ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে জীবনে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু ভাগ্য তার দিকে ফিরে তাকায়নি। তাই ঘুরেনি জীবনের চাকাও। জীবন চলেছে তার নিয়মেই। জীবন সায়াহ্নে এসে বাকিটা সময় নিজের মতো ভালো থেকে পথ চলতে চান তিনি। বলছি, আবদুল মান্নানের কথা, যিনি প্রায় চার দশক ধরে রয়েছেন এফডিসির চার দেয়ালের মধ্যেই।
পেশা হিসেবে কখনো ছিল ক্যান্টিন বয়ের কাজ, কখনো বা ফল বিক্রি করেছেন মান্নান। এরপর থেকে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি এফডিসিতে ঝালমুড়ি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
সন্ধ্যা নামার আগে আবদুল মান্নানের সঙ্গে কথা হয় । সে সময় প্রয়াত চিত্রনায়ক মান্নার সঙ্গে সখ্যসহ জীবনের বহু বিষয় তুলে ধরেন তিনি।
এফডিসিতে আসা যেভাবে
আবদুল মান্নান জানান, মুক্তিযুদ্ধের পরপরই তিনি কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন এক আত্মীয়ের সঙ্গে। তখন পড়াশোনায় স্কুলের গণ্ডি আর পেরোনো হয়নি। ঢাকায় আসার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনায় ইতি। বেশ কয়েক মাস একটি বাসায় ১০ টাকা বেতনে কাজ করেন। যদিও সেখানে তিনি খুব বেশি দিন ছিলেন না। এরপর তার সেই আত্মীয়ের হাত ধরেই এফডিসির সরকারি ক্যান্টিনে কাজ শুরু করেন। সে সময় তার মাসিক বেতন ছিল ৩০০ টাকা। কিন্তু ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই চাকরিটিও ধরে রাখতে পারলেন না তিনি।
ফল ও ঝালমুড়ি বিক্রি শুরু
জীবনের রূঢ় বাস্তবতা সামনে এসে দাঁড়ায় ক্যান্টিন বন্ধ হওয়ার পর। ততদিনে পরিবার থেকেও বিয়ের জন্য মান্নানের ওপর চাপ আসতে শুরু করে। এরপর হঠাৎ করেই একজনের পরামর্শে এফডিসি প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ভেতরে আমড়া, কামরাঙ্গা, আমসহ বিভিন্ন ফলের পসরা সাজিয়ে বসেন তিনি। পাশাপাশি সুযোগ মিললেই ছবিতে এক্সট্রা আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও আসেনি স্বচ্ছলতা। তারপরই একজনের কাছ থেকে ৭৫ টাকা দিয়ে বর্তমানের ঝালমুড়ির দোকানটি কিনেন মান্নান।
বহু ছবিতে অভিনয়
প্রায় চার দশকের এফডিসিকেন্দ্রিক জীবনে আবদুল মান্নান এক্সট্রা আর্টিস্ট হিসেবে অভিনয় করেছেন ৩০টিরও বেশি ছবিতে। একেক ছবিতে তিনি একেক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাকে দেখা গেছে রাজ্জাক, শাবানা, ববিতা, সালমান শাহ, মান্না ও শাকিব অভিনীত ছবিতে।
এফডিসির এই ঝালমুড়ি বিক্রেতার অভিনীত প্রথম ছবি হলো ‘বাংলার হিরো’। তারপর ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ধনবান’, ‘অনাহার’, ‘আম্মাজান’, ‘মালা’সহ আরও বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন। সবশেষ তার অভিনীত ‘আমি নেতা হব’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। এতে প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাকিব খান ও মিম।
আবদুল মান্নান এফডিসির ক্যান্টিনের ডান পাশে দাঁড়িয়ে তার জীবনের গল্প শোনাচ্ছিলেন। কথা বলতে বলতে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল জল। অন্যদিকে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছিল। গলার স্বরও ভারী হয়ে উঠেছিল। কিছুটা সময় চুপ করে রইলেন।
একটু দূরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে, ডান হাত দিয়ে চোখ মুছলেন। যদিও বা হাত দিয়ে কিছু করতে পারেন না প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার কারণে। কথার স্বরও কিছুটা অস্পষ্ট।
মান্না মারা যাওয়ায়…
এক জীবনে রূপালি পর্দার অনেক তারকাকেই চোখের নাগালে পেয়েছেন এই ব্যক্তি। বহু অভিজ্ঞতাও সঞ্চার করেছেন তিনি। রূপ আর রং বদলের খেলাই দেখেছেন। এখন সেসব শুধুই ধূসর স্মৃতি। অনেকের জীবন ঠিক রূপালি পর্দার গল্পের মতোই বদলে যেতেও দেখেছেন। কিন্তু তার জীবনের গল্পটাই পাল্টায়নি। নায়ক মান্না বেঁচে থাকলে এ অবস্থা হতো না বলে মনে করেন তিনি।
মান্নার সঙ্গে সখ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মান্নান বলেন, ‘নায়ক মান্না বাঁইচা থাকলে আমার এমন দুর্দশা হইত না। কত কষ্টই না করছি, ভালো থাকার জন্য। মান্না নাই, তাই আমার কিছুই নাই। ও থাকলে আমার বাড়ি-ঘর সবই হইত।
এইখানকার ৯০ ভাগ লোকের মুখের কথার ঠিক নাই। অনেকে উপকার করার কথা বললেও পরে আর করে নাই। আর মান্না মারা যাওয়ার পর আমিও আর ঘুরে দাঁড়াতে পারি নাই, একা হয়ে গেছি। তারপর থেকে কোনো হিরো আমার এখানে আসেও না, যোগাযোগও করে না।’
মান্না মারা যাওয়ার পরই জীবনে ঝামেলা শুরু হয় উল্লেখ করে মান্নান বলেন, ‘আমার একটা হাত প্যারালাইস (প্যারালাইজড), যার কারণে কাজ করতে আমার খুব কষ্ট হয়। আটজনের সংসার। সবাই কুমিল্লাতেই থাকে। তারপরও এক হাতে ভর করে সবকিছু করতে হয়। এক হাতেই আমার সংসার চলে।’
একটা সময় মান্নান প্রতি বৃহস্পতিবার কুমিল্লার বাড়িতে যেতেন। তখন মান্না তাকে হাজার দুয়েক টাকা দিতেন। একবার ভীষণ অসুস্থ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। দুই হাতে কাজ করার জন্য শক্তি পেতেন না। তখনও তার পাশে মান্না দাঁড়িয়েছিলেন। চিকিৎসার সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ২০ হাজার টাকাও দিয়েছিলেন।
এখনকার শিল্পীরা খোঁজখবর নেন কি না জানতে চাইলে মান্নান বলেন, ‘আগের মতো এখন আর কোনো আর্টিস (আর্টিস্ট) নাই। তাগো মধ্যে আন্তরিকতা নাই। মিল-মহব্বত তো নাই।
আমার দোকানে আইসা শাবনূর, মান্না, পূর্ণিমা মুড়ি খাইত। এ ছাড়াও আরও অনেকেই ছিল। কে আমার বানানো মুড়ি খায় নাই? এখন তারা আসে না, আমার মুড়িও চলে না। আমি তো কই, আগের মতো শুটিংও নাই, মুড়িও নাই।’
সিনেমার সোনালি যুগে দৈনিক চার-পাঁচ কেজি মুড়ি বিক্রি হতো। এখন সেটা এক-দেড় কেজি। টাকায় ৩০০-৪০০।
শুটিং কমে যাওয়ার কারণেই এফডিসির এমন অবস্থা বলে জানান মান্নান। তার ভাষ্য, ‘এখন তো আর শাবানা, ববিতা, কবরী, রাজ্জাক, শাবনুর, পূর্ণিমারা শুটিং করে না, যার কারণে মানুষও তেমন আসে না। বেচা-বিক্রিও হয় না। এখন শুধু শাকিব এফডিসিতে আইলেই বেচা ভালো হয়। এ ছাড়া এফডিসি খুব কম সময়ই জমজমাট হয়।’
এফডিসির মসজিদে রাত্রিযাপন
ঝালমুড়ি বিক্রি করে যে টাকা আয় হয়, তা খুব কম। এর মধ্যে প্রতি মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। এ কারণে আলাদা করে বাসা ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য তার নেই। তাই এফডিসির মসজিদেই ঘুমান তিনি। পাশাপাশি মসজিদের কিছু কাজও করেন, যখন যে কাজে তাকে প্রয়োজন হয়। আর সকাল ১০টার পর থেকেই তিনি ঝালমুড়ি বিক্রির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন। রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বিক্রি চলতে থাকে।
‘আমার এখন প্রতি মাসে দুই হাজার টাকার ওষুধ লাগে। কিন্তু যে টাকাই আয় করি, সেইটা দিয়ে সংসার ও জীবন চালাইতে অনেক বেশিই কষ্ট হয়ে যায়’, বলেন মান্নান।
স্বচ্ছল জীবনের আশা এখনো ছেড়ে দেননি মান্নান। মাঝে মাঝেই তিনি ভাবেন, কোনো এক পরশ পাথরের ছোঁয়ায় হুট করেই বদলে যাবে জীবন। কিছু সময় কাটবে তার নিজের খেয়ালেই। কিন্তু বাস্তবতা এসে হুট করেই স্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে দেয়। তখন তার মনে বেজে উঠে, ‘যতদিন বাঁইচা আছি, ততদিন কষ্ট কইরাই যাইতে হবে। সংসার তো চালাইতে হবে।’-প্রিয় নিউজ