Home / চাঁদপুর / একসময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী ফরিদগঞ্জের পিচ্চি হান্নান সম্পর্কে অজানা তথ্য
পিচ্চি হান্নান

একসময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী ফরিদগঞ্জের পিচ্চি হান্নান সম্পর্কে অজানা তথ্য

চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার সন্তোষপুরে  গ্রামের একটি বাড়িতে প্রবেশপথে পাকা জামে মসজিদ। মসজিদ পেরোলেই কবরস্থান। কবরস্থানের অনেকগুলো কবরের মাঝে এককোনে নামফলকবিহীন একটি কবর। পুরু শ্যাওলার আস্তরণ জমে সবুজ হয়ে ওঠা কবরটি আলাদা করে চেনার কোনো উপায় নেই। তবে এলাকার কাউকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে মৃত ব্যক্তিটির নাম আব্দুল হান্নান। তবে যে তথ্যটি জেনে আপনি শিউরে উঠতে বাধ্য তা হলো এই আব্দুল হান্নানের অপর নামই পিচ্চি হান্নান ।

কেই এই পিচ্চি হান্নান

ঢাকা শহরের এককালের মাদক সম্রাট, লাখো মানুষের মূর্তিমান আতঙ্ক পিচ্চি হান্নান; আজ পড়ে আছেন নামফলকহীন একটি কবরে। ২০০৪ সালের ২৬ জুন র‍্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত পিচ্চি হান্নান দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ঢাকাই আন্ডারওয়ার্ল্ড । ছিনতাই, চাঁদাবাজির মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন বিপুল পরিমাণ সম্পদ। এই কুখ্যাত সন্ত্রাসীর গল্প নিয়েই সাজানো হয়েছে লেখাটি।

পিচ্চি হান্নান সম্পর্কে তৎকালিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জের চরদুখিয়া ইউনিয়নের ওয়াজিউল্লাহর পাঁচ সন্তান। এর মধ্যে হান্নান দ্বিতীয়। ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন তিনি। এরপর পিতার কাঁচামালের ব্যবসা সূত্রে চলে আসেন ঢাকার কারওয়ান বাজার। প্রথমদিকে মূলত পিতার ব্যবসাই দেখাশোনা করতেন তিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে ছোটখাটো চুরি, ছিনতাই থেকে শুরু করে জড়িয়ে পড়েন ডাকাতি, অপহরণের মতো ভয়ঙ্কর সব অপরাধের সাথেও। খুন-জখম তার কাছে হয়ে ওঠে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। একসময় হান্নান জড়িয়ে পড়েন মাদক ব্যবসার সাথে। এরপরের গল্প কেবল তার অন্ধকার সাম্রাজ্য বিস্তৃত হওয়ার ।

ঢাকার দুই আন্ডারওয়ার্ল্ড

নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকাই আন্ডারওয়ার্ল্ডে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। এক প্রভাবশালী ডনের অবসরে যাওয়ার পর আন্ডারওয়ার্ল্ড বিভক্ত হয়ে যায় দুই ভাগে। একটি সুব্রত বাইনের নেতৃত্বে সেভেন স্টার গ্রুপ, অন্যটি লিয়াকতের নেতৃত্বে ফাইভ স্টার গ্রুপ। পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীরসহ বিকাশ, প্রকাশ, নিটেল এরা যোগ দেন লিয়াকতের ফাইভ স্টার গ্রুপে।
অন্যদিকে সুব্রত বাইনের সেভেন স্টার গ্রুপে যুক্ত হয় টোকাই সাগর, মুরগী মিলন, আসিফ, জন, সাইদুর রহমান নিউটনসহ আরও অনেকে। পরবর্তীতে লিয়াকতের সাথে দ্বন্দ্বের জের ধরে সুব্রত বাইনের সাথে হাত মেলান আন্ডারওয়ার্ল্ডের আরেক ডন সুইডেন আসলাম। এতে সুব্রত বাইনের অবস্থান আরো পোক্ত হয়।

এ সময় দুই গ্যাঙ-এর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধ বেড়ে যায় ব্যাপক হারে। চলতে থাকে খুন, পাল্টা খুন। ‘আগামসি লেন’ এর সন্ত্রাসী আসিফ সুব্রত বাইনের গ্রুপ থেকে বেরিয়ে এসে যোগ দেন লিয়াকত গ্রুপে। এর কিছুদিন পর দুই সহযোগী টিপু ও রিপন সহ খুন হন আসিফ। এ খুনের অভিযোগ উঠে সুব্র্ত বাইন গ্রুপের ‘জন’ এর বিরুদ্ধে। এরপর চলে আরো কিছু খুন, পাল্টা খুন। ঢাকা জজ কোর্ট এলাকায় ফিল্মী কায়দায় খুন করা হয় সুব্রত বাইন গ্রুপের মুরগী মিলনকে। এ মিশনে সরাসরি অংশ নেন পিচ্চি হান্নান ও কালা জাহাঙ্গীর।

আন্ডারওয়ার্ল্ডের এমন উত্তাল সময়ে সরকার ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামের তালিকা প্রকাশ করে। এর মধ্যে পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর, টোকাই সাগর সহ এগার জনকে ধরিয়ে দিলে এক লাখ টাকা ও লিয়াকত ও তার ছোটভাই কামরুল হাসান ওরফে হান্নান সহ বারো জনের জন্য ঘোষণা করা হয় পঞ্চাশ হাজার টাকা করে পুরস্কার।

পিচ্চি হান্নান ও কালা জাহাঙ্গীর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। অধিকাংশ মিশনেই তারা একসাথে অংশ নিতেন । ১৯৯৬ ও ২০০১ এর নির্বাচনেও তারা কাজ করেছিলেন একই দলের প্রার্থীর হয়ে। এভাবে কিছুদিনের মধ্যেই তাদের এই গ্রুপটি আন্ডারওয়ার্ল্ডে রীতিমতো ত্রাস হয়ে উঠে। প্রতি মাসে তাদের নামে চাঁদা উঠত কোটি টাকার উপরে। তবে এই অন্ধকার জগতে বন্ধুত্বের অস্তিত্ব ততক্ষণই যতক্ষণ স্বার্থের দ্বন্দ্ব এসে পথরোধ না করে। এর সত্যতা মেলে পিচ্চি হান্নান ও কালা জাহাঙ্গীরের ঘটনায়ও।

র‌্যাবের সাথে পিচ্চি হান্নানের বন্দুকযুদ্ধ

হান্নানের নামে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, অবৈধভাবে জমি দখলসহ বিভিন্ন অপরাধের মোট ২৩টি মামলা দায়ের হয়েছিলো। এরমধ্যে বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান মণ্ডল হত্যা মামলা, ওয়ার্ড কমিশনার শাহাদাত হোসেন হত্যা মামলা এবং পুলিশ উপ-পরিদর্শক (এসআই) হুমায়ূন কবির হত্যা মামলা উল্লেখযোগ্য।

এ পরিস্থিতিতে তৎকালিন বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চৌকষ সদস্যদের নিয়ে সন্ত্রাস নির্মূলের জন্যে তৈরি করে বিশেষ বাহিনী র‍্যাব। যার নাম শুনলেই সন্ত্রাসীদের গলার পানি শুকিয়ে যেতো। শুরুতেই র‍্যাব টার্গেট করলো নামধারী ঢাকাই সন্ত্রাসীদের। একে একে তাদের হত্যা করতে শুরু করলো ক্রসফায়ারের মাধ্যমে।

আন্ডারওয়ার্ল্ডের মোট ২৩ জন সন্ত্রাসীর তালিকা তৈরি হলো। এদের মধ্যে পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর ও টোকাই সাগরসহ মোট ১১ জনকে ধরিয়ে দিলে তখনকার সময়ের ১লক্ষ টাকা এবং বাকীদের জন্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়।

এ ঘোষণায় বিপদ নেমে এলো কালা জাহাঙ্গীর, সুব্রত বাইন, সুইডেন আসলাম কিংবা পিচ্চি হান্নানের মত শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীদের ঘাড়ে। এই সময় হান্নান কৌশলে বন্ধু জাহাঙ্গীরকে ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দেয় এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী কিংবা পুলিশের চোখে তাকে হত্যা কিংবা আত্মহত্যার দুই বিপরীতমুখী ধূম্রজাল ছড়িয়ে দেয়। কথা ছিলো প্রয়োজন হলে স‍ুযোগ বুঝে হান্নানও পালিয়ে যাবে ইন্ডিয়াতে। কিন্তু সেই সুযোগ আর পায়নি হান্নান!

২০০৪ সালের ২৪ শে জুন মধ্যরাতে র‍্যাবের কাছে খবর আসে হান্নান উত্তরার এক বাসায় বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ফূর্তি করছে। তৎক্ষণাৎ ৪০ জন র‍্যাব সদস্য নিয়ে তারা হানা দেয় উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের সেই ডুপ্লেক্স বাড়িতে।

প্রত্যেক র‍্যাব সদস্যের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। অস্ত্রের নলগুলো ওই বাড়িটির ভেতরের দরজার দিকে তাক করা। হঠা‍ৎ ভেতর থেকে দরজা খুলে বেরিয়ে আসলেন এক যুবক। তার দুই হাত দুই পকেটে ঢোকানো। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটি দুই পকেট থেকে কাউবয় স্টাইলে দুটি পয়েন্ট ২২ বোরের পিস্তল বের করে র‌্যাব সদস্যদের টার্গেট করে গুলি ছুড়তে লাগলেন। এমন আচামকা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না র‌্যাব সদস্যরা। তাদের মধ্যে দুজন ইতিমধ্যে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। অন্য সদস্যরা পাল্টা গুলি চালাচ্ছেন।

মধ্যরাতে গোলাগুলিতে উত্তরা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। নতুন নতুন টেলিফোনের যুগে সেই আতংক মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো ঢাকা শহরজুড়ে।

অস্ত্রধারী ওই যুবকটির শরীরে বেশ কয়েকটি গুলিবিদ্ধ হয়। ওই অবস্থাতেই লোকটি কমান্ডো স্টাইলে লাফিয়ে পাঁচিল টপকে বাড়ির বাইরে চলে যায়। সঙ্গে তার দুই সহযোগীও। দ্রুত তারা চড়ে বসলেন বাইরে পার্ক করে রাখা মাইক্রোবাসে। র‌্যাব সদস্যরা এ সময় গাড়ি লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছু‍ঁড়তে থাকেন।

কিন্তু ততক্ষণে মাইক্রোবাসটি হাওয়া হয়ে গেছে। ২০০৪ সালের ২৪ জুনের ওই রাতে পিচ্চি হান্নানকে হাতের নাগালে পেয়েও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। কমান্ডো স্টাইলে র‌্যাবের সামনে দিয়েই গুলি করতে করতে পালিয়ে যান তিনি। পুরো ‍রাতের অভিযানের উত্তেজনা, ব্যর্থতা, ক্লান্ত শরীর ও দুই গুলিবিদ্ধ সদস্যকে নিয়ে ফিরে আসে র‌্যাবের ওই দলটি।

র‌্যাবের হাত থেকে পালিয়ে গুলিবিদ্ধ পিচ্চি হান্নান তার দুই সহযোগীকে নিয়ে প্রথমে আশুলিয়া যান। সেখানে যুবদলের এক নেতার বাসায় গিয়ে রক্তমাখা কাপড় পরিবর্তন করেন। সেখান থেকে তারা সাভারের আরেক যুবদল নেতার বাসায় যান। ওই নেতাই সাভারের ইনসাফ ক্লিনিকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন। ক্লিনিকে পিচ্চি হান্নানের শরীর থেকে কয়েকটি গুলি বের করা হয়।

এ ঘটনার ঠিক দুদিন পর র‍্যাব আবারো খবর পায় সাভারের ইনসাফ ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছে গুলিবিদ্ধ পিচ্চি হান্নান। এবার আর তাকে কোনো সুযোগ দেয়া যাবে না। আর কোনো ভুল নয়। এই রাতেই ধরতে হবে পিচ্চি হান্নানকে। নাহলে আর কোনোদিনই তাকে পাওয়া যাবেনা। এইবার ধরতে না পারলে ঠিকই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে পিচ্চি হান্নান।

ক্রসফায়ার

অভিযানে যাবার আগে প্রস্তুতি নিতে হয়। কিন্তু এখানে প্রস্তুতি নেয়ার মত আর কোনোরকম সময় নেই। যা করার এখনই করতে হবে ! দেরী না করে র‍্যাব সদস্যরা ততক্ষণাৎ সুকৌশলে সেখানে উপস্থিত হয়ে যায়। মুখোমুখি হয় পিচ্চি হান্নানের।

দোতলার একটি কক্ষেই শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন পিচ্চি হান্নান। র‌্যাবের এক সদস্য তাকে প্রশ্ন করেন, ‘কিরে, উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন এখানে এসেছিস’?’ পিচ্চি হান্নান তখন খুব বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘না স্যার, আমি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছি’।

র‌্যাব অফিসার তখন তার গুলিবিদ্ধ স্থানে হাত রেখে একটু চাপ দিয়ে বলেন, ‘তাই নাকি। এখন বল, হান্নান, তোর গুলিটা কোথায় লেগেছে? এখানে? না এখানে?‘

ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে হান্নান। শেষমেষ র‌্যাবের জেরার মুখে একপর্যায়ে হান্নান স্বীকার করতে বাধ্য হয়, সেইই পিচ্চি হান্নান। এসময় সে র‍্যাবের অফিসারদের উদ্দেশ্য করে বলে, “আমি এই মুহূর্তে আপনেগো এক কোটি টাকা দিমু, আমারে ছাইড়া দেন স্যার। ফোনটা দেন, অক্ষণি টাকা আনতে বলি।”

হান্নানের প্রলোভনে সেদিন কাজ হয়নি। হাসপাতাল থেকে র‍্যাব হান্নানকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।  ২০০৪ সালের ২৬ জুন রাতে পিচ্চি হান্নানকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে বের হয় র‍্যাব সদস্যরা। এবং আশুলিয়ায় তথাকথিত ‘ক্রসফায়ার’ -এ মৃত্যু হয় পিচ্চি হান্নানের। মুকুটবিহীন এক সম্রাটের ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে।

সমাধি

অবৈধ উপার্জনের সাম্রাজ্য তার মরণযাত্রা এড়াতে পারেনি। জন্মস্থান চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার সন্তোষপুরে গ্রামে অযত্নে অবহেলায় এক কবরের অন্ধকারে লুকিয়ে আছে পিচ্চি হান্নানের মরদেহ।

চাঁদপু টাইমস রিপোর্ট, ২৫ জানুয়ারি ২০২০