দুই পা স্ক্রাচে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। তবুও জীবনযুদ্ধে লড়ছেন কৃষক বিল্লাল হোসেন গাজী। তিনি চাঁদপুর ফরিদগঞ্জের উপজেলার বালিথুবা পশ্চিম ইউনিয়নের মদনেরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা।
প্রায় এক যুগ আগে চর এলাকায় ধান রোপণের কাজে গিয়ে ভাঙা শামুক পায়ে ঢুকে যায়। ধীরে ধীরে ক্ষতস্থানে পচন ধরে। কিছুদিন পর কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন বিল্লাল। দুই বছর চিকিৎসা নিয়েও কোনো উন্নতি হয়নি। বাধ্য হয়ে বিল্লাল চিকিৎসকের পরামর্শে দুটি পায়ের কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়।
চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে তার। এক পর্যায়ে ঘরের পাশে সামান্য একটু জায়গায় স্বল্প পরিসরে কৃষি আবাদ শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে আবাদি জমির পরিমাণ বাড়িয়েছেন। সেই কাজেই এখন স্বচ্ছল বিল্লাল। তিনি দুই একর জমিতে বর্গাচাষ করছেন। জীবন সংগ্রামে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সাহস ও সহযোগিতা করছেন তার স্ত্রী আমেনা বেগম।

স্ত্রীর সহযোগিতায় জমিগুলোতে মৌসুমি নানা জাতের সবজি আবাদ করেন বিল্লাল। যার মধ্যে রয়েছে- টমেটো, ফুলকপি, আলু, শাক, মুলা, আখসহ নানা মৌসুমি শস্য। বর্তমানে তিনি আখ, টমেটো ও আলু চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
স্ত্রী, ৪ ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে জাহাঙ্গীর গাজী (৩০) ঢাকায় মাছের ব্যবসা করেন। তৃতীয় ছেলে আখের গাজী (২৫) ঢাকায় একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। অন্য দুই ছেলে জাকির গাজী (২৭) ও হোসেন গাজী (২১) এলাকায় মোটর মেকানিকের দোকানে কাজ করেন। একমাত্র মেয়ে ফাতেমা আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন।
বিল্লাল গাজী জানান, চিকিৎসা শেষে যখন বাড়িতে ফিরে আসেন তখন সংসার চালাতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কারণ ছেলেরা তখন ছোট। তাছাড়া ছেলেরা কাজ করে কতদিন চালাবে তাকে। তাই এই চিন্তা থেকে নিজে কিছু করে সংসার চালানো শুরু করেন তিনি। কিন্তু টাকার অভাবে কোনো দোকান দিতে না পারায় কৃষিকাজের কথা চিন্তা করেন তিনি।
এরপর মানুষের জমি বর্গা নিয়ে সেই জমিতে চাষাবাদ শুরু করেন। এভাবেই কাটিয়ে দিয়েছেন ১২ বছর। কৃষি কাজ করে সংসারের পাশাপাশি নিজের খরচ চালাতে পারছেন সেটাই তার কাছে বড় বিষয়।
তিনি বলেন, ছেলেদের ওপর নির্ভর থাকলে এক সময় তাদের কাছে বোঝা হয়ে যেতাম। তাদের এখন সংসার হয়েছে, খরচ বেড়েছে। সেখানে যদি আমিও যোগ হতাম, তাহলে এক সময় তারা বিরক্ত হয়ে যেত। তাই এসব চিন্তা করে নিজে নিজেই কৃষি কাজ করে সংসারের হাল ধরেছি।
স্থানীয়রা জানান, বিল্লাল প্রতিবন্ধী হলেও কখনও ভিক্ষাবৃত্তি বা কারও কাছে হাত পাতেননি। যা করছেন তা নিজের মনের জোরেই করছেন। আমরা উনার পরিশ্রমকে সম্মান করি। তবে উনি যদি সরকারের একটু সহযোগিতা পান তাহলে আরেকটু ভালোভাবে চলতে পারবেন।
প্রতিবন্ধী বিল্লাল গাজী বলেন, ‘আমি কোনো প্রতিবন্ধী ভাতা পাই না। পেলে একটু উপকার হত। সরকার যদি আমারে একটু সহযোগিতা করে, আমি প্রতিবন্ধী হয়েও ভালোভাবে চলতে পারব।’
বালিথুবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শফিকুর রহমান চাঁদপুর টাাইমসকে বলেন, ‘বিল্লালের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ভবিষ্যতে যদি কোনো সহায়তা লাগে আমি তাকে সহযোগিতা করব।’
এ বিষয়ে কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক পাটওয়ারী সংবাদ কর্মীর কাছ থেকে কৃষক বিল্লাল সম্পর্কে জানার জন্য মোবাইলে কল করেন।
অথচ জনাব পাটওয়ারী ঐ ব্লকের দায়িত্বে কর্তব্যরত আছেন। তিনি যে ব্লকের দায়িত্বে আছেন, সে ব্লকে কতজন কৃষক ও কৃষি পরিবার আছেন, তা জানার কথা নয় কি?
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আশিক জামিল মাহমুদ চাঁদপুর টাাইমসকে বলেন, আমরা কৃষিকাজে কৃষকদের সব ধরনের সহায়তা করে থাকি। তবে উনার বিষয়টি আমার জানা নেই। যেহেতু তিনি প্রতিবন্ধী তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। প্রয়োজনে তাকে কৃষি ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সুপারিশ করব।

এ বিষয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কর্মরত প্রতিষ্ঠান চাঁদপুর-ডিপিওডি এর পরিচালক মমতাজ উদ্দিন চাঁদপুর টাাইমসকে বলেন, ফরিদগঞ্জ উপজেলায় কৃষক প্রতিবন্ধিদের তালিকা তৈরী করার জন্য বার বার বলা হলেও এই পর্যন্ত কৃষি অফিস থেকে কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রতিবন্ধি কৃষক বিল্লালের বিষয়ে বলেন, বিল্লালকে সুদমুক্ত ঋন দেয়ার জন্য সমাজসেবা অফিসে সিন্ধান্ত সম্বলিত কাগজে স্বাক্ষর করি। আশা করবো প্রত্যেক বিভাগ কর্তৃক প্রতিবন্ধিদের অগ্রাধিকার কর্মসূচী গ্রহন করা হয়, তবেই সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন সফল হবে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিউলি হরি চাঁদপুর টাাইমসকে বলেন, উল্লেখিত কৃষক সম্পর্কে আমি অবগত নই, তিনি যেহেতু কৃষি কাজ করে, সে ক্ষেত্রে কৃষি অফিসারের সাথে আলাপ করে তার সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং তিনি ভাতা না পেলে, পাওয়ার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিবেদক:শিমুল হাছান,১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur