রাজধানীর শ্যামপুরের হজ এজেন্সি এসএন ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মালিক মোহাম্মদ শাহ আলম ও তাঁর কর্মচারীরা হজে পাঠানোর নাম করে অন্তত ৫৩৮ জনের কাছ থেকে ৩৬ কোটি টাকার বেশি আদায় করেছেন। একইভাবে পুরানা পল্টনের আকবর হজ গ্রুপের দুই এজেন্সি ৪৫ জনের কাছ থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা নিয়েছে। পল্লবীর ওয়াহিদুল ইসলামের সাজিদ হজ ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস এক পরিবারেরই চারজনের কাছ থেকে হজে পাঠানোর কথা বলে ২২ লাখ টাকা নিয়েছে। টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন সংশ্লিষ্ট চার এজেন্সির মালিক। একটি ঘটনায় বুধবার শ্যামপুরের জুরাইনে বিক্ষোভ করেছেন ভুক্তভোগীরা। অন্যরাও প্রতারক এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন। ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে তারাও বিব্রত।
এর বাইরে পুরানা পল্টনের আবাবিল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের বিরুদ্ধে ৭১ জনকে প্রতারিত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এজেন্সিটি টাকা নিলেও এখনো ৭১ জনের ভিসা ও টিকিট নিশ্চিত হয়নি।
সূত্রমতে, সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর মালিক ও প্রতিনিধিদের গ্রেপ্তার করতে গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রতারিত হজযাত্রীদের হজে পাঠানোর চেষ্টা করছে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও এজেন্সির মালিকদের সংগঠন হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ধর্মসচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দার গতকাল বৃহস্পতিবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা প্রথমে প্রতারিত হজযাত্রীদের হজে পাঠানোর চেষ্টা করছি। বিষয়টি বিব্রতকর ও স্পর্শকাতর। সংশ্লিষ্ট এজেন্সির মালিক ও প্রতিনিধিদের গ্রেপ্তার করতে গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছে। সংশ্লিষ্ট এজেন্সির লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অভিযোগ পাওয়ামাত্রই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানা যায়, কিছু হজ এজেন্সি নির্ধারিত সময়ের আগে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের জন্য বাসস্থান ও ভিসার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়। এতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ও সৌদি এয়ারলাইনস বেশ কয়েকটি হজ ফ্লাইট বাতিল করতে বাধ্য হয়। সেই ক্ষতি পোষাতে সৌদি এয়ারলাইনস ডেডিকেটেড বা বিশেষ কাজে নিয়োজিত ফ্লাইটের ভাড়া নিলেও হজযাত্রী পরিবহন করছে নিয়মিত বাণিজ্যিক ফ্লাইটে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস আরও ১০টি ডেডিকেটেড হজ ফ্লাইটের স্লট চেয়েছে সৌদি সরকারের কাছে। এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মো. শফিউল আজিম সম্প্রতি জানান, কিছু হজ এজেন্সির আন্তরিকতার অভাবে বিমানকে টাকা হারানোর পাশাপাশি যথাসময়ে সব হজযাত্রী বহনের চাপে পড়তে হয়। বাংলাদেশে সৌদি এয়ারলাইনসের জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) ইউনাইটেড লিংক লিমিটেডের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, সৌদি এয়ারলাইনসের ডেডিকেটেড হজ ফ্লাইটের কিছু ক্যাপাসিটি লস হয়েছে, সেটা অ্যাডজাস্ট করতেই কমার্শিয়াল ফ্লাইটে হজযাত্রী নেওয়া হচ্ছে।
শুরু থেকেই সমন্বয়হীনতা
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এবার হজ মৌসুমে শুরুতেই নানা ধরনের সমন্বয়হীনতা দেখা দেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়ে। প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েনের মুখে ৫ জুন ধর্মসচিবকে বদলি করা হয়। পরদিনই নতুন সচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দার ধর্ম মন্ত্রণালয়ে যোগ দিলে কিছুটা স্বস্তি ফেরে। বদলি করা হয় আগের সচিবের একান্ত সচিব ও উপসচিবকেও (হজ)। এরই মধ্যে একের পর এক প্রতারণার অভিযোগ আসতে থাকে মন্ত্রণালয়ে। গতকালও মন্ত্রণালয়ে ১১ হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে শুনানি হয়েছে। এজেন্সিগুলো হলো এসএন ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস (লাইসেন্স নম্বর-১১৩৬), আভিয়ানা ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস (৬৮৯), লিমা ট্রাভেলস এজেন্সি (৯০৬), আনাস ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস (৫৯৭), আল-আমীন ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল এজেন্ট (১৩৪০), খিদমাহ ওভারসিজ (১৪০১), আনজান এয়ার ট্রাভেলস (৫৯৯), ফারুক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস (৩৭৩), লিমা স্টন রিসোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম (৯০৭), রাহমানিয়া এয়ার ট্রাভেলস (১৫১৭) এবং সুপার তাকওয়া ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস (১৫৩৩)।
মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতারণার জন্য দায়ী মূলত এজেন্সির মালিকেরা। এজেন্সিগুলো গ্রুপ লিডারদের (প্রতিনিধিদলের নেতা) কমিশন আকারে প্রণোদনা দেয়। বেশি লাভের আশায় সেই প্রতিনিধিরা প্যাকেজের কম মূল্যে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হজযাত্রী সংগ্রহসহ নানা অনিয়ম করেন। এসব দেখার কেউ নেই।
হাব সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রতারণার মূল কারণ হলো গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো হজের গ্রুপ লিডারদের (মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন ও আলেম) বেশি বিশ্বাস করে এজেন্সির রিসিট ছাড়াই টাকা ও পাসপোর্ট দেন। গ্রুপ লিডাররা সংশ্লিষ্ট এজেন্সির মাধ্যমে নিবন্ধন করলেও বেশি লাভের আশায় মক্কা ও মদিনায় বাড়ি ভাড়ার দায়িত্ব নিজেরাই নেন। এজেন্সি টাকা না পেলে বাড়ি ভাড়া হয় না। ফলে ভিসা হয় না। এতেই শুরু হয় জটিলতা। হজযাত্রীদের উচিত প্যাকেজের সব টাকা সরাসরি এজেন্সি অফিসে জমা দিয়ে রসিদ নেওয়া। এটি করলে প্রতারণার সুযোগ থাকবে না।
প্রতারিত ৮৮ জনের ভিসা হয়েছে চলতি মৌসুমে এসএন ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মাধ্যমে ৫৩৮ হজযাত্রীর সৌদি আরবে যাওয়ার কথা। তাঁদের কাছ থেকে ৬ লাখ ৭১ হাজার টাকা করে মোট ৩৬ কোটি ১০ লাখ টাকা আদায় করে প্রতিষ্ঠানটি। তাঁদের মধ্যে ১৫০ জনের ভিসা ও টিকিট নিশ্চিত হলেও মঙ্গলবার সকাল থেকে প্রতিষ্ঠানের মালিক শাহ আলম উধাও হন। এরপর ভুক্তভোগীরা শ্যামপুরে প্রতিষ্ঠানটির সামনে বিক্ষোভ করেন। গতকাল ধর্ম মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি ও হাবের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন ধর্মসচিব। বৈঠকের পর সন্ধ্যায় হাব সভাপতি বলেন, ‘ধর্ম মন্ত্রণালয় ও আমরা এসএন ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের বিষয়টি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করছি। ৫৩৮ জনের মধ্যে ৮৮ জনকে হজে পাঠানোর সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এজেন্সির মালিককে পাওয়া যায়নি। তাকে ধরার চেষ্টা চলছে। আশা করি, বাকিদেরও হজে পাঠাতে পারব।’
আকবর হজ গ্রুপের প্রতারণা
এ বছর চূড়ান্ত নিবন্ধন করেও এজেন্সির প্রতারণার কারণে হজে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ৪৫ হজযাত্রীর। তাঁদের কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা নেওয়ার পরও হজে পাঠাচ্ছে না আকবর হজ গ্রুপের দুই এজেন্সি সাবিলুল জান্নাহ এয়ার ইন্টারন্যাশনাল ও আল-মামুন এয়ার ট্রাভেলস। সম্প্রতি ধর্ম মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এতে বলা হয়েছে, আল হেলাল এয়ার ইন্টারন্যাশনালের প্রতারণার কারণে ২০২২ সালে তাঁরা হজে যেতে পারেননি। হজে পাঠাতে না পারার পরও তাঁদের টাকা ফেরত দেননি প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং পার্টনার এস এম হেলাল উদ্দিন ও মো. ফারুক হোসেন। পরে ২০২৩ সালে হজে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে আকবর হজ গ্রুপের আওতাধীন সাবিলুল জান্নাত এয়ার ইন্টারন্যাশনাল ও আল মামুন এয়ার ট্রাভেলস হজযাত্রীদের ট্রান্সফার করে নিয়ে আসে। আল হেলাল কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব প্যাডে চুক্তি করে হজযাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাঁদের মূল নিবন্ধন সম্পন্ন করে। কিন্তু নিবন্ধনের ১০ দিন পর জানানো হয়, তাঁদের কোনো টাকা জমা হয়নি। নতুন করে টাকা দিতে হবে, না হলে নিবন্ধন বাতিল হবে। ভুক্তভোগী মাওলানা ইসমাইল জানান, এখন পর্যন্ত এর সুরাহা হয়নি। এখন তাদের ফোনেও পাওয়া যায় না।
একই পরিবারের চারজন প্রতারিত
পল্লবীর ওয়াহিদুল ইসলামের সাজিদ হজ ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসকে ৬ জুন নোটিশ দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, মিরপুর ১০ নম্বরের কাজী আফসার আহমেদসহ তাঁর পরিবারের চারজনের কাছ থেকে হজে পাঠানোর কথা বলে ২২ লাখ টাকা নিয়েছে। কিন্তু তাঁদের জন্য হজে যাওয়ার নিবন্ধনসহ কোনো ব্যবস্থাই করেনি প্রতিষ্ঠানটি। চার মাস ধরে টালবাহনা করে শেষে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন এজেন্সির মালিকসহ প্রতিনিধিরা। ফলে ভুক্তভোগীদের হজে গমন অনিশ্চয়তায় পড়ে। কাজী আফসার আহমেদ জানান, মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিলে দুজনের ভিসা হয়। পরে অভিযোগ প্রত্যাহারের শর্তে স্বামীর ভিসা করালেও স্ত্রীর ভিসা হয়নি। (আজকের পত্রিকা)