Home / ফিচার / পিআইবি প্রশিক্ষণ চাঁদপুরের সাংবাদিকদের জন্যে মাইলফলক
পিআইবি প্রশিক্ষণ চাঁদপুরের সাংবাদিকদের জন্যে মাইলফলক
Exif_JPEG_420

পিআইবি প্রশিক্ষণ চাঁদপুরের সাংবাদিকদের জন্যে মাইলফলক

‘একজন সংবাদকর্মী কোনোভাবে কোনো মানুষকে বিশেষায়িত করতে পারবে না। মনের মাধুরী দিয়েও সংবাদ লেখা যাবে না। মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের চেয়ে পাঠককে অন্ধকারে রাখা ভালো।’

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি সুকুমার রায় একদিন একাকী একটি নদী খেয়া নৌকা দিয়ে পার হবার সময় মাঝিকে সম্মোধন করে বলেছিলেন, “মাঝি, তুমি কি লেখাপড়া জানো?” মাঝি উত্তরে বলেছিলেন, “না, বাবু আমিতো লেখাপড়া জানিনে।” তখন কবি বলেছিলো, “তোমার জীবনটাতো আট আনাই বৃথা।” কিছুক্ষণ পর মাঝি আকাশে ঝড়ের সম্ভাবনা দেখে কবিকে বললেন, “আচ্ছা বাবু, আপনি কি সাঁতার কাটতে জানেন?” কবি বললেন, “না মাঝি, আমি তো সাঁতার কাটতে জানি না।” মাঝি তখন বললো, “ তাহলে তো আপনার জীবনটা ষোল আনাই মিছে।”

চাঁদপুর প্রেসক্লাবের উদ্যোগে ও বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট-এর বাস্তবায়নে তিন দিনব্যাপী সাংবাদিকতা বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ কী ছিলো, আমার ও আমার সহকর্মী অনেকের কাছেই মাঝির উক্তির মতো অনুভূতি বিরাজ করছিলো। এর আগে আমরা অনেকেই পিআইপি বা অন্য কোনো সংস্থা কর্তৃক সাংবাদিকতার ওপর এ ধরনের কোনো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার সুযোগ হয় নি।

১৯৮৭ সালের শেষ ভাগে আমি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের আঞ্চলিক শাখায় একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকুরি লাভ করেছিলাম। কথা ছিল দু’বছর চাকুরি করার পর কৃষি ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী আমাদেরকে স্থায়ীকরণ করে নেওয়া হবে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সম্ভবত নিজদের কিছু লোক নিয়োগ দেওয়ার লক্ষ্যে ওই সার্কুলারটি বাতিল করে দেয় এবং চাঁদপুরে আমাদের ৩০ জনের মতো চাকুরির যবনিকা টানা হয়।

তখন থেকেই আমি আমাদের এই দুর্দশার বিষয়গুলো চাঁদপুরের হাতে গোনা দু’একটি পত্রিকায় তুলে ধরেছিলাম। এছাড়াও

১৯৮৮ বন্যায় হাইমচর ও চরাঞ্চলের মানুষের জীবনের কথা লিখতে যেয়ে আমি লেখালেখিতে প্রবেশ করি। বলতে দ্বিধা নেই, পিআইপি প্রশিক্ষণটি ছিলো চাঁদপুরের তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করা ২৫ জন সাংবাদিকদের জন্যে একটি মাইলফলক। যা শুরু হয় ২৪ অক্টোবর শেষ হয় ২৭ অক্টোবর।

Exif_JPEG_420

২৩ অক্টোবর চাঁদপুর প্রেসক্লাব এ ব্যাপারে একটি প্রেস ব্রিফিং সভার আয়োজন করে। সৌভাগ্যক্রমে আমাকে ২৫ জনের এই প্রশিক্ষণ দলটির টীমলিডার বানানো হয়। রাতেই আমরা লঞ্চযোগে ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে রওনা হই।

পিআইপর প্রশিক্ষণ বিষয়ে প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দ একটি প্রাথমিক ধারণা দিলেও এর পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর।

প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে সমাপনী অনুষ্ঠানে দু’বারই প্রশিক্ষণ গ্রহণের অনুভূতি জানানোর জন্য টিম লিডার হিসেবে আমার বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ হয়েছিলো।

২৪ অক্টোবর যথারীতি ৯টায় প্রশিক্ষণে যোগদান করি আমরা সবাই। আমাদের সাথে ছিলো একজন নারী সাংবাদিক। পিআইপির মহাপরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলমগীর প্রথম অধিবেশনে পুরো প্রশিক্ষণ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন।

পুরো সেশানটি ছিলো পাবলিক প্রকিউরমেন্ট-এর একদিনের অরিয়েন্টেশন কোর্স। কোর্সটির প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের একজন উপ-সচিব। যার নাম ছিলো ফারুক হোসাইন। এটি ছিলো বিভিন্ন সরকারি অফিসগুলোতে বিভিন্ন মালামাল ক্রয় বিক্রয়ে নীতিমালা, প্রকল্প বাস্তবায়নের উপর বিভিন্ন নিয়ম-নীতিসম্পন্ন। এ প্রশিক্ষণের বিধিমালা ২০০৮-এর একটি সরকারি গেজেটের কপি ও তার আলোচনার নির্যাসপত্র পেয়েছি।

প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তুটি ছিলো আমাদের জন্যে অজ্ঞাত। দিনভর এ প্রশিক্ষণটি ছিলো অত্যন্ত আনন্দজনক ও বিরামহীন। বেলা তিনটায় সমাপন অনুষ্ঠানে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে সনদ ও প্রশিক্ষণভাতা প্রদান করা হয়।

পরদিন ২৫ অক্টোবর যথারীতি সাংবাদিকতায় বুনিয়াদী তিন দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে ২৭ অক্টোবর ৫ টা পর্যন্ত চলে।

সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্বপালন করেন পিআইপির প্রশিক্ষক ও মিষ্টিভাষী একজন চৌকষ মানুষ পারভীন সুলতানা রাব্বী, প্রতিদিনের প্রতিটি বিষয়ের রিভিউ করতেন তিনি। যা ছিলো অত্যন্ত প্রাণবন্ত।

চ্যানেল আইয়ের বার্তা সম্পাদক মীর মাশরুর জামানের প্রথম সেশন দিয়ে শুরু হয় আমাদের মূল প্রশিক্ষণ পর্ব। মোট ১২টি বিষয় এ প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু। এগুলো হলো- সংবাদ ধারণা, সংবাদের সূচনা ও ব্যবহারিক, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার মধ্যে পার্থক্য, সংবাদ সংগ্রহ, কৌশল, উৎস, সূত্র, সংবাদ কাঠামো ও এর ব্যবহার, বিভিন্ন ধরনের রিপোর্টিং, দু’মাধ্যমে সংবাদ, ফিচার ও এর ট্রিটমেন্ট, তথ্য অধিকার আইন, সাংবাদিকতার নীতিমাল ও সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা ইত্যাদি।

১০ জন প্রশিক্ষক এ সেশন পরিচালনা করে। অধিকাংশ ক্লাশ ছিলো ডিজিটাল কনটেন্ট উপস্থাপনায়। যা ছিলো আকর্ষণীয়। প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তুগুলো প্রশ্নোত্তর, আলোচনা ও বিশদ ব্যাখ্যায় প্রশিক্ষকদের মধ্যে ছিলো অগাদ পান্ডিত্য।

প্রশিক্ষকরা ছিলেন মীর মাশরুর জামান, উত্তরা ইউনিভার্সটির মিডিয়া পরিচালক রহমান মোস্তাফিজ, ৭১ টিভির বার্তা পরিচালক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাওন্তি হায়দার, দেশটিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক জাহিদুল আহসান পিন্টু, বাসসের সিনিয়র রিপোর্টার খায়রুজ জামান কামাল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের উপসচিব সাইফুল্লাহিল আযম এবং সর্বশেষে ছিলেন পিআইপির মহা পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলমগীর।

সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণের বিষয়গুলোর সাথে প্রশিক্ষকগণ সাংবাদিকতার সকল দিকেই তীর ছুঁড়েছেন এবং বাস্তবতার নিরীখে বক্তব্য ও বিষয়বস্তু উপস্থাপনা করেছেন।

চাঁদপুর থেকে আসার তৃণমূল পর্যায়ের ওই সাংবাদিকগণ, প্রত্যেকের কাছেই প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু ছিলো আপেক্ষিক পাওয়া। তাই প্রশিক্ষণটি গ্রহণের পূবেই কবি ও মাঝির উক্তিটির মতো আমার মনে হলো।

তিনদিনের প্রশিক্ষণে সব শিখে ফেলেছি, বিষয়টি তেমনও নয়। তবে প্রশিক্ষকদের দেওয়া প্রশিক্ষণের নির্যাস নিয়ে অন্ততঃ বাড়ি ফিরেছি এটাতো বলতে পারি।

পিআইপির সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, গণমাধ্যম কর্মীদের সবসময় আপগ্রেড থাকতে হয় এবং সময়ের বিপরীতে চলতে হয়।

মীর মাশরুর খান বলেন, সংবাদ হচ্ছে নতুন প্রকাশযোগ্য, জানার আগ্রহ রয়েছে এমন বিষয়ই হলো সংবাদ। একজন সাংবাদিককে ছোট ঘটনা তথ্যের ভিত্তিতে আবিষ্কারের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।

মিডিয়া সম্পর্কে তার অভিব্যক্তিতে বলেন, মানুষের মধ্যে কোনোকিছু পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমই হচ্ছে মিডিয়া।

তিনি আরো বলেন, সংবাদপত্রে সাংবাদিকের নিজের ভাষা বলতে কিছু থাকবে না। তবে তিনি লেখাপড়া ছাড়া যে সাংবাদিক হওয়া যায় না এমন মন্তব্যও করেন। সংবাদ সম্পর্কে তিনি অস্বাভাবিক এমনকিছুকেই সংবাদ বলে মন্তব্য করেন।

শাওন্তি সংবাদ কাঠামো নিয়ে বলেন, একজন সংবাদকর্মী কোনোভাবে কোনো মানুষকে বিশেষায়িত করতে পারবে না। মনের মাধুরী দিয়েও সংবাদ লেখা যাবে না। মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের চেয়ে পাঠককে অন্ধকারে রাখা ভালো।

জাহিদুল আহসান বলেন, কোনো মানুষকে বিপদে ফেলা সাংবাদিকের কাজ নয়। অবশ্যই একজন সাংবাদিককে প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতে হবে। নিরপেক্ষ প্রতিবেদন বলতে, বিশেষ দৃষ্টিকোনসম্পন্ন রচনা বলে অভিহিত করেন। পুলিশের দায়িত্ব মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা যেমন, ঠিক তেমনি সাংবাদিকের দায়িত্ব নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করা।

খায়রুজ জামান বলেন, সংবাদ হচ্ছে হার্ড এবং নিউজ হচ্ছে সফট। নারী, শিশু, উন্নয়ন, বাজেট, জলবায়ু, দারিদ্র, গ্রামবাংলা, মৎস্য, কৃষি, বিদ্যুৎ, সৌর বিদ্যুৎ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, লোকজ সংস্কৃতি, শহর জীবন, নাগরিক জীবন, প্রতিভাধর ব্যাক্তি ইত্যাদি বিষয়ে ফিচার লেখা সম্ভব বলে তিনি তার ডিজিটাল কন্টেন্টে উপস্থাপন করেন।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইফুল্লাহীল আযম বলেন, তথ্য পরিবেশনে সাংবাদিকগণ বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ রেখে আসছে। তথ্য অধিকার আইন সকলের জন্যই সমান ভূমিকা রাখছে। কারণ নাগরিকরাই দেশের মালিক।

চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রহিম বাদশা পিআইপিকে ধন্যবাদ জানানোর জন্যে সমাপন অনুষ্ঠানে এসে যোগ দিয়েছিলেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, সাংবাদিকের সোর্স যাচাই করে সততার মাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে।

সর্বপরি পিআইপির মহাপরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলমগীর সাংবাদিকতার নীতিমালা ও সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার ওপর প্রাণবন্ত আলোচনায় বলেন, সাংবাদিকদের নীতি-নৈতিকতা ও চরিত্রগত গুণাবলীই হলোই সবচেয়ে বড় গুণ।

তিনি সংবাদ পরিবেশে নীতি-নৈতিকতার ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেন। সাংবাদিকতা হচ্ছে আস্থার জায়গা। তাই সততা বজায় রাখতে হবে। তিনি একজন সাংবাদিককে সমাজের একজন অগ্রগতি মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সাংবাদিককে অর্থনীতি, ব্যাংকিং, চিকিৎসা, কৃষি, শিক্ষা, আবহাওয়া প্রভৃতি বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। আমরা এখন ডিজিটাল যুগে চলে এসেছি। সেক্ষেত্রে আইটি সেক্টরের জ্ঞান অসম্পূর্ণ থাকলে কোনো সাংবাদিক এগুতে পারবে না। প্রতি মুহূর্তেই শিখতে হবে এবং জানতে হবে। একজন সাংবাদিকদের কাছে অবশ্যই একটি ল্যাপটপ আছে বা থাকবে। এর মাধ্যমেই নিউজকে আপগ্রেড করে নেবে। ল্যাপটপ হচ্ছে একজন শিক্ষকের মতো। পিআইবি সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠান। তাই এর দরজা সাংবাদিকদের জন্য উন্মুক্ত।

তিনি পিআইপির প্রশিক্ষণকে কাজে লাগাতে প্রশিক্ষণার্থীদের অনুরোধ জানান।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি চাঁদপুরের কৃতীসন্তান সাংবাদিক সফিকুর রহমান ছিলেন সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি।

তিনি তার বক্তৃতায় বলেন, চাঁদপুরে প্রয় ১শ’র মতো জাতীয় মানের সাংবাদিক রয়েছে। এখানে যারা এসেছেন তারা অবশ্যই প্রশিক্ষণ বিষয়বস্তুকে কাজে লাগাবেন। বিশ^ব্যাপী এখন প্রতিযোগিতা রয়েছে। উন্নত সাংবাদিকতায় ধাপে ধাপে এগুতে হবে। বর্তমানে সাংবাদিকতা একটি ঝুকিপূর্ণ পেশা। সেক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

অবশেষে চাঁদপুর প্রেসক্লাবের নেতবৃন্দ ও পিআইবিকে প্রশিক্ষণ গ্রহণে সুযোগের জন্যে প্রশিক্ষণার্থীদের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

আবদুল গনি

লেখক পরিচিতি:  পিআইবির প্রশিক্ষণার্থী। মোবাইল : ০১৭১৮২১১০৪৪

|| আপডেট: ০৬:৪৬  পিএম, ০৪ নভেম্বর ২০১৫, বুধবার

এমআরআর