নিত্যপণ্যের বাড়তি দরে নতুন বছর ২০২১ শুরু হল। চাল থেকে শুরু করে ডাল, ভোজ্যতেল, মাছ-মাংস, মসলা জাতীয় পণ্য সব কিছুর দামই চড়া। চাহিদা অনুপাতে কম কেনাকাটা করছেন অনেকে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যের দামে নাভিশ্বাস ওঠা ভোক্তা নতুন বছরেও ভোগান্তির শিকার হতে পারেন। এ বাড়তি চাপ তাদের জীবনমানের ওপরও প্রভাব ফেলবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বেন নিু ও সীমিত আয়ের মানুষ।
অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পুরনো সিন্ডিকেটের কারসাজিতে মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন সময় সিন্ডিকেটের সদস্যদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের কখনও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়নি। ফলে নানা ইস্যুতে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে তারা বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। আর সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে তারা অল্প সময়ে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
৩১ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, এক বছরের ব্যবধানে মোটা চাল কেজিতে ৪৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ দাম বেড়েছে। মাঝারি আকারের চাল কেজিতে বছরের ব্যবধানে ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি কেজি সরু চাল বছরের ব্যবধানে ২০ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতি কেজি মসুর ডাল বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ২৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ভোজ্যতেল বছরের ব্যবধানে লিটারে সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। মাসের ব্যবধানে রসুন ২৩ দশমিক ৫৩ ও হলুদ ১৮ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। জিরা, লবঙ্গ ও দারুচিনির দামও বেড়েছে। এছাড়া বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি রুই ২৭ দশমিক ২৭ শতাংশ, গরুর মাংস ৪ দশমিক ৬৩, খাসির মাংস ৬ দশমিক ৬৭, কেজিতে ব্রয়লার মুরগি ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বর্তমান বাজার ব্যবস্থা ক্রেতাদের জন্য নয়, বিক্রেতাদের জন্য। অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে এমন হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতো সৎ সাহস কারও হচ্ছে না। এ কারণে এটি একটি দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়েছে। আর সাধারণ মানুষ এ দুষ্ট চক্রের হাতে জিম্মি। তিনি বলেন, মূল বিষয় হল- সুশাসনের ঘাটতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। এখানে কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। সুশাসন নিশ্চিত না হলে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
আন্তর্জাতিক শ্রম ও সংস্থা আইএলও এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য অনুসারে করোনায় নতুন করে দেশে এক কোটি লোক দরিদ্র হয়েছে। এছাড়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতার কারণে অধিকাংশ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। আর এসব সংস্থা যখন এ ধরনের দুরবস্থার সংবাদ দিচ্ছে, সেই সংকটের মধ্যে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামের কারণে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ছেন।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৬৭ টাকা। যা ১ মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা। পাইজাম চাল প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা। যা ১ মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকা। প্রতি কেজি মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা। যা ১ মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকা। পাশাপাশি প্রতি কেজি মাঝারি দানার মসুরের ডাল বিক্রি হয়েছে ৯৫-১০০ টাকা। যা ১ মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৫ টাকা।
ভোজ্যতেলের মধ্যে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১০৯-১১০ টাকা। যা ১ মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১০০-১০৪ টাকা। আর গত বছর একই সময় বিক্রি হয়েছে ৮৫-৮৬ টাকা। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১২৫ টাকা। যা ১ মাস আগেও ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর গত বছর একই সময় বিক্রি হয়েছে ১০০-১১০ টাকা। পাম অয়েলও চড়া দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি লিটার পাম অয়েল সুপার বিক্রি হয়েছে ১০০-১০২ টাকা। যা ১ মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৯০-৯৫ টাকা। আর ১ বছর আগে একই সময় বিক্রি হয়েছে ৭৫-৭৬ টাকা।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমার ইয়ুথ বাংলাদেশের (সিওয়াইবি) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, বাজারে পুরনো সিন্ডিকেট বারবার সক্রিয় হচ্ছে। সুযোগ বুঝে তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এ কারণে ভোক্তারা নিত্যপণ্যের বাজারে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, সিন্ডিকেটের সদস্যদের চিহ্নিত করা হলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয় না। এ কারণে এবারও তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাই তাদের কঠোর আইনের আওতায় আনা হলে ভোক্তার সুফল মিলবে।
বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সরকারি পরিচালক আবদুল জব্বার মণ্ডল বলেন, অধিদফতরের মহাপরিচালকের নির্দেশে আমরা নতুন বছরে বাজার তদারকি ব্যবস্থা নতুন করে সাজিয়েছি। সেই আঙ্গিকে তদারকি অভিযান পরিচালনা করব। কোনো ধরনের অনিয়ম পেলে কোনো ছাড় নেই। আশা করি নতুন বছরে পণ্যমূল্য ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।
খুচরা বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি রুই বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। যা ১ মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৩০০-৩৫০ টাকা। প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৫৮০ টাকা। যা গত বছর একই সময়ের তুলনায় ৩০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি খাসির মাংস বিক্রি হয়েছে ৮৫০ টাকা। যা গত বছর একই সময়ে বিক্রি হয়েছে ৮০০ টাকা। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৩৫ টাকা। যা ১ মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা।
রাজধানীর নয়াবাজারের ক্রেতা রিয়াদুল ইসলাম বলেন, ২০২০ সালজুড়ে নিত্যপণ্যের বাড়তি দর ছিল। একেক সময় একের পণ্যের দাম নিয়ে কারসাজি করেছে বিক্রেতারা। এতে তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। এ বাড়তি দর নিয়েই নতুন বছর শুরু হচ্ছে। তাই পণ্যের দাম কমাতে সংশ্লিষ্টদের ভালোভাবে ভূমিকা পালন করতে হবে। এতে ভোক্তারা সন্তুষ্ট হবেন।
ঢাকা ব্যুরো চীফ,১ জানুয়ারি ২০২১