নিবিড় সবজি ও ফল চাষ প্রযুক্তি

সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো নিরাপদ খাদ্য। বিশেষ করে বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য অনেকটা বাঘের দুধের মতোই দুষ্প্রাপ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাল-ডাল, তরিতরকারি, ফলমূল, মাছ-মাংস, দুধ-ডিম, তেল-ঘি, লবণ-মসলাসহ বাজারের কোনো খাদ্যই এখন ভেজাল বা দূষণমুক্ত নয়।

বিশ্বাস করা কঠিন হয়, যদি কেউ দাবি করে যে তার খাদ্যে কোনো ভেজাল নেই বা সম্পূর্ণ নিরাপদ। নিরুপায় মানুষ জেনেশুনে এসব ভেজাল, দূষণযুক্ত খাদ্য চড়াদামে কিনে খাচ্ছে। পরিণামে নানা জটিল আর জীবনসংশয়ী অসুখে ভুগছে লাখ লাখ মানুষ—ঘরে ঘরে এখন ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি ও হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী।

শিশুরা জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ, প্রতিবন্ধী, জটিল রোগ নিয়ে, এমনকি অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে। ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মধ্যে জীবন কাটাচ্ছি আমরা এবং আরো ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগিয়ে চলছে আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম। এখনই যদি আমরা সচেতন না হই এবং দেশের জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের করুণ পরিণতির জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই দায়ী থাকব।

দেশের বেশির ভাগ মানুষ, বিশেষত নারী ও শিশুরা নানা ধরনের অপুষ্টিতে ভুগছে। বর্তমানে চলমান করোনা মহামারি মোকাবেলায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর, আর এ জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ শাক-সবজি ও ফলমূল খাওয়া জরুরি।

করোনা পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতি ইঞ্চি জমি ফসল আবাদের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) উদ্ভাবিত বসতভিটাভিত্তিক নিবিড় সবজি ও ফল চাষের প্রযুক্তি দেশের জনগণের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য জোগানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

যদি গ্রাম ও মফস্বল অঞ্চলের প্রতিটি বসতবাড়িতে এ প্রযুক্তি বা মডেলের ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়, তাহলে খুব সহজেই দেশের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি জোগান দেওয়া সম্ভব।

দেশের জনগণের, বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ খাদ্য এবং তাদের পুষ্টি নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট অনেক আগে থেকেই গবেষণা চালিয়ে আসছে এবং বেশ কিছু কার্যকর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। বারির সরেজমিন গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানীরা আশির দশকে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার কালিকাপুরের ফার্মিং সিস্টেম গবেষণা এলাকায় প্রথম উদ্ভাবন করেন বসতবাড়ির আঙিনায় নিবিড় সবজি চাষের প্রযুক্তি ‘কালিকাপুর মডেল’।

এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বসতভিটায় সারা বছর সবজি উত্পাদন করা সম্ভব হয় এবং উত্পাদিত সবজি দিয়ে পারিবারিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি উদ্বৃত্ত সবজি আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের উপহার দিয়ে ও বিক্রি করে বেশ কিছু বাড়তি আয় করা সম্ভব হয়। বসতবাড়ির বাগানে জৈব সার (যেমন—গোবর, খামারজাত আবর্জনা, রান্নাঘরের উচ্ছিষ্টাংশ ইত্যাদি) বেশি ব্যবহার করা হয় বিধায় রাসায়নিক সার কম লাগে।

এ ছাড়া পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বসতবাড়ির বাগানে রাসায়নিক কীটনাশক বা জীবাণুনাশক প্রয়োগ করা হয় না, তাই উত্পাদিত সবজি বিষমুক্ত ও নিরাপদ। আর নিয়মিত বাগানের টাটকা সবজি খাওয়ার ফলে পরিবারের সদস্যদের পুষ্টি চাহিদা সহজেই পূরণ হয় এবং সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে।

প্রযুক্তিটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয় এবং সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাধ্যমে প্রযুক্তিটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং পরে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) প্রযুক্তিটি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্প্রসারণ করে। তবে কৃষি পরিবেশ, বসতবাড়ির আকার-আকৃতি ও ব্যবহারের ভিন্নতা এবং এলাকাভেদে কৃষকের পছন্দের তারতম্যের কারণে কালিকাপুর মডেলটি সর্বত্র ব্যবহারে কিছু সমস্যা দেখা দেয়।

তাই পরে বারির সরেজমিন গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে অবস্থিত ফার্মিং সিস্টেম গবেষণা এলাকায় নির্বাচিত কৃষকের বসতবাড়িতে গবেষণা চালিয়ে নিবিড় সবজি ও ফল চাষের আরো আধুনিক এবং অধিক উত্পাদনশীল কিছু মডেল উদ্ভাবন করেছেন; যেমন—পাবনা এলাকার জন্য ‘গয়েশপুর মডেল’, রংপুর এলাকার জন্য ‘রংপুর মডেল’, বরেন্দ্র এলাকার জন্য ‘বরেন্দ্র মডেল’, টাঙ্গাইল এলাকার জন্য ‘পালিমা মডেল’, সিলেট এলাকার জন্য ‘গোলাপগঞ্জ মডেল’, শেরপুর অঞ্চলের জন্য ‘কুসুমহাটি মডেল’, ফরিদপুর অঞ্চলের জন্য ‘ঈশানগোপালপুর মডেল’, বৃহত্তর পটুয়াখালী ও বরিশাল এলাকার জন্য ‘লেবুখালী মডেল’ (অলবণাক্ত এলাকা) ও ‘কলাপাড়া মডেল’ (লবণাক্ত এলাকা) এবং নোয়াখালী এলাকার জন্য ‘আটকাপালিয়া মডেল’।

এ ক্ষেত্রে বসতবাড়ির সম্ভাব্য সব জায়গার সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে যতটা বেশি সম্ভব সবজি (লালশাক, ডাঁটাশাক, পুঁইশাক, গিমা কলমি, পালংশাক, ধনেশাক, কচুশাক ও কচু, টমেটো, বেগুন, মুলা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি, শিম, বরবটি, লাউ, করলা, চালকুমড়া, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, ঢেঁড়স, আলু ইত্যাদি), মসলা (বিলাতি ধনে, পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, হলুদ ইত্যাদি) এবং ফল (আম, পেয়ারা, লেবু, কুল, লিচু, পেঁপে, আনারস ইত্যাদি) উৎপাদনের চেষ্টা করা হয়েছে এবং চমৎকার ফল পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ সবজি, মসলা ও ফলের ক্ষেত্রে বারি উদ্ভাবিত জাত ব্যবহার করা হয়েছে।

মডেল অনুযায়ী বসতভিটার রৌদ্রযুক্ত স্থানে চার-পাঁচটি বেড তৈরি করে, বাগানের ও বাড়ির চারপাশের বেড়ায়, মাচায়, আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে, ভেজা/স্যাঁতসেঁতে স্থানে, ঘরের পেছনের পরিত্যক্ত স্থানে, অফলা/বনজ বৃক্ষে এবং ঘরের চালে নির্দিষ্ট ফসলবিন্যাস অনুসরণ করে বছরে ১২ থেকে ২৪ ধরনের সবজি ক্রমান্বয়ে উত্পাদন করা যায়। ফলে একটি কৃষক পরিবার সারা বছর সবজি কমবেশি সংগ্রহ করে তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারে।

এ ছাড়া উত্পাদিত মসলা ও ফল দিয়ে পরিবারের প্রয়োজন অনেকাংশে পূরণ করা যায়। গবেষণায় দেখা যায়, অংশগ্রহণকারী কৃষক পরিবারের সদস্যরা গবেষণা শুরুর আগে এলাকাভেদে প্রতিদিন মাথাপিছু ৬৮ থেকে ১১০ গ্রাম সবজি গ্রহণ করত (বয়সভেদে একজন ব্যক্তির দৈনিক ৮৮ থেকে ২২০ গ্রাম সবজি গ্রহণ করা দরকার)। মডেল অনুযায়ী সবজি আবাদ করার পর তাদের সবজি গ্রহণের পরিমাণ দাঁড়ায় মডেল ও এলাকাভেদে প্রতিদিন মাথাপিছু গড়ে ৮৮ থেকে ২৩৬ গ্রাম।

প্রসঙ্গত , যেসব কৃষকের বসতবাড়িতে এই গবেষণাকাজ পরিচালনা করা হয়েছিল, দু-তিন বছর পর তাঁদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁরা কিছু শাক-সবজি আবাদ করলেও মডেলগুলো আর হুবহু অনুসরণ করছেন না। কারণ হিসেবে তাঁরা জানান, গবেষণার মাধ্যমে বসতবাড়িতে সারা বছর সবজি চাষের যে মডেল উদ্ভাবন করা হয়েছে, তা খুবই কার্যকর ও উত্তম; কিন্তু যথাসময়ে বীজ ও সারের জোগান না থাকায় তাঁরা মডেলগুলো অনুসরণ করতে পারছেন না।

কেউ কেউ আবার সময় ও জনবলের অভাবের কথাও বলেছেন। এখানে উল্লেখ্য, বসতবাড়িতে এসব ফসল চাষে নারী ও শিশুরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাই যথাসময়ে প্রয়োজনীয় বীজ বা চারা ও সার তাঁদের হাতের নাগালে পৌঁছে দেওয়া গেলে বসতবাড়িতে সবজি, মসলা ও ফল উত্পাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। গ্রামীণ বসতভিটাগুলোতে সুপরিকল্পিতভাবে শাক-সবজি, ফলমূল ও মসলা উত্পাদন উৎসাহিত করার জন্য সরকার বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে অথবা প্রতিবছর সরকার কৃষি খাতে যে ভর্তুকি প্রদান করে তার কিছু অংশ দিয়ে যথাসময়ে কৃষকের দোরগোড়ায় মানসম্পন্ন বীজ ও সারের জোগান নিশ্চিত করা যেতে পারে (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং এর তত্ত্বাবধানে সুপ্রতিষ্ঠিত এনজিওসমূহের মাধ্যমে)।

বসতবাড়িতে শাক-সবজি, ফলমূল, মসলা ইত্যাদি উত্পাদনের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা কোনো বেসরকারি সংস্থার প্রকল্প চলমান থাকলে সেখানে বারি উদ্ভাবিত প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত ও যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। আর কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে সাহায্য করতে পারেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, মাঠকর্মী এবং বারির বিজ্ঞানীরা।

লেখক : ড. মো. রফিকুল ইসলাম, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মহাপরিচালকের দপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর , ২১ জুলাই ২০২০

Share