মাদক যেমন আমাদের সমাজে বিস্তার লাভ করে চলছে, ঠিক তেমনি বিভিন্নরকম খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত ফরমালিনের অপব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে প্রতিময়মান হচ্ছে।
২২ জুলাই চাঁদপুর বিপনিবাগ মাছ বাজার সংলগ্ন সন্ধ্যায় জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০১৬ উপলক্ষে জেলা মৎস্য অফিস কর্তৃক আয়োজিত ফরমালিনের ওপর একেটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শন হয়েছিল যা দেখে কেউ বিস্মিত না হয়ে পারবেন না।
অনুষ্ঠান শেষে ফরমালিন সম্পর্কে আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ।এক কথায় বলা য়ায় ফরমালিনের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
ইতিমধ্যেই আমাদের দেশে ইভটিজিং ও মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিটি মানুষ সচেতনতার পরিচয় দিয়ে তা’ প্রতিহত করতে এগিয়ে আসছে। তাই ইভটিজিং ও মাদকবিরোধী আন্দোলনের মতো ফরমালিনের বিরুদ্ধেও আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। তা-না হলে খুব সহসাই এর বিরূপ প্রভাবে আমাদের জাতীয় জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পরে অচল করে দিবে আমাদের দৈহিক ক্ষমতা।
বিষাক্ত ফরমালিনের যাচ্ছেতাই অপব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য এখন মারাত্মক হুমকি। চিকিৎসা ও মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, ফরমালিন একটি বর্ণহীন মিথানল গ্যাসের জলীয় বাষ্প। এটি দাহ্য ও তীব্র গন্ধযুক্ত একটি রাসায়নিক পদার্থ। যা আমাদের দেশে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীগণ সু-স্বাদু মাছে, ফলে, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন প্রকার তরিতরকারিতে ফরমালিন ব্যবহার করে আমাদের নিরাপদ ও খেয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন সেই খাদ্যে কৃত্রিমভাবে মিশিয়ে জনস্বাস্থ্যের হুমকিতে ঠেলে দিচ্ছে।
ফরমালিনের সৃষ্টি মানবজাতির কল্যাণের জন্যই। অপব্যবহার করেই একে অকল্যাণের দিকে ধাবিত করা হচ্ছে। স্বজ্ঞানে ও স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে এখন আমাদের চুপ করে বসে থাকা উচিত নয়। যতদূর জানা গেছে, ফরমালিনের সাহায্যে ঔষধ,এন্ট্রিবায়োটিক, ডিটারজেন্ট তৈরি, গবেষণাগারে পচনশীল নমুনা সংরক্ষণে,স্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরির জীবজন্তুতে মিশিয়ে সংরক্ষণের জন্য একদেশ থেকে অন্যদেশে মৃত লাশের পরিবহন ইত্যাদিতে এ ফরমালিন ব্যবহারে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
কিন্তু আমাদের দেশে একশ্রেণির উৎপাদিত দেশীয় মাছ, ফল, দুধ, শাকসবজি ও তরিতরকারিতে দীর্ঘ সময় পচনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে একশ্রেণির মুনাফাখোর ব্যবসায়ীগণ পানির সাথে ফরমালিন মিশিয়ে কিংবা ইনজেকশন সিরিজে মাছ বা ফলের ভেতর প্রবেশ করিয়ে তা’ ব্যবহার করছে।
আমরা অজ্ঞাতবশতঃ এসব কিনে খাচ্ছি। এসব খাবার খেয়ে মানুষ তাৎক্ষণিক কিছু বুঝতে পারছে না।এ ছাড়াও বাজারের মাছে, ফলে, দুধে কিংবা ফলমূলে ফরমালিন মেশানোর ফলে কী ধরনের লক্ষণ ফুটে উঠে- তা’ সাধারণ মানুষ এখনো বুঝে উঠেনি।
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের সম্মেলন কেন্দ্রে মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণে ফরমালিনের অপব্যবহার রোধে জেলায় প্রথম একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এর অপব্যবহার সম্পর্কে বেশ কয়েকজন মৎস্য বিজ্ঞানী ও গবেষক বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
এ ছাড়াও ফরমালিনের অপব্যবহার সম্পর্কে একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শনী হয়। যা আমি নিজেও উপস্থিত থেকে প্রত্যক্ষ করেছি।
ফরমালিনের অপব্যবহারে মানবদেহে কী ধরণের প্রভাব পড়তে পারে এর চিত্র বিভিন্ন বক্তাদের আলোচনা ও কর্মপত্রের মাধ্যমে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়েছে। ফরমালিন শুধুমাত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গবেষণাগার, পচনশীল নমুনা সংরক্ষণ, লাশ, গাম তৈরি, প্রাকৃতিক রং, নেলপালিম,এন্টিবায়টিক ঔষধ,বাতাস জীবাণুমুক্তকরণ, পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ, মুরগীর বাচ্চা উৎপাদন,মৎস্য ও চিংড়ী হ্যাচারিতে জীবাণু মুক্তকরণ এবং হাসপাতালের সংক্রামক এলাকা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে বিভিন্ন যানবাহনে মৃত লাশ পরিবহনের সময় কেবলমাত্র ফরমালিন ব্যবহার প্রয়োজন।
অথচ কোনো কোনো ফল, মৎস্য ও তরকারি ব্যবসায়ী এ ফরমালিন মিশিয়ে আমাদের জীবনকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। একটি সভ্য সমাজে এসব অন্যায় কোনোমতেই চলতে দেয়া যেতে পারে না। যে ফল খেয়ে হাসপাতালের রোগীদের বাঁচিয়ে রাখা হয়, সে ফলে ওই মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা ফরমালিন মিশিয়ে রোগীদের জীবন বিপন্ন করে দিচ্ছে।
যে মাছ আমাদের আমিষের চাহিদা মিটায় ও আমাদের দেহকে সতেজ ও সুস্থ রাখছে সে মাছে তারা ফরমালিন নামক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে মানব দেহকে শেষ করে দিচ্ছে। এর কি কোনো প্রতিকার হতে পারে না? মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, ফরমালিন চোখের রেটিনাকে আক্রান্ত করে রেটিনার কোষ ধ্বংশ করে, তাৎক্ষণিকভাবে পেটের পীড়া, হাঁচি-কাঁশি, শ্বাসকষ্ট, বদহজম, ডায়রিয়া, আলসার, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন সর্ব কিছুকেই ধ্বংস করে দেয়।
ফরমালিনমুক্ত খাদ্য গ্রহণ করার ফলে পাকস্থলী, ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে ক্যান্সার হতে পারে। অস্থিমজ্জা আক্রান্ত হওয়ার ফলে রক্তশূন্যতাসহ অন্যান্য রক্তের রোগ, এমনকি ব্লাড ক্ল্যান্সারও হতে পারে। এতে মৃত্যু অনিবার্য।
ফরমালিন ও অন্যান্য ক্যামিকেল সামগ্রী সব বয়সী মানুষের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে। ফরমালিনযুক্ত দুধ, মাছ, ফলমূল এবং বিষাক্ত খাবার খেয়ে দিন দিন শিশুদের শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ নষ্ট, বিকলাঙ্গতা, এমনকি মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ। সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা, বাচ্চার জন্মগত দোষত্রুটি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানুষের জন্য সবচাইতে ক্ষতিকর যে সকল রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে এর মধ্যে ফরমালিন একটি।
তাই এর বিরুদ্ধে এখনি রূখে দাঁড়াতে হবে। এর বিস্তার রোধে ব্যাপক হারে গণসচেতনতা বোধ সৃষ্টি করে অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। গণমাধ্যমগুলোতে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রচার প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে সজাগ করতে হবে।
পৃথিবীর সকল রাসায়নিক দ্রব্য মান নিয়ন্ত্রণকারী এজেন্সী ফরমালিনের অপব্যবহারকে মারাত্মক ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই ব্যাপক হারে ফরমালিন মেশানোর বিরূপ বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে হবে। প্রত্যেক সচেতন মানুষকে নিজ নিজ উদ্যোগে ফরমালিনযুক্ত খাবার খেতে বা ক্রয় করা বর্জন ও পাশাপাশি ফরমালিনযুক্ত সকল প্রকার খাদ্যের লক্ষণসমূহ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হবে।
সরকার ফরমালিনের অপব্যবহার বন্ধে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ- ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা বিধান রেখে আইন করার প্রস্তাবে ৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘ফরমালিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩’ এর খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়।
সরকারকে এ আইন প্রস্তাবে স্বাগত জানাই। শুধু আইন নয় আত্মসচেতনতা এখানে বড় ব্যাপার। তাই আসুন আজই আমাদের চাঁদপুরে মাদকবিরোধী আন্দোলনের মতো ফরমালিনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।