Home / বিশেষ সংবাদ / ক্যাসেটের ফিতায় বন্দি ছিলো শিল্পীদের খ্যাতি ও রুটি-রুজি
ক্যাসেটের ফিতায়

ক্যাসেটের ফিতায় বন্দি ছিলো শিল্পীদের খ্যাতি ও রুটি-রুজি

‘একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে, ফিরবে না সে তো আর কারো আকাশে’ কিশোর কুমারের কণ্ঠের এই গান যেমন শোনা যেত পাড়া-মহল্লা-গ্রামের ঘরে ঘরে, তেমনি ব্যান্ড দল নগরবাউলের ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’ উচ্চারিত হত সারা দেশের তরুণ-যুবাদের মুখে মুখে।

দশকের পর দশক এভাবে শহর থেকে অজপাড়াগাঁয়ে গান ছড়িয়ে পড়ার বড় মাধ্যম ছিল অডিও ক্যাসেট; গানের মধ্য দিয়ে মনের কথা জানান দিতে তরুণ-তরুণীদের পরস্পরকে উপহারের উপকরণও ছিল তা। কালের বিবর্তনে সেই ক্যাসেট এখন বিলুপ্তির পথে।

কম্পিউটারের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ পরিচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অডিও ক্যাসেটের জায়গায় চলে আসে সিডি, এরপর তথ্যপ্রযুক্তির আরও অগ্রগতিতে এখন ইউটিউবের মতো ডিজিটাল মাধ্যম হয়ে উঠেছে গান শোনা ও প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম।

এর ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে অচেনা হয়ে উঠছে দশক আগেও সঙ্গীত আয়োজনের সবচেয়ে বড় মাধ্যমে অডিও ক্যাসেট।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরে লং প্লে রেকর্ড দিয়ে অডিও শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল। মূলত সিনেমার গান এবং ভারতীয় জনপ্রিয় শিল্পীদের রেকর্ডই বিক্রি হত সে সময়। গ্রামোফোন শৌখিন এবং বিত্তবানদের ঘরে শোভা পেত বলেই তখন এদেশে সেভাবে লং প্লে রেকর্ডের প্রকাশনা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সত্তর দশকের শেষ প্রান্তে বিবর্তনের ধারায় আসে অডিও ক্যাসেট। আশি ও নব্বই দশকেই মূলত অডিও প্রকাশনা শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে যায়।

অ্যালবাম প্রকাশের মধ্য দিয়ে কণ্ঠশিল্পীরা পেতে থাকেন তারকাখ্যাতি। নতুন শিল্পী, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালকের আগমন এবং একের পর এক নতুন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। শুরুতে নকলের দাপট, এমপি থ্রি, সিডির আগ্রাসন কিছুটা দমিয়ে দেয় অডিও প্রকাশনার ধারা। এরপর স্বত্বাধিকারী ছাড়াই অনলাইনে যে যার মতো অন্যের গান বা অ্যালবাম প্রকাশ করতে থাকে। হতাশায় পড়ে যান প্রকাশকরা। সবশেষে আশার আলো নিয়ে আসে এই অনলাইনই। নিজ নিজ ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে গান প্রকাশনার সুযোগ পায় সবাই। কিন্তু সেখানে একক গান ও মিউজিক ভিডিও গুরুত্ব পেতে থাকে।

এই বিষয়টি গান নিয়ে সেই উন্মাদনা কমিয়ে দেওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের পরিচিত নাম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেকের কর্ণধার সুলতান মাহমুদ বাবুল।

তিনি বলেন, “গানের কোয়ালিটি আগের চেয়ে অনেক বদলেছে। আগে যেখানে একটা অ্যালবাম ধরে গান বের হত এবং তাতে ১০-১২টা গান একসাথে থাকত, এখন ডিজিটাল মাধ্যমে একবারে একটাই গান প্রচারিত হয়। এটা ব্যবধান গড়ে দিচ্ছে।”

এ বিষয়ে আরেক সঙ্গীত প্রকাশক জি-সিরিজের কর্ণধার নাজমুল হক ভূঁইয়া বলেন, “সাধারণত ম্যাগনেটিক টেপ কিংবা লং প্লে তে গানের আকার স্বাভাবিকভাবে আসল থাকে। মাস্টারিং করার পর সেই আকারটা এমনিতেই কমে আসে। সেখান থেকে যদি এমপি থ্রি করা হয়, সেটা আরও সংকুচিত হয়ে যায়। ফলে গানের যে ডেপথ থাকে সেটা কমে যায়। স্বাভাবিকভাবেই গানটির গুণগত মানে ঘাটতি দেখা দেয়।

“বর্তমানে গানের ডেপথ ধরে রাখার জন্য কোনো মাধ্যম অবশিষ্ট নেই। প্রযুক্তিগত আগ্রাসনে এখন আর গান তৈরি হয় না, এখন শুধু জিঙ্গেল তৈরি হয়। আর যে মাধ্যমগুলোতে আমরা এখন গান শুনি, যেমন মেমোরি কার্ড, ফোন, ইউটিউবে গান শোনার জন্য এটি উপযুক্ত না। কিন্তু আমাদের কাছে বিকল্প কোনো মাধ্যম না থাকায় আমরা বাধ্য হয়েই গান প্রযোজনায় ডিজিটাল মাধ্যমের সাহায্য নিচ্ছি। ইউটিউব চ্যানেল খুলছি।”

আরও পড়ুন- গান গেয়ে আলোচনায় হিরো আলম

সাউন্ডটেক, জি-সিরিজ ছাড়াও লেজার ভিশন, গাঙচিল, সুরঞ্জলী, সঙ্গীতার মতো ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অনলাইনকেই গান প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাদের রয়েছে নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল।

অডিও ক্যাসেট এবং পরবর্তীতে সিডির প্রযোজনা সংস্থা সংগীতার প্রধান নির্বাহী ইমরান রবিন বলেন, “স্টুডিও থেকে গানের রেকর্ড সংগ্রহ করে এক সময় ক্যাসেট তৈরি করে সারা দেশে সেগুলো বাজারজাত করতাম। এখন আগেকার সেই প্রযুক্তি টিকে নেই। ফলে বাধ্য হয়ে আমরাও গান ও অ্যালবাম প্রকাশের ক্ষেত্রে অনলাইন অর্থাৎ ডিজিটাল মাধ্যমকে বেছে নিয়েছি।”

গান প্রকাশ ও প্রচারের বর্তমান প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, “প্রত্যেক শিল্পীরই এখন নিজস্ব রেকর্ডিং স্টুডিও আছে। সেখান থেকে গান রেকর্ড করে তারা আমাদের দেন। আবার গানগুলোর মিউজিক ভিডিও তৈরি করেন ভিডিও ডিরেকটররা। আমাদের ব্যানারে তৈরি হওয়া গানগুলো আমাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করা হয়।”

অডিও ক্যাসেটের একচ্ছত্র আধিপত্যের সময় বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে বেশ কয়েকজন কণ্ঠশিল্পীর আবির্ভাব ঘটে। একের পর এক গানের অ্যালবাম বের হওয়ায় তাদের সঙ্গীতের ক্যারিয়ার ছিল তুঙ্গে। ব্যান্ডের গানের পাশাপাশি উন্মাদনা ছিল বেশ কয়েকজন সঙ্গীতশিল্পীকে ঘিরে। এন্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, মনির খান, কনক চাঁপা, আসিফ আকবরসহ অনেকের গানের অ্যালবাম তখন জায়গা দখল করে নেয় ঘরে ঘরে থাকা ক্যাসেট প্লেয়ারগুলোতে।

২০০১ সালে ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি অ্যালবাম দেশজুড়ে পরিচিতি এনে দেয় সঙ্গীতশিল্পী আসিফ আকবরকে। এই অ্যালবামের ‘টাইটেল সংয়ে’ বাজিমাত করেন তিনি, সে সময় ঢাকা শহরের অলি-গলি ও মোড়গুলোতে অডিও-সিডির দোকানগুলোতে তার এই গান বাজতে শোনা যায়।

গান প্রকাশের মাধ্যমের পরিবর্তন নিয়ে আসিফ বলেন, “ক্যাসেটের ক্ষেত্রে যে উন্মাদনা ছিল শ্রোতার, এখন আর সেইটা নেই এবং তা বিরূপ প্রভাব ফেলছে শিল্পীদের উপর। আগে ভালো শিল্পীদের গানের যে কদর ছিল, এখনকার সময়ে সেটা আর নেই। সৈয়দ আবদুল হাদীর ‘চোখের নজর এমনি কইরা’ গানটি চির অমর গান হওয়া সত্ত্বেও অনলাইনে ভিউ এখন ৫০ হাজারের কাছাকাছি মাত্র৷ যেখানে অন্যান্য যে কোনো মানহীন গানের ভিউ আরও কয়েক গুণ বেশি।
“এছাড়া শিল্পীদের অর্থনৈতিক প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। আগে একজন শিল্পীর ১০ থেকে ১২টা গানের একটা অ্যালবাম বের হলে তা থেকে একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকা আসত, ক্যাসেটের রিপ্রোডাকশন হত। ফলে শিল্পীরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হত। কিন্তু এখন একই সময়ে একটা মাত্র গান অনলাইনে বের করা যায়।”

আসিফ বলেন, “সবচেয়ে বড় কথা হল ভার্চুয়াল মাধ্যমে রূপান্তরিত হওয়ার মতো যথেষ্ট স্মার্ট আমরা হইনি। আগে একটা কোম্পানির মাধ্যমে অ্যালবাম বের করা হলে একটা মানসম্পন্ন কাজ দিতে হত। আর এখন যার খুশি যখন খুশি গান গেয়ে ডিজটাল প্ল্যাটফর্মে প্রচার করছে, যার বেশিরভাগই মানহীন।”

তিনি বলেন, “আগেকার দিনের বড় বড় গানের স্টুডিওর বদলে শিল্পীদের হোম স্টুডিও চালু হওয়ায় শিল্পী এবং গানের পেছনে যারা শ্রম দিচ্ছেন তাদের মধ্যকার যোগাযোগটা কমে গেছে। আগে একসাথে আড্ডা দিয়েও অনেক কিছু শেখা যেত।

“ভালো গান হচ্ছে না, তা বলা যাবে না। কিন্তু যেই ঘরানার গানের দিকে শ্রোতার আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে সেগুলোর কারণে ভালো শিল্পীদের ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়ে গেছে।”

আরও পড়ুন- চাঁদপুরে নজরুল গবেষণা পরিষদ’র উদ্যোগে সূচনা সভা অনুষ্ঠিত