Home / বিশেষ সংবাদ / পরিবারে ভাঙন বাড়ছে, ভুগছে শিশুরা
পরিবারে
পতীকী ছবি

পরিবারে ভাঙন বাড়ছে, ভুগছে শিশুরা

রাজধানীর একটি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সাবরিনা মল্লিকা স্পৃহা। বিভিন্ন ছুটিতে তার ক্লাসের বন্ধুরা যখন পরিবারের সঙ্গে শহরের বাইরে বেড়াতে যায়, সে তখন যায় বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। কারণ, মা-বাবার বিচ্ছেদের পর মায়ের কাছে থাকছে সে, আর ষোলো বছরের বড় ভাই থাকছে বাবার সঙ্গে। পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে ছুটি কাটানোর স্মৃতিটাও ভুলতে বসেছে স্পৃহা।

স্পৃহার মা তামান্না বিভা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আজকের পত্রিকাকে এই নারী জানান, তিন বছর আগে তাঁদের বিয়েবিচ্ছেদ হয়। সদা হাস্যোজ্জ্বল স্পৃহার মধ্যে এর পর থেকেই খিটখিটে স্বভাব লক্ষ্য করছেন তিনি। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী আর বন্ধুদের বিভিন্ন প্রশ্ন এড়াতে বিকেলে খেলতেও বের হয় না সে। পরীক্ষার ফলও খারাপ হতে শুরু করেছে।

মা-বাবা আর দাদা-দাদির সঙ্গে যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছে রাহেল আমীন। এখন সে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। বছর দুয়েক আগে দাদা-দাদির বাড়ি ছেড়ে আলাদা বাসায় থাকতে শুরু করেন রাহেলের মা-বাবা। এর পর থেকেই মনমরা হয়ে থাকছে সে। রাহেলের বাবা তাশরিক আমীন জানান, ‘ও একেবারেই একা হয়ে পড়েছে। এটা আমরা বুঝি। কিন্তু বাস্তবতাও তো ভাবতে হবে।’

সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। বিয়েবিচ্ছেদের কারণে একক পরিবারও ভেঙে যাচ্ছে। পরিবারব্যবস্থায় এই ভাঙনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিশুর মনোজগতে। পারিবারিক ভাঙনের কারণে স্পৃহা, রাহেলের মতো হাজারো শিশু তাদের স্বাভাবিক শৈশব হারাচ্ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজির অধ্যাপক মেহজাবীন হক জানান, পরিবারে ভাঙনের কারণে শিশুদের মাঝে দুঃখবোধ, মনমরা ভাব, হারানোর অনুভূতি কাজ করে। সেই সঙ্গে তাদের ভয় আর অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে দেখা যায়। তারা নিজেদের পরিত্যক্ত ও অবাঞ্ছিত ভাবে।

সাম্প্রতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২০-এর চেয়ে ২০২১ সালে বিচ্ছেদের পরিমাণ বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২০১৯ সালে তালাকের আবেদন জমা পড়েছিল ৬ হাজার ১৪৪টি। পরের বছর এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ১৬৮-তে। আর গত বছর সেটা ৭ হাজার ছাড়িয়ে যায়। দক্ষিণ সিটিতেও ২০২১ সালে বিচ্ছেদ আবেদনের পরিমাণ ছিল ৭ হাজারের বেশি।

শুধু ঢাকাতে নয়, সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশেই বিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০২১ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ সালে বিচ্ছেদের হার নারীদের মধ্যে ছিল প্রতি এক হাজারের মধ্যে ১ দশমিক ৬ জন। ২০২০ সালে এসে সেটা ২ দশমিক ৭-এ পৌঁছেছে।

পরিবারব্যবস্থার এমন ভঙ্গুর পরিস্থিতির মধ্যেই আজ ১৫ মে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘পরিবার এবং নগরায়ণ’। ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়। পরিবারের সব সদস্যের একসঙ্গে জীবন কাটানোকে উৎসাহিত করতে জাতিসংঘ এ উদ্যোগ নেয়।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নগরায়ণের ফলে পরিবারগুলো ভাঙছে। নারীদের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, পরকীয়া এবং আত্মনির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বিয়েবিচ্ছেদ বাড়ছে।

মানবাধিকারকর্মী ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সিনিয়র আইনজীবী দীপ্তি সিকদার বলেন, ‘পারিবারিক নির্যাতন আর বিয়েবিচ্ছেদ দুটো একই সূত্রে গাঁথা। করোনাকালে আমরা দেখেছি, পারিবারিক নির্যাতন অনেক বেড়েছে। এ সময় বিচ্ছেদও কিন্তু অনেকটাই বেড়েছে। আমাদের নানি-দাদি বা মা-খালাদের সময়ে মেয়েরা যতটা মানসিক কিংবা শারীরিক নির্যাতন সহ্য করে সংসার চালিয়ে গেছে, স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান অবস্থায় একজন আত্মনির্ভরশীল মেয়ে সেটা সহ্য করবে না। পর্নোগ্রাফি সহজলভ্য হওয়াও বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার আরেকটা কারণ।’

সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবারের ভাঙনের কারণ ও শিশুদের ওপর এর প্রভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিপ্রা সরকার বলেন, ‘বিশ্বায়ন, নগরায়ণ ও আধুনিকায়নের প্রভাব আমাদের সামাজিক এবং পারিবারিক জীবনেও পড়ছে। যার ফলে আমাদের যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে অণু পরিবার হচ্ছে। অণু পরিবারে বড় হওয়া শিশুরা একটা গণ্ডিবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত হয়। এই শিশুরাই আবার যখন মা-বাবার বিচ্ছেদ দেখে, তখন তারা আরও বেশি নিজেদের গুটিয়ে নেয়। পরিবার সম্পর্কে তাদের মধ্যে একটা নেতিবাচক ধারণা জন্মায়।’

বিচ্ছেদের কারণ যেটাই হোক না কেন, এর নেতিবাচক প্রভাব শিশুদের ওপরই পড়ছে সবচেয়ে বেশি। এ জন্য ভাঙনের প্রভাব থেকে শিশুদের সুরক্ষা দিতে মা-বাবাসহ পরিবারের সব সদস্যকে নমনীয় হওয়ার কথা বলছেন শিশু অধিকারকর্মী এবং মনোবিদেরা।

বেসরকারি সংগঠন ‘শিশুরাই সব’-এর আহ্বায়ক লায়লা খন্দকার এ বিষয়ে বলেন, মা-বাবার সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা প্রত্যেক সন্তানের জন্যই মঙ্গলজনক। কিন্তু এটা নিশ্চিত করা না গেলে এবং বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠলে সন্তানকে বিচ্ছেদের ব্যাপারটি যতটা সম্ভব বুঝিয়ে বলা দরকার। বিচ্ছেদ নিয়ে তাদের অনুভূতিটাও প্রকাশ করতে দেওয়া দরকার।

বার্তা কক্ষ, ১৫ মে ২০২২