সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে চাঁদপুরের শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ ব্যাপক আকারে বেড়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত সামাজিক প্রতিযোগিতামূলক কর্মকা-ে নারীদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত হচ্ছে। এ কারণেই চাঁদপুরে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে ছেলে শিক্ষার্থীর তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা প্রতিনিয়তই এগিয়ে চলছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের ফলাফলেও মেয়েরাও ভালো করছে। ফলে চাঁদপুরের প্রতিটি পারিবারিক, সমাজিক ও সংসার জীবনের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির কারণে জেলার সর্বত্র কম-বেশি অগ্রগতি যেমন বাড়ছে, তেমনি ধনী-গরিব সবার মাঝে শিক্ষার আলো ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
এদিকে জেলা শিক্ষা অফিসের সূত্রমতে, জেলায় স্কুল এন্ড কলেজ, মাধ্যমিক, নি¤œ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ২ লাখ ১৫ হাজার ২শ’ ৩৯ জন। এর মাঝে ছাত্র ৮৭ হাজার ৭শ’ ৬১ জন, আর ছাত্রী ১ লাখ ২৭ হাজার ৪শ’ ৭৮ জন। মাদ্রাসাভিত্তিক কামিল, ফাজিল, আলিম ও দাখিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮২ হাজার ৫শ’ ৪৬ জন। তাদের মাঝে ছাত্র ৩৬ হাজার ২শ’ ৭৪ জন আর, ছাত্রী ৪৬ হাজার ২শ’ ৭২ জন। অপরদিকে ¯œাতকোত্তর, ¯œাতক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৯ হাজার ৯শ’ ৩৭ জন। তাদের মাঝে ছাত্র ২৯ হাজার ৩শ’ ৭২ জন, আর ছাত্রী ৩০ হাজার ৫শ’ ৬৫ জন। অর্থাৎ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই নারী শিক্ষার্থী বেশি।
জেলা শিক্ষা অফিস জানায়, জেলায় নি¤œ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, স্কুল এন্ড কলেজ, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মোট ৫শ’ ১৭টি। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষার্থী ৩ লাখ ৬০ হাজার ২শ’ ২৩ জন। এর মধ্যে ছাত্র ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮শ’ ৭০ জন, ছাত্রী ২ লাখ ৫ হাজার ৩শ’ ৫৩ জন।
কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াই এ জেলায় মেয়ে শিক্ষার্থীর সাংখ্যাই বর্তমানে অর্ধলাখের বেশি। তাই নারীদের নিয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের কালজয়ী উক্তি ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’- এর বাস্তব প্রতিফল এখন এ জেলার সমাজে অনেকটাই প্রভাব ফেলছে। একটি সময় ছিল সারা দেশে যখন নারীরা অবেহেলিত হতো। তখন নারী শিক্ষাকে সমাজিকভাবে অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। এমনি অকল্পনীয় বাস্তবতায় সমাজে আলোর দূত হয়ে আসেন বেগম রোকেয়ার মত মহয়সী নারী। তিনি নারী শিক্ষাকে জাগিয়ে তুলেন এ সমাজে।
বেগম রোকেয়ার দেখানো পথের দীর্ঘ অপক্ষোর পর অবশেষে ’৯০ দশকে দেশে ব্যাপক নারী শিক্ষার অগ্রগতির সূচনা শুরু হয়। তার সাথেই এগিয়ে চলে চাঁদপুরের নারী শিক্ষা। ফলে আজকের সামাজিক পরিবর্তনে সহায়ক হয় নারী শিক্ষার জন্য। আর নারী শিক্ষায়ও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বেড়েছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকরি সুযোগ-সুবিধা। যার প্রভাবেই নারী শিক্ষার সাফল্য এখন বাস্তবতা।
এজন্য কবি নজরুল যর্থাথই বলেছেন ‘সেদিন সুদূর নয়, যেদিন ধরনী পুরুষের সাথে, গাহিবে নারীরও জয়’। তাই এ জেলার কর্মজীবীর সংখ্যায়, শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব স্থানেই সমানতালে অবদান রেখে চলছে স্থানীয় নারী শিক্ষার্থীরা।
পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে ’৯২ সাল হতে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার পর পর্যাক্রমে শিক্ষা ক্ষেত্রে আসে ব্যপক পরিবর্তন। ছেলেদের সাথে মেয়েদের উপস্থিতিও নিশ্চিত হয়। আর মেয়েদের উপস্থিতি ধরে রাখতে সরকার চালু করে অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা। তার সাথে যোগ করে উপবৃত্তি। তার সুফলতায় সারা দেশে ব্যাপক সারা জাগিয়েছে নারীর শিক্ষায়। ফলে জেলা শিক্ষা অফিসের মতে, চাঁদপুরের শিক্ষা ক্ষেত্রে ছেলেদের তুলনায় অনেকদূর এগিয়ে রয়েছে এ জেলার মেয়েরা।
জানা গেছে, জেলার অধিকাংশ পারিবারের অর্থিক অনটন, বাল্যবিবাহ, অস্বচ্ছলতা ও নানা প্রতিবন্ধকতায় বার-বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে নারী শিক্ষা। এছাড়া সামাজিক অসঙ্গতির কারণেও দেশের অনান্য জেলার মত চাঁদপুরেও মেয়েদের ক্রমান্নয়ে শিক্ষা অর্জনের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। বিশেষ করে গত এক দশকে এ জেলায় মেয়েদের শিক্ষার অগ্রগতি হয়েছে ব্যাপক। ফলে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এখন অনেক এগিয়ে।
ফলে আজ সমাজে প্রতিফলন ঘটছে বিখ্যাত সৈনিক নেপোলিয়নের যুক্তিই। নেপোলিয়নের ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো’। আজকের নারী শিক্ষার অগ্রগতি বলে দেয় কতটা এগিয়েছে তারা। যার জন্য প্রতিটি শিক্ষা ক্ষেত্রে দেখা যায় ছেলেদের তুলনায় মেয়দের সংখ্যা বেশি। মেয়েদের এ অগ্রগতির হার বৃদ্ধির কারণেই তাদের পারিবারিক জীবনেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আর এজন্যই প্রতি বছর জেলায় ঝড়ে পরা শিশুর সংখ্যা কমে আসছে বলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়। আর প্রতিনিয়তই বাড়ছে শিক্ষিত পরিবারের সংখ্যাও।
শিক্ষাবিদসহ সচেতন মহলের মতে চাঁদপুর জেলায় নারী শিক্ষার এই অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে পারলে ভবিষতে শিক্ষাঙ্গনে আলো ছড়াবে মেয়েরাই। এজন্য অভিভাবকসহ সরকারের আন্তরিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবারের মেয়েদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে যুগপোযোগী সিদ্ধান্ত এখনি নিতে হবে। তার সাথে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা জোরালো করতে হবে বলে অভিমত দেন শিক্ষার্থীরা।
তবে বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে দারিদ্র ও অস্বছল পরিবারের মেয়েদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে সফলতা আরো বাড়বে বলে আশাবাদী জেলার শিক্ষাবিদরা। তাই নারী শিক্ষার অগ্রগতি যাতে কোনো বাধার সম্মুখীন না হয় সেজন্য সবাইকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান সচেতনমহল।
রেজাউল করিম
||আপডেট: ০৮:৪৫ পিএম, ০৫ নভেম্বর ২০১৫, বৃহস্পতিবার
এমআরআর