শুক্রবার, ১২ জুন ২০১৫ ০২:০১ অপরাহ্ন
রাজু আহমেদ :
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত । সেই শিশুরাই আবার সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশ । বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৮ ভাগ শিশু । শিশু বলতেই আমরা বুঝি যারা বই হাতে দল বেঁধে স্কুলে যাবে, মহল্লার মাঠগুলো কাঁপিয়ে রাখবে, হুই-হুল্লোরে ব্যস্ত থাকবে । এই চঞ্চল প্রকৃতিই যেন শিশুর সাথে মানানসই । শিশুকে ঘিরেই একটি পরিবারের স্বপ্ন দানা বাঁধে । অথচ অনেক সময় সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হওয়ার মাঝ পথেই ছেদ পড়ে। কেউ বাধ্য হয়ে আবার কেউবা প্ররোচনায় পড়ে কলিজার টুকরাতুল্য শিশুটিকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করতে বাধ্য হয় । আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা “আইএলও’’ এর মতে বাংলাদেশে প্রায় ৩৪৭ ধরনের অর্থনৈতিক কাজের সাথে শিশুরা জড়িত।
এরমধ্যে ৪৭ প্রকারের কাজ শিশুদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ শিশু বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘সেভ দ্যা চিলড্রেন্স’ কর্তৃক ১৯৯৬ সালে শিশু গবেষণা সম্পর্কে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের কর্মজীবী শিশু’ বইটিতে লেখক ব্লাঞ্চেট শিশুর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, যে মানব সন্তানের কিছু বোঝার ক্ষমতা নাই তাকে শিশু বলা হয় ।
ব্লাঞ্চেটের মতে, শিশুর সংজ্ঞা শিশুর বিকাশের উপর ভিত্তি করে কার্যকরী হবে । এক্ষেত্রে শিশুর বয়স কম অথবা বেশি উভয়ই হতে পারে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে শিশুর পরিচয়ে বলা আছে, ১৮ বছরের কম বয়সী যে কোন মানব সন্তানই শিশু । বাংলাদেশ শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় কর্তৃক প্রদত্ত সংজ্ঞা মতে, ১৪ বছরের নিচে যে কোন বালক বালিকাকে শিশু বলা হবে । উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলো থেকে শিশুর বয়স নির্ধারণে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোনে বলা যায়, অন্তত ১৮ বছরের কম বয়সী সকল বালক-বালিকা শিশু হিসেবে গণ্য হবে ।
বাংলাদেশের শিশুরা বিশেষ করে বস্তিতে বসবাসরত এবং ছিন্নমূল শিশুরা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত। ‘সেভ দ্যা চিলড্রেন্স’ বাংলাদেশের ৭টি বস্তির উপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে, শিশুদেরকে কেবল ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত রাখা হচ্ছে না বরং শিশুদেরকে দিয়ে অমানবিক পরিশ্রমও করানো হচ্ছে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে একজন পূর্ণবয়স্ক শ্রমিকের দৈনিক কাজের সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের শিশুদেরকে অধিক সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। শিশু বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠটির জরিপের তথ্য মতে, দেশের ১১% শিশুকে দৈনিক গড়ে ১৩-১৫ ঘন্টা, ৮৩% শিশুকে ১০ ঘন্টা বা তারও বেশি এবং ৩২% শিশুকে প্রত্যহ গড়ে ৯-১০ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করা হয় । দেশের শিশু শ্রমিকদের প্রায় ৪৪% বিভিন্ন পোশাক কারখানায়, ২৪% দোকানে এবং ৯% শিশু ভিক্ষাবৃত্তির মত গর্হিত কাজের সাথে জড়িত। ১২% শিশুকে দিয়ে অত্যন্ত বিপদজনক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করানো হয়। কর্মজীবী এসকল শিশুরা তাদের কর্মস্থানে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় । গবেষণার তথ্য মতে, কর্মক্ষেত্রে ৯% শিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশুদের জন্য অত্যন্ত খারাপ এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে- যৌনকর্ম, চোরাচালানির কাজে শিশুর ব্যবহার, বিড়ি কারখনায় শিশুশ্রম, ব্যাটারীসহ রাসয়নিক কারখানায় শিশুদের ব্যবহার, গ্লাস ফ্যাক্টরী, ট্যানারী শিল্প, লবণ কারখানা, পরিবহন ক্ষেত্রে (টেম্পো ও মিনিবাসের হেলপার ও চালক , রিকশাচালক, ভ্যানচালক ইত্যাদি), উট এবং ঘোড়ার জকি হিসেবে শিশুদের ব্যবহার, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র বহন কাজে ব্যবহার, ওয়েল্ডিংয়ের কাজ, গৃহকর্মসহ শতাধিক কাজে শিশুদেরকে নিয়োজিত রাখা হয়েছে। এসব কাজগুলো যেমন ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের পথে অন্তরায় । শিশুশ্রমের ফলে শিশুরা কেবল মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় না বরং শারীরিকভাবেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে পারে।
শিশুশ্রমের ফলে শিশুরা যতগুলো সমস্যার সম্মূখীন হয় তার মধ্যে-শিশুদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে, স্বাভাবিক শৈশব ও পারিবারিক জীবন নষ্ট হয়, সামাজিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা শিথিল হয়, শিশুর শিক্ষা বিঘ্নিত হয়, শিশুরা উৎপাদন ব্যবস্থার কাজে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কাজে ব্যবহৃত হয় ফলে বয়স্ক অবস্থায় তাদের উৎপাদন ক্ষমতা কমে পায় । যার ফলে সমাজ ও দেশে অর্থনৈতিক ক্ষতি বৃদ্ধি পায়। শিশুশ্রমের কারনে শিশুদের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধি/যক্ষ্মাসহ কয়েকটি মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে ।
যে শিশুরা কার্পেট ও সূচিশিল্পে কাজ করে তাদের দৈহিক ক্ষতি হয় । শিশুরা দীর্ঘসময় কাজ করার ফলে দুর্ঘটনা কবলিত হয় যার ফলে অকালে মৃত্যুমূখে পতিত হয় কিংবা সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে। যে শিশুরা নিয়ন্ত্রিত ও আবদ্ধ পরিবেশে কাজ করে তারা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। শিশুরা তাদের জীবনের শুরুতে কাজে জড়িয়ে যাওয়ার কারনে দেশ ও জাতি উপযুক্ত নাগরিক প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয় ।
বর্তমানে বাংলাদেশে শিশুদেরকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে । রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শিশুদেরকে সর্বপ্রথম ব্যবহার করা হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। শিক্ষা, খেলাধুলা ও ধর্র্মীয় উদ্দেশ্যকে পুঁজি করে তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক কাজে শিশুদেরকে ব্যবহার করা শুরু হয়। দেশের কোন কোন রাজনৈতিক সংঘঠন শিশুদেরকে দিয়ে রাজনৈতিক প্রচারণা, মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ ও হরতালের মত কর্মসূচী পালন করাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ সহিংস কাজেও শিশুদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে যা দেশের আগামীর জন্য চরম উদ্ধেগ বহন করে। শিশুদেরকে দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করা হলেও শিশুরা জানতে পারছে না যে, ঠিক কি উদ্দেশ্যে তাদের দিয়ে এ কাজ করানো হচ্ছে।
সামান্য কয়েকটি টাকা কিংবা একবেলা খাবারের আশায় তারাও এসব কাজে জড়াচ্ছে । কখনো যদি শিশুরা এ ধরনে কাজ করতে রাজী না হয় তবে তাদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে। যে কারণে শিশুদের অপরাধ বোধ কমে যাচ্ছে এবং অনৈতিক কর্মকান্ড করার সাহস বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে রাজনৈতিক সহিংসতায় বাংলাদেশে ব্যবহৃত শিশুর হার প্রায় ৪০% । যদিও দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি বিভিন্ন মেয়াদে নির্বাচনের পূর্বে তাদের ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করেছিল যে, তারা রাজনৈতিক কর্মকান্ডে শিশুদেরকে ব্যবহার করবে না অথচ কেউ কথা রাখেনি।
বৃহৎ দুই দলসহ দেশের অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় স্বার্থে শিশুদেরকে কম বেশি ব্যবহার করছে। এমপি মন্ত্রীদের সংবর্ধনার নামে রোদ-বৃষ্টির মধ্যে শিশুদেরকে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এমনকি রাজনৈতিক সহিংসতায় পুলিশ পেটানোর কাজেও শিশুদেরকে ব্যবহার করতে দেখা যায় । দরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের অভাবের সুযোগ নিয়ে তাদেরকে রজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয় । অথচ এমন কাজ করা কোন বিবেকবানের উচিত নয়।
জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনিসেফ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে শিশুদের সব ধরনের সহিংসতা থেকে দূরে রাখার আহ্বান জানিয়েছে । অপরদিকে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ৩৬নং অনুচ্ছেদে ১৮ বছরের কম বয়সী কোন শিশুকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে । দেশের শিশুদেরকে নিরাপদ রাখার শপথ নিয়ে ২০১৩ সালে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে শিশুদেরকে ব্যবহার নিষিদ্ধ করে নতুন ‘শিশু আইন’ পাশ করা হয়েছে অথচ এ পর্যন্ত এ আইনের প্রয়োগ এবং পূর্ণ বাস্তবায়নের কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না । মনে হচ্ছে কাগজের আইন কাগজেই থেকে যাবে ।
আজকের শিশুরা আগামীতে জাতির নেতৃত্ব দেবে। তাই শিশুদের নির্মল ও বাসযোগ্য পরিবেশসহ শিক্ষা, খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও সমতার পাশাপাশি আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। সাময়িক অর্থলাভ কিংবা অন্যকোন মোহে শিশুদেরকে কোন অবস্থায়ই ঝুঁকিপূর্ণ কোন কাজে নিয়োজিত করা যাবে না । সকল অভিভাবকে তাদের সন্তানের ব্যাপারে সচেতন এবং যত্নবান হওয়া আবশ্যক।
ছিন্নমূল এবং ঠিকানাহীন পথশিশুদের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে । রাষ্ট্র যদি এ সকল শিশুদেরকে সরকারী পৃষ্ঠপোষকাতায় যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে তবে এ সকল শিশুরা দেশের জন্য জনসম্পদে পরিনত হবে নয়ত তারা সমাজের সকল অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়বে এবং রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তুলবে । অসহায় ও প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্নশীল হওয়া আবশ্যক।
প্রতিবন্ধী শিশুরা যদি সুযোগ পায় তবে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতে পারে। যা গত কয়েকবারের প্যারা অলিম্পিকসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তারা প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ বাধ্যতামূলক তবে বর্তমান প্রতিযোগীতামূলক বিশ্বের কথা চিন্তা করে অন্তত এসএসসি/সমমানের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা আবশ্যক।
দেশের সকল শিশু যেন বই হাতে স্কুলের পথে ছুটতে পারে সে ব্যবস্থার নিশ্চয়তা রাষ্ট্র অবশ্যই করবে বলে বিশ্বাস। সকল ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত শিশুদেরকে উদ্ধার করে তাদেরকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশের উন্নয়নের হাতিয়ার করা হোক।
সকল শিশু দক্ষ হয়ে যাতে স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গঠনে অবদান রাখতে পারে তার সুযোগ সৃষ্টি করা আশু আবশ্যক। সময় এসেছে সমস্বরে শিশুশ্রমকে না বলার ।
রাজু আহমেদ । কলামিস্ট । raju69alive@gmail.com
চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/২০১৫
চাঁদপুর টাইমস’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।