শ্রীচৈতন্যের প্রতিষ্ঠিত বৈষ্ণব ধর্মের একটি বিশিষ্ট অঙ্গ হলো পরকীয়া প্রেম। অর্থাৎ বর্তমান যুগের ভাষায় পরস্ত্রীর সাথে অবৈধ প্রেম ও ব্যভিচার। বিখ্যাত ঐতিহাসিক শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার তার লিখিত ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে বলেছেন, বর্তমান কালের রুচির অমর্যাদা না করে এর বিস্তৃত বর্ণনা করা অসম্ভব।
তার মতে, আশ্চর্য বিষয় এই যে, এই পরকীয়া, অর্থাৎ পরিণীতা স্ত্রীর সাথে বৈধ প্রেম অপো আধ্যাত্মিক দিক থেকে অনেক শ্রেষ্ঠ ভাবা। বৈষ্ণবরা মনে করতেন এবং এখনো মনে করেন, প্রেমের মাধ্যমে ভগবানের সঙ্গ লাভ সম্ভব। আর এই প্রেমের প্রথম সোপান হচ্ছে পরকীয়া। পরকীয়ার মাধ্যমে ভগবত প্রেমের আবির্ভাব ঘটে। সম্ভব হয় প্রেমের স্বরূপ উপলব্ধির। আর এই প্রেমের সাধনার মাধ্যমে লাভ করা যায় ভগবানের সান্নিধ্য।
(দ্রষ্টব্য : রমেশচন্দ্র মজুমদার; বাংলা দেশের ইতিহাস; দ্বিতীয় খণ্ড। পৃষ্ঠা ২৬৭। মাঘ ১৩৮০; জেনারেল প্রিন্টার্স। কলকাতা)
আমার বাড়ি রাজশাহী শহরে। রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার দূরে, উত্তর-পশ্চিমে খেতুর নামে একটি জায়গা আছে। এখানে সুপ্রসিদ্ধ বৈষ্ণব মহাজন নরত্তম ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। ১৫৮২ সালে (১৫০৪ শকাব্দে) নরত্তম ঠাকুর খেতুরে চৈতন্যবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন।
এ সময় তিনি আহ্বান করেছিলেন এক বিরাট বৈষ্ণব সম্মেলন। খেতুর হয়ে ওঠে তখনকার সারা বাংলার বৈষ্ণবদের বিশেষ তীর্থ। এই তীর্থ উপল,ে সেখানে প্রতি বছর বহুলোকের সমাগম হতে আরম্ভ করে। পরে নরত্তম ঠাকুরের তিরধান উপলে মাঘ মাসের শেষে সাত দিন একটি বড় মেলা বসতে আরম্ভ করে।
এই মেলায় বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাব, বাঁশ ও বেতের তৈরি দ্রব্য, সুন্দর নকশা আঁকা শখের হাঁড়ি বিক্রি হতো। যারা বৈষ্ণব নন, তারাও যেতেন ওই মেলায় এসব জিনিস কিনতে। বাংলাদেশে এ সময় যত মেলা বসত, তার মধ্যে খেতুর মেলা ছিল খুবই প্রসিদ্ধ।
এ সময় মেলায় প্রতি বছর প্রায় ২৫-৩০ হাজার লোকের সমাগম হতো। এই মেলা এ সময় কার্যত হয়ে উঠত একটি বড় অস্থায়ী ব্যবসাকেন্দ্র।
এই খেতুর মেলায় লোকসমাগম হওয়ার অন্য আর একটি কারণও ছিল। তা হলো, বৈষ্ণব যুবতী মেয়েরা (বৈষ্টমী) আপাদমস্তক চাদরে ঢেকে কেবল এক হাতের তালু বাইরে বের করে রাখত। তাদের হাতের এই তালুতে কিছু অর্থ দিলে এসব বৈষ্ণব মেয়ে যেকোনো লোকের অস্থায়ী যৌনসঙ্গী হতো। এই প্রথাও হয়ে উঠেছিল কিছুটা বৈষ্ণব ধর্ম সাধনারই অঙ্গ।
বৈষ্ণব মতেÑ দাস্য সখ্য বাৎসল্য শৃঙ্গার এই চারি রস। চারি রসে ভক্ত যত কৃষ্ণ তার দাস। উল্লেখ্য, বৈষ্ণবরা কৃষ্ণের পূজারী। কৃষ্ণকে মনে করা হয় দেবতা বিষ্ণুর অবতার। রাধা ও কৃষ্ণকে নিয়ে গড়ে উঠেছে বিরাট বৈষ্ণব সাহিত্য। আর রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার বর্ণনা আজকের মাপকাঠিতে মনে হয় খুবই অশ্লীল।
আত্নপক্ষ.এবনে গোলামা সামাদ-প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট