলের মেশিন অপারেটর কাঞ্চন লস্কর (৩২) জানান, ২০ বছর ধরে কাজ করছি। বর্তমানে হলে সিনেমা দেখার দর্শক একেবারেই কম। আর যে ছবি বের হয়, সেটাই পাইরেসি হয়ে যায়। ফলে হলে দর্শক আসেন না। আর ভালো মানের ছবিও তৈরি হয় না। একটা সিনেমার প্রচার করতে আমাদের ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু সিনেমা হলে দর্শক না আসায় আমরা প্রচারের টাকাই উঠাইতে পারিনা। যার কারণে দীর্ঘদিন আমাদের হলটা লস দিয়ে আসছিল।

বিভিন্ন মানুষ ও ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে হলটা চালু রাখা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে প্রায় ৭০ লক্ষ টাকার অধিক ঋণ হয়ে গেছে। যার কারণে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে হল চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে সরকারি যদি সাহায্য সহযোগিতা করে কিংবা এক কোটি টাকা ঋণ দেয়৷ তাহলে হয় তো ভবনটা ছোট করে নতুন সাজে সজ্জিত করে সিনেমা হলটা চালু করা সম্ভব।

এই সিনেমা হলের আরেক স্টাফ জানান, আমি কোহিনূর সিনেমা হলে ৩৩ বছর চাকরি করেছি। শতবর্ষ পুরনো বছর এই হলটা বন্ধ হয়েছে।আমাদের এই হলটা বন্ধ হওয়ার মূল কারন হচ্ছে বছরের পর বছর মানহীন ছবির কারনে ক্রমাগত লস এ্ং আধুনিক হল নির্মানে ব্যর্থতা। এছাড়াও সিনেমা হলের জীর্ণশীর্ণ অবস্থা, নিম্নমানের অবকাঠামো, মানহীন আসন, সেকেলে আলোকসজ্জ্বা ইত্যাদিও দর্শক বিমুখের অন্যতম কারণ।

কোহিনূর সিনেমা হলের মালিক ও পরিচালক গিয়াস উদ্দিন খোকন জানান, ‘করোনা কালীন সময়ে বন্ধ করেছি। অনেক ঋণে পড়ে গেছি। টাকা মেনেজ হলে আবার চালু করার পরিকল্পনা আছে। তাছাড়া আমরা সহায়তার জন্য সরকারের দিকে চেয়ে আছি।

অভিনয়শিল্পী ও সংগঠক শরীফ চৌধুরী বলেন, ‘আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব ও ভালো চলচ্চিত্র না হওয়ায় সিনেমা হলগুলো বিলুপ্তির পথে। সরকার হলের মালিকদের নানাভাবে প্রণোদনা দিয়ে এই সংস্কৃতিকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। বেসরকারি পর্যায়ের পাশাপাশি সরকারিভাবে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় কম মূল্যে সিনেমা দেখানো গেলে মানুষ হলের দিকে ঝুঁকবে।’

চাঁদপুর জেলা কালচারাল অফিসার আয়াজ মাবুদ চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ‘সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য চাঁদপুর উর্বর স্থান। এখানে সিনেমা হলের সংস্কৃতি বিলুপ্তির বিষয়টি অপ্রত্যাশিত। সরকার এই শিল্পকে রক্ষা ও ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিলে আমরা সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করব। সরকার এই খাতকে গণমুখী করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আধুনিক হল নির্মাণ ও সংস্কারে কেউ এগিয়ে এলে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।’

প্রতিবেদক: আশিক বিন রহিম, ৭ জানুয়ারি ২০২৩