Home / বিশেষ সংবাদ / দেশজুড়ে প্রতারণার ফাঁদ : প্রলোভনে তরুণ-তরুণীরা সদস্য হচ্ছে
দেশজুড়ে প্রতারণার ফাঁদ

দেশজুড়ে প্রতারণার ফাঁদ : প্রলোভনে তরুণ-তরুণীরা সদস্য হচ্ছে

একের পর এক প্রতারণার পরও দেশে বন্ধ হয়নি বহুস্তর বিপণন পদ্ধতির (এমএলএম) কোম্পানির প্রতারণার ফাঁদ। ডেসটিনির পর এবার দেশজুড়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ নামের একটি এমএলএম কোম্পানি। অধিক অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সদস্য বানাচ্ছে সহজ-সরল তরুণ-তরুণীদের।

এর মাধ্যমে নিম্নমানের ইলেকট্রনিক সামগ্রী প্রকৃত দামের তুলনায় ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি দামে সদস্যদের ধরিয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা। আর ভবিষ্যৎ আয়ের আশায় তাদের সেই পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছেন বেকারত্বের অভিশাপে ভুক্তে থাকা তরুণ-তরুণীরা।

ডেসটিনির প্রতারণা ফাঁস হওয়ার পর সরকারের দৌড়ঝাঁপে কিছুদিনের জন্য ঝিমিয়ে পড়েছিল এমএলএম কোম্পানিগুলোর ব্যবসা। তবে সম্প্রতি দেশজুড়ে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে ‘ওয়ার্ল্ড মিশন ২১’ নামের কোম্পানিটি।

রাজধানীর বিজয়নগরে হোটেল ৭১-এর পাশের ভবনে অফিস স্থাপন করে প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কোম্পানির ব্যবসা যে বেশ রমরমা হয়ে উঠেছে তা এই অফিসে আসাদের সমাগম দেখে সহজেই বোঝা যায়। প্রতিদিন হাজারের অধিক মানুষের যাতায়াত এই অফিসটিতে।

এই এমএলএম কোম্পানির মালিক হিসেবে রয়েছেন চারজন। এদের মধ্যে চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন বগুড়ার আশরাফুল আলম। ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে চট্টগ্রামের কামরুল হাসান চৌধুরী। বাকি দুই মালিকের মধ্যে কোম্পানির মার্কেটিং ডিরেক্টর হিসেবে আছেন গাজীপুরের জাকির হোসেন ও ফিন্যান্স ডিরেক্টর এস এম জিয়াউর রহমান। এদের সবাই এক সময় ডেসটিনির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়ার্ল্ড মিশন ২১-এর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মালিকদের মধ্যে আশরাফুল আলম অবসরপ্রাপ্ত একজন সেনা কর্মকর্তা। আর জাকির হোসেন স্বপ্নচূড়া আবাসন সাং বিল্ডার্স-এর মালিক ও এস এম জিয়াউর রহমান গাজীপুরের নাহার ফার্ম হাউস-এর মালিক।

এই প্রতিবেদক ভিন্ন পরিচয় দিয়ে সদস্য হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতেই প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ পরিচয়দানকারী আবুল হাসান নিয়ে যান তার ডেস্কে (টেবিল)। আবুল হাসানের কক্ষটিতে আরও ২৪টি ডেস্ক রয়েছে। প্রতি টেবিলে একজন কর্মকর্তা ও ৪-৫ জন সদস্য হতে চান এমন আগ্রহীরা রয়েছেন।

সদস্য বানানোর উদ্দেশ্যে আবুল হাসান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মানুষের আয়ের তিনটি উপায় রয়েছে। এগুলো হলো— চাকরি, ব্যবসা অথবা বিদেশ যাওয়া। কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষে চাকরি পাওয়া যাবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর ব্যবসা অথবা বিদেশ যেতে হলে মোটা অঙ্কের টাকা প্রয়োজন। কিন্তু ওয়ার্ল্ড মিশন ২১-এ মাত্র সাড়ে ৫ হাজার টাকার পণ্য কিনে সদস্য হওয়ার মাধ্যমে মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।’

এটি কীভাবে সম্ভব? প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, ‘আপনি সাড়ে ৫ হাজার টাকা দামের একটি মোবাইল ফোন কিনলেই সদস্য হয়ে যাবেন। এরপর কোম্পানির পণ্য বিক্রির জন্য পরিচিতদের মধ্যে বিজ্ঞাপন মাধ্যম হয়ে কাজ করবেন। এতে আপনার কথায় যদি কেউ ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ থেকে কোনো পণ্য কেনেন তাহলে আপনি পেয়ে যাবেন ৫শ’ টাকা কমিশন। আর দু’জন আপনার মাধ্যমে পণ্য কিনলে আপনি পাবেন ১ হাজার টাকা কমিশন। সেই সঙ্গে দু’জনের কাছে পণ্য বিক্রি করার কারণে রাইট হ্যান্ড ও লেফট হ্যান্ড হিসেবে ম্যাচিং করায় পাবেন আরও ৫শ’ টাকা কমিশন। অর্থাৎ দু’জনের কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারলেই এক দিনে ১৫শ’ টাকা কমিশন পাওয়া যাবে। এভাবে একজন দিনে ১০টি পণ্য বিক্রি করতে পারলেই কমিশন বাবদ পেয়ে যাবে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। এ ছাড়া আপনার অধীনে যারা পণ্য কিনবেন তারা আরও দু’জনের কাছে পণ্য বিক্রি করলে পাওয়া যাবে ৫শ’ টাকা কমিশন। এভাবে অধীনস্ত ও অধীনস্তদের অধীনস্তের পণ্য বিক্রির মাধ্যমে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন পাওয়া যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিনের এই কমিশন ছাড়াও আছে মাসিক কমিশন। এ জন্য লেফট হ্যান্ডে ৫০ জন ও রাইট হ্যান্ডে ৫০ জন অর্থাৎ ১শ’ জনের কাছে পণ্য বিক্রি করতে হবে। কেউ এটি করতে পারলে তার পদবি হবে মার্কেটিং এ্যাসিস্ট্যান্ট। এরপর অধীনস্তদের পণ্য বিক্রি থেকে তিনি প্রতিদিনের কমিশনের সঙ্গে মাসিক ভিত্তিতেও কমিশন পাবেন। আর তার অধীনে কেউ মার্কেটিং এ্যাসিস্ট্যান্ট হলে তার পদবি বেড়ে হবে এ্যাসিস্ট্যান্ট মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ। পদবি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে কমিশনের হার। এরপর অধীনস্ত কেউ এ্যাসিস্ট্যান্ট মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হলে পদবি বেড়ে হবে মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ। আর মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হলেই মিলবে কক্সবাজার ভ্রমণ ও দুই দিন পাঁচতারা হোটেলে থাকা ও খাওয়ার সুযোগ। এভাবে অধীনস্তদের পদবি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে নিজের পদবি। মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ পদের পরের পদ সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হলেই কোম্পানি বিমানযোগে নেপাল ভ্রমণে নিয়ে যাবে। এভাবে পদবি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিলবে ৫টি দেশ ভ্রমণের সুযোগ।’

‘ভাই আমি তো ছাত্র, টিউশনি করে চলি, একসঙ্গে সাড়ে ৫ হাজার টাকা দেওয়া তো আমরা জন্য কষ্টকর’— এমন কথা বলতেই আবুল হাসান বলেন, ‘সে জন্যও আমাদের একটা প্যাকেজ আছে। সেক্ষেত্রে আপনি ৪ হাজার টাকা দিয়ে আমাদের সদস্য হতে পারবেন। তবে এর জন্য আপনাকে কোনো পণ্য দেওয়া হবে না। কিন্তু পণ্য বিক্রি করে কমিশন পাবেন। পরবর্তীকালে বাকি দেড় হাজার টাকা পরিশোধ করলে আপনিও একটি মোবাইল ফোন পেয়ে যাবেন।’

এভাবেই ওয়ার্ল্ড মিশন ২১-এর সদস্য করতে প্রতিদিন হাজারের অধিক যুবক-যুবতীকে (যাদের অধিকাংশ বেকার) দেওয়া হচ্ছে নানা প্রলোভন। আর বেকারত্বের অভিশাপে ভুক্তে থাকাদের একটি বড় অংশ পা দিচ্ছে তাদের পাতা সেই ফাঁদে।

আবুল হাসানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওয়ার্ল্ড মিশন ব্যান্ড নামে যে পণ্য বিক্রি করা হয় তা চীন থেকে এনে বাংলাদেশ ফিটিং করা হয়।

তবে প্রতিষ্ঠানটি সাড়ে ৫ হাজার টাকায় যে মোবাইল ফোন বিক্রি করছে বাজারে সেই মানের একটি চীনা মোবাইল ফোনের দাম কিছুতেই ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকার বেশি হবে না। আর সাড়ে ১৩ হাজার টাকায় থ্রি-জি স্মার্ট ফোন নামে যে ফোনটি বিক্রি করছে, সেই মানের একটি সিম্ফনি মোবাইলের দাম সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল হাসান বলেন, ‘আমাদের পণ্য চীন থেকে আনা হলেও, এটি স্যামসাং ও নকিয়ার সমমানের। তাই দাম বেশি। আর আমাদের টাচ স্ক্রিনের মোবাইলগুলোর টাচ খুবই স্মুথ ও দ্রুত ইন্টারনেট গতিসম্পন্ন। অন্য চীনা ফোনের মতো না।’

তবে আবুল হাসানের কাছে থাকা ওয়ার্ল্ড মিশন ২১-এর মোবাইলটি নিয়ে দেখা গেলে টাচ খুবই নিম্নমানের। কোনো একটি অপশনে যেতে জোরে জোরে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ বার স্পর্শ করতে হয়।

এর কারণ হিসেবে আবুল হাসান বলেন অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে টাচ দুর্বল হয়ে গেছে। এরপর অফিসটির এক পাশে থাকা প্রতিষ্ঠানটির শো-রুমে গিয়ে মোবাইল স্পর্শ করতে গেলে তা স্পর্শ করতে দেওয়া হয়নি। বলা হয়, পণ্য কেনার পর স্পর্শ করবেন। পণ্য স্পর্শ করা যাবে না— এ বিষয়টি পণ্য রাখা টেবিলের উপর কাগজেও লিখে রাখা হয়েছে।

বিভিন্ন জেলা থেকে অফিসটিতে সদস্য হওয়ার আগ্রহ নিয়ে আসা এমন ১৮ জনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। এদের ১৩ জনই দরিদ্র পরিবারের বেকার যুবক। আর বাকি ৫ জন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ১০ জন (ছাত্র ৪ জন ও বেকার যুবক ৬ জন) প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন তারা সদস্য হবেন কি না পরের দিন জানাবেন। এ সময় তাদের দিয়ে একটি আগ্রহ ফরম পূরণ করে নেওয়া হয়। এর বিনিময়ে নেওয়া হয় ৫ টাকা করে।

সরকার দেশে কোনো এমএলএম কোম্পানিকে ব্যবসা করতে লাইসেন্স না দিলেও প্রকাশ্যে প্রতারণার মাধ্যমে সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে এভাবেই টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওয়ার্ল্ড মিশন ২১।

এমএলএম ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রণয়ন করা হয় মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন। এই আইনের অধীনে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে করা হয় বিধিমালা, যা আবার সংশোধন করা হয় ওই বছরেরই ২২ জুলাই। আইনে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। আর লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা করা হয় যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়কে (আরজেএসসি)।

আইনে বলা হয়, পিরামিডসদৃশ বিপণন কার্যক্রম চালানো, সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ মোড়কজাত না করে পণ্য বিক্রি, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পণ্য বা সেবা বিক্রি না করা, পণ্য বা সেবার অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ, নিম্নমানের পণ্য বা সেবা বিক্রি করা এবং অসত্য, কাল্পনিক ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

আইন হওয়ার পর ২০১৪ সালের ৫ মার্চ এক বছরের জন্য ‘এমএক্সএন মডার্ন হারবাল ফুড’, ‘ওয়ার্ল্ড মিশন ২১’, ‘স্বাধীন অনলাইন পাবলিক লিমিটেড’ ও ‘রিচ বিজনেস সিস্টেম’ নামে চারটি এমএলএম কোম্পানিকে অনুমোদন দেয় আরজেএসসি। যার মেয়াদ গত বছরের ৪ মার্চ শেষ হয়েছে। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ থাকায় এই কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স আর নবায়ন করেনি আরজেএসসি। সেই সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হয় এমএলএম কোম্পানির নিবন্ধন।

সরকার অনুমোদন না দেওয়ার পরও এমএলএম ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ার্ল্ড মিশন ২১-এর অন্যতম উদ্যোক্তা জাকির হোসেন বলেন, ‘সরকার আমাদের লাইসেন্স নবায়ন করেনি এটা ঠিক। কিন্তু আমাদের ব্যবসা অবৈধ করেনি। তাই আমরা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি।’

‘আপনারা যে মোবাইল ফোন সাড়ে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন সেই মানের মোবাইল ফোন বাজার থেকে তো ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকায় কেনা সম্ভব’— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কম দামের পণ্যের ক্ষেত্রে হয়তো গ্রাহকদের একটু বেশি টাকা দিতে হচ্ছে। কিন্তু বেশি দামের পণ্যগুলো বেশ সস্তায় বিক্রি করা হচ্ছে।’

যোগাযোগ করা হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘নতুন করে কোনো এমএলএম কোম্পানি অনুমোদন দেওয়া হয়নি এবং কোনো কোম্পানির লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। তবে এমএলএম কোম্পানিগুলো হাইকোর্টে রিট করেছে। তাই এদের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া অবৈধ হবে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে হাইকোর্ট।’