গত ২০২২ সালে ফরিদগঞ্জে পানিতে ডুবে ২২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় বাংলাদেশে।
এমনকি রোগে ভুগে মৃত্যুর চেয়ে দেশটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হারই বেশি বলে মনে করেন গবেষকরা। ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’র তথ্যে মতে ২০২২ সালে পানিতে পড়ার পর হাসপাতালে এনেছে এমন শিশুর সংখ্যা ৩১ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২২শিশুর।
স্বেচ্ছাসেকমূলক সংগঠন শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে বাংলাদেশে পানিতে ডুবে এক হাজার ৬৭১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পানিতে ডুবে বেশি শিশুর মৃত্যু ঘটে এশিয়াতেই, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়। বাংলাদেশে পানিতে ডুবে দিনে গড়ে ৪০টি শিশু মারা যাচ্ছে। ব্লুমবার্গ ফিলান থ্রপিস, জন হপকিন্স ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরিরিসার্চ ইউনিট, দি সেন্টার ফর ইনজুরিপ্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাসি.আই.পি.আর. বি এবং আই.সি.ডি.ডি.আর.বি’র এক গবেষণায় এই তথ্য বের হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান বলছেন, প্রতিবেশী ভারতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় বেশি হলে ও জনসংখ্যার অনুপাতে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু হার বাংলাদেশেই বেশি। তিনি আরো বলেন, ‘সবাইবলেনিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি মারা যায়; কিন্তু আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। কিন্তু এটারিপোর্ট হয়না। পুলিশের খাতায়ও এদের সংখ্যা থাকেনা।’
হেলথ ও ইনজুরিসার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, ইনজুরি বা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যু। যা মোট মৃত্যুর ১১.৭ শতাংশ। তবে এটি সব বয়সী মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপের তথ্য। সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারায় মানুষ আত্মহত্যা (১৪.৭ শতাংশ) করে। প্রতিবছর এ ধরণের বারটিইনজুরি থেকে মৃত্যুর সংখ্যা দেশে বছরে এক লাখেরও বেশি। অর্থাৎ যত মানুষ দেশে মারা যায় তার ১২ শতাংশ ইনজুরি জনিত কারণে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’র তথ্য মতে ২০২২ সালে হাসপাতালে পানিতে পড়া শিশু এসেছে ৩১ জন। এদের মধ্যে ২০ জনই মারা গেছে। উপজেলায় গত বছর যে সব শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ৭ এপ্রিল, উপজেলার ১৫নং রূপসা উত্তরন ইউনিয়নের গাব্দেরগাঁও গ্রামে সুমাইয়া নামের ৮ বছর বয়সের শিশু সকাল ১১টার দিকে খেলতে খেলতে পুকুরে পড়ে মারা যায়। ১ আগস্ট, উপজেলার ৯নং গোবিন্দপুর উত্তর ইউনিয়নে মো.সালমান নামের দেঢ় বছরের এক শিশু খেলতে খেলতে পুকুরের পানিতে পড়ে যায়। পুকুরের পানিতে ডুবে তার মৃত্যু হয়। ১২নভেম্বর, উপজেলার গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নের আনিছ হোসেন (২) ও একই ইউনিয়নের হোগলী গ্রামের নূর মোহাম্মদ (২) সকালের দিকে খেলতে খেলতে পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায়। ২৭ ডিসেম্বর, উপজেলার ১৪নং ফরিদগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়নের চরবড়ালী গ্রামের মামুন ভূঁইয়ার দেড় বছরের মেয়ে মারিয়া পানিতে ডুবে মারা যায়।
সংবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যুর অধিকাংশ সময় সকাল ১০ টা থেকে ১টার মধ্যে। এবং যে শিশু মারা গেছে তাদের বসতির পাশেই পুকুর অথবা ডোবা রয়েছে। মূলত দেখ-ভাল করার অভাবেই এই মৃত্যু গুলো হয়েছে। যে সময়টা শিশু পানিতে পড়ছে ঐ সময়টায় মায়েরা ব্যস্ত থাকেন রান্না বান্নার কাজে, বাবারা কাজে ঘরের বাহিরে এবং বড় ভাই-বোন (যদি থাকে) তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকে।
বুদ্ধি বৃত্তিক এবং শিশুদের নিয়ে কাজ করা ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম’র বর্তমান কমিটির সভাপতি কবি‘পাভেল আল ইমরান এ বিষয়ে বলেন, সবার আগে প্রয়োজন বাচ্চাদের প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া। সেই সাথে থাকতে হবে প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান, যাতে তাৎক্ষনিক প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় হাসপাতালে নিতে নিতে বাচ্চা মারা যায়। অথচ আমরা যদি পানি থেকে উঠিয়েই হার্ট ও শ্বাস-প্রশ্বাস চালুর প্রাথমিক চেষ্টা করি, তাহলে বাচ্চা বেঁচেও যেতে পারে।’
তিনি আরো বলেন,‘অনেক ক্ষেত্রে ডুবে যাওয়া শিশুকে কী করাহবেবা ফার্স্ট রেসপন্স সম্পর্কে প্রশিক্ষিত ব্যক্তির অভাব রয়েছে। পানিতে পড়ে ডুবে মারা যাওয়া দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারি এবং এনজিও প্রতিষ্ঠান গুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। কিছু সু-নির্দিষ্ট কাজ করতে হবে। যেমন- কমিউনিটি সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সেই সাথে শিশুকে পানি থেকে উদ্ধার করে তার শ্বাস ও হার্ট চালু করার যেসব প্রাথমিক কাজ আছে সেগুলো মানুষকে শেখাতে হবে।’
হাসপাতালে আনতে আনতে অনেকেই বাঁচেনা। তাই যারা উদ্ধার করেন তাদের যদি প্রাথমিক ওই জ্ঞান থাকে তাহলে অনেক শিশুই বেঁচে যাবে। যে সংসারে মা-বাবা দু’জনই চাকরিজীবি তাদের শিশুদের জন্য ‘ডে কেয়ারের’ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা সরকারি ভাবে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ও হতে পারে আবার বেসকারি উদ্যোগে ও হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, বুদ্ধি-ভিত্তিক বিকাশ ত্বরান্বিত করার ব্যবস্থা থাকা জরুরী।’
ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’র মেডিকেল অফিসার ডা. মোজ্জামেল পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর জন্য কয়েকটি রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে বলেন- সবচেয়ে বিপজ্জনক পুকুর (৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা পুকুরেই হয়ে, যেটি একেবারেই বাড়ির পাশে থাকে)। এছাড়া খাল, বিল, ডোবাতো আছেই। বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সাঁতার না জানা। তাৎক্ষনিক প্রাথমিক চিকিৎসাজ্ঞান না থাকা। তারপরে, আধুনিক যুগে এসেও আমাদের সমাজে কিছু কুসংস্কার রয়ে গেছে।’
পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘৫ বছরের নীচের শিশুদের সঠিক তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। ৫ বছরের বেশি বয়সীদের সঁাতার শেখাতে হবে।’
প্রতিবেদক: শিমুল হাছান, ১১ এপ্রিল ২০২৩
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur