প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও চাল, তেলসহ ত্রাণ চুরি থামছেই না।
আগে বারবার বলার পর প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবারও ১৬ এপ্রিল ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করার সময় বলেছেন, চাল চোরদের ছাড়া হবে না। এদের শাস্তি পেতেই হবে।
এছাড়া আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ কেন্দ্রীয় অনেক নেতা ত্রাণ চুরির বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তারপরও করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দুস্থ, অসহায় ও হতদরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ এ ত্রাণ চুরি সরকারের উচ্চপর্যায়ে তৈরি করেছে অস্বস্তি। এই চুরিতে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই জড়িত থাকার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে বিধায় কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে বেশ ক্ষুব্ধও।
বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবারও সিরাজগঞ্জে দিনভর পৃথক চারটি অভিযানে হতদরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ করা ৬০ বস্তা সরকারি চাল জব্দ করা হয়। এসব ঘটনায় একজন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্যসহ তিনজনকে আটক করা হয়। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সদর উপজেলার বাগবাটি ইউনিয়নের গাড়ীদহ ও নান্দিনা এবং খোকশাবাড়ী ইউনিয়নের চন্দ্রকোনা এলাকায় এসব অভিযান চালানো হয়। এ সময় হাসিনুরের ছেলে রাজুকে (৩২) আটক করা হয়। পরে একই গ্রামের আকবর আলীর (৫০) বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১১ বস্তা সরকারি চাল উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে তাকেও আটক করা হয়। এর আগে রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাগবাটি ইউনিয়নের নান্দিনা গ্রামে ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য আছিয়া খাতুনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১৬ বস্তা চাল উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিন বিকেলে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজি দরের ১৮ বস্তা চাল উদ্ধার করে পুলিশ। উপজেলার সাপমারা ইউনিয়নের কোগাড়িয়া গ্রাম থেকে চালগুলো উদ্ধারের সময় দুজনকে আটক করা হয়। ওই দুজন হলেন- খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ১০ টাকা কেজি দরের চালের ডিলার জাহিদুল ইসলাম (৪৫) ও উপজেলার কাটাবাড়ী ইউনিয়নের পলুপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক জাহিদুল ইসলাম (৪২)।
একই দিন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় ২৮ বস্তা ত্রাণের চালসহ দুই ইজিবাইক চালককে আটক করে পুলিশ। বিকেলে পাচারের সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এ ত্রাণের চাল উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে নবীগঞ্জে যুবলীগ নেতা নোমান হোসেনের গোডাউন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অবৈধভাবে মজুদ রাখা বিপুল পরিমাণ টিসিবির পণ্য উদ্ধার করা হয়। এ সময় অবৈধ ভারতীয় সিগারেটও জব্দ করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ঘটনায় যুবলীগ নেতা নোমান হোসেনের ছোট ভাইসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়। পণ্যগুলোর মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার আলীগঞ্জ বাজারের গোডাউন থেকে টিসিবি ৭৩ বস্তা চিনি, ১৯৬ বোতল সয়াবিন তেল, চিনি পরিবর্তন করা ৬ বস্তা ও চিনির ৯টি খালি বস্তা উদ্ধার করা হয়।
একইভাবে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থেকে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজি দরের ৫০ বস্তা চাল, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে টিসিবির ৭৬ বস্তা চিনি ও ১৯৬ বোতল সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হয়। এতে জড়িত ব্যক্তিকে আটকও করা হয়।
যদিও ইতোমধ্যে চাল চুরির অপরাধে বরখাস্ত করা হয়েছে চার ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ও পাঁচ ইউপি সদস্যকে (মেম্বার)। সাময়িক বরখাস্তকৃত চেয়ারম্যানরা হলেন- পাবনার বেড়া উপজেলার ঢালারচর ইউনিয়ন পরিষদের মো. কোরবান আলী, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার পাঙ্গাসীর ইউনিয়নের মো. আব্দুস সালাম, বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া ইউনিয়নের মো. আলাউদ্দিন পল্টু, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আন্দারমানিক ইউনিয়নের কাজী শহিদুল ইসলাম।
সাময়িক বরখাস্তকৃত ইউপি সদস্যরা হলেন- কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার সুবিল ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. আব্দুল মান্নান মোল্লা, ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার নয়নশ্রী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. সেকান্দার মিয়া, কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. সোহেল মিয়া, ভোলার লালমোহন উপজেলার বদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৬নং ওয়ার্ডের সদস্য মুহাম্মদ ওমর এবং একই ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. জুয়েল মিয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন প্রায় ২০টি উপজেলায় চাল চুরির অন্তত ২২টি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১০ জনপ্রতিনিধিসহ কমপক্ষে ২৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। জনপ্রতিনিধি ছাড়া বাকিদের বেশিরভাগই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও তাদের আত্মীয়-স্বজন।
ত্রাণ চোরদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যারা চাল চুরির সঙ্গে জড়িত তাদের তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হোক। পরে তাদের বিচার করা হবে। তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। আমরা খুব কষ্ট করে দরিদ্র মানুষকে ত্রাণ দিচ্ছি। আর সেই ত্রাণ আরেকজন আত্মসাৎ করবে এটা হবে না। ত্রাণ চোর আমার দলের হোক আর অন্য দলের হোক শাস্তি তাকে পেতেই হবে।
ত্রাণ চুরি প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ত্রাণ চুরির সঙ্গে জড়িতদের অনেককে ইতোমধ্যে শাস্তি দেয়া হয়েছে। আমাদের দলের সঙ্গে যুক্ত কেউ যদি ত্রাণ আত্মসাৎ বা চাল চুরির সঙ্গে যুক্ত থাকে তবে তাদের বহিষ্কার করা হবে। এরা শুধু আওয়ামী লীগের নয়, দেশ ও জাতির শত্রু। এদের কোনো ক্ষমা নেই। এরা ক্ষমার অযোগ্য, এদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না।
এছাড়া সম্প্রতি ১৪ দলও ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের ‘জাতির শত্রু’ আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে একটি বিবৃতি দেয়। এ বিবৃতিতে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া প্রমুখ স্বাক্ষর করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, কিছু দুর্নীতিবাজ ত্রাণ সামগ্রী আত্মসাৎ করছে। এসব আত্মসাৎকারী দেশ ও জাতির শত্রু। তাদের কোনো দল নেই ধর্ম নেই। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ত্রাণের চাল চোরদের প্রসঙ্গে বলেন, ত্রাণ বিতরণে কোনোরূপ অনিয়ম সহ্য করা হবে না। খেটে খাওয়া মানুষের ত্রাণ নিয়ে যারাই ছিনিমিনি খেলবে, তারা যে–ই হোক, তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে। এমনকি আমাদের দলের কোনো নেতাকর্মী হলে তারাও ছাড় পাবে না। তাদেরও শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, এরই মধ্যে আমাদের দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন, যারা ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ত্রাণ আত্মসাৎকারীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। অসহায় মানুষের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত চাল যারা আত্মসাৎ করছে, কারা এসব অমানুষ? যারা এই রোগের সময়ও এই অসহায় মানুষের ত্রাণ আত্মসাৎ করতে পারে? এদের মানুষ বলা যায় না, এরা মানুষরূপী জানোয়ার। যদি কোনো ব্যক্তি বা জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ত্রাণ আত্মসাতের, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ত্রাণ জালিয়াতি আমরা বরদাশত করব না। আমরা কঠোরভাবে এটা দমন করতে চাই।
আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, যারা অসহায় মানুষের চাল চুরি করছে তারা অনৈতিক কাজ করছে। যারা নৈতিকতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত, দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত তাদের বিষয়ে আমাদের নেত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দায় জনগণের দল আওয়ামী লীগ নেবে না। আর এসব কাজে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে আমরা এমন নির্দেশনা দিয়েছি। এরই মধ্যে কিছু জায়গায় ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে।
বার্তা কক্ষ,১৭ এপ্রিল ২০২০