সাড়ে আট মাস পর জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার মূল আসামি মইনুল হাসান শামীমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। তাদের এ দাবি সত্য হলে মামলার বিচারের পথে বড় অগ্রগতি ধরে নিতে পারি।
কিন্তু হত্যার বিচার কি দীপনের বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানের কষ্ট কমাতে পারবে? পারবে না। বাবা-মা সন্তানকে, স্ত্রী স্বামীকে কিংবা সন্তানেরা বাবাকে ফিরে পাবেন না। এই না পাওয়ার বেদনা নিয়েই বাবা-মাকে বেঁচে থাকতে হবে। সন্তানদের বড় হতে হবে। বলা হয়, পিতার কাঁধে সন্তানের লাশই পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী।
অধ্যাপক ফজলুল হক আক্ষরিক অর্থেই সেই লাশ বহন করেছেন। তার আগে তাঁকে জাগৃতি প্রকাশনীতে সন্তানের খোঁজে গিয়ে তাঁর রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত শরীর দেখেতে হয়েছে।
সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। এরপর যতবারই দীপনের প্রসঙ্গ এসেছে, তিনি নিজের বেদনা চেপে রেখে সব সন্তানহারা বাবার বেদনার কথা বলেছেন। সমাজ ও মানুষের ভেতরে শুভবোধ জাগ্রত হওয়ার কথা বলেছেন। একজন মানুষ কতটা মহৎ হলে এ রকম অনুভূতি ব্যক্তি করতে পারেন!
দীপন হত্যার আসামি শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার খবর শুনে অধ্যাপক ফজলুল হক বলেছেন, ‘দীপনকে ফিরে পাব না। এই কষ্ট নিয়েই বেঁচে আছি।’ এই কষ্ট কেবল দীপনের বাবার নয়, ঘাতকের হাতে নিহত সবার স্বজনদের। গত দুই বছরে অভিজিৎ, নিলয়, নীলাদ্রি, ওয়াশিকুরসহ বেশ কয়েকজন মুক্তচিন্তার মানুষ জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে খুন হয়েছেন। তাদের হাত থেকে রেহাই পাননি বিদেশি নাগরিক, নামাজরত মুসল্লি, মন্দিরের পুরোহিত ও গির্জার যাজকও। গত ১ জুলাই জঙ্গিরা গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়ে ২০ জন দেশি-বিদেশি মানুষকে হত্যা করেছে। গত মঙ্গলবার রাতে নরসিংদীতে তারা কুপিয়ে জখম করে এক মুদি দোকানিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে আইএস এর দায় স্বীকার করেছে।
অধ্যাপক ফজলুল হক সন্তান হত্যার বিচারের থেকেও জোর দিয়েছেন মানুষের শুভবোধের। শুভচিন্তার। তিনি এমন এক সমাজের কথা বলেছেন, যেখানে কাউকে বই লেখা বা ছাপার জন্য বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে না। সমাজে তর্ক থাকবে, যুক্তি থাকবে। মানুষ যুক্তি দিয়েই অপর পক্ষের যুক্তি খণ্ডন করবে।
চাপাতি দিয়ে নয়। অভিজিৎ রায়ের লেখা বইয়ের জবাবে তারাও বই লিখতে পারতেন। নিজে আহত বোধ করলে আদালতে প্রতিকার চাইতে পারতেন। সেসব না করে উগ্রবাদী গোষ্ঠী মানুষ হত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
অধ্যাপক ফজলুল হক বলেছেন, ‘দীপনসহ যারা খুন হয়েছে, তাদের তো কোনো শত্রু ছিল না। তারা কখনো মানুষের মনে কষ্ট দেয়নি। যারা এই খুনগুলো করেছে, তাদের আমি জল্লাদ বলি। তাদের বিচার হওয়া উচিত। যারা এই জল্লাদদের খুনের পরিকল্পনা দিচ্ছে, তাদেরও বিচার হওয়া খুব দরকার।’
হ্যাঁ, জল্লাদের পেছনে যারা আছে, যারা শামীমের মতো তরুণদের ঘাতক বানায়, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। ভবিষ্যতে জল্লাদ দর্শন দিয়ে যাতে কেউ মানুষ হত্যায় প্ররোচিত করতে না পারে, সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
শামীমের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তাঁরা আশুলিয়ায় একজন গানের শিক্ষককে হত্যা করেছেন। তাঁর অপরাধ, তিনি গান শেখাতেন। জল্লাদেরা রেজাউল করিম নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষককে হত্যা করেছে, তিনিও তাঁর নিজের এলাকায় একটি গানের স্কুল চালাতেন। সংগীত মানুষের মনকে পবিত্র ও শুদ্ধ করে। কিন্তু এই জল্লাদেরা সেই শুদ্ধতাকেই হত্যা করতে চাইছে।
গত বছরের ৩১ অক্টোবর আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর অফিসে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। খুনের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (আনসার আল ইসলাম) ওই খুনের দায় স্বীকার করে। শামীমের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মাধবপুর গ্রামে। সিলেটের মদনমোহন কলেজের ছাত্র শামীম প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ফয়সাল আরেফিন দীপনকে খুনের ঘটনায় তিনি ছাড়া আরও পাঁচজন অংশ নেন। হত্যাকাণ্ডটি পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তাঁর। তিনি আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার শীর্ষ চার মাসুলের (দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি) একজন। তাঁর সাংগঠনিক নাম শামীম ওরফে সমির ওরফে ইমরান।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশের জন্য দীপনকে টার্গেট করা হয়েছিল। খুনের আগে অন্তত এক মাস তাদের প্রশিক্ষণ হয়েছে। ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়াউল হক। তিনি খুন করতে উদ্দীপ্ত করেছেন। ওই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা প্রথমে টঙ্গী ও পরে মহাখালীর একটি বাসা ভাড়া নেয়।’
দীপন যেদিন খুন হন, ওই দিনই শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনের ওপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। ওই ঘটনায় সুমন পাটোয়ারি নামে সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে গত ১৫ জুন বিমানবন্দর উড়ালসেতু এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে সুমন পাটোয়ারি দীপন খুনের ঘটনায় শামীমের সম্পৃক্ততার কথা জানান পুলিশকে। মইনুল হাসান শামীম এর আগে ২০১০ সালে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের প্রচারপত্র বিতরণের সময় ছাতক থানার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা হয়। ওই মামলায় পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। একপর্যায়ে শামীম সুনামগঞ্জের সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান।
শামীমের বড় ভাই আবু জাফর বলেছেন, ‘আমার ভাই খুবই নিরীহ প্রকৃতির ছেলে। সে রাতে ভয়ে ঘর থেকে বের হতো না। এখন শুনি সে ঢাকায় গিয়ে বড় সন্ত্রাসী হয়েছে, মানুষ খুন করেছে। আমরা এর কিছুই জানি না। গত ঈদে সে বাড়িতে আসেনি। তখন থেকে তার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।’
শমীমের গ্রেপ্তারের ঘটনা থেকে কয়েকটি সত্য বেরিয়ে এসেছে। এক. শামীমেরা স্বেচ্ছায় কেউ জল্লাদ হননি। তাঁদের জল্লাদ বানানো হয়েছে। তাঁর ভাইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি ছিলেন খুবই নিরীহ ও শান্ত স্বভাবের। এই তরুণদেরই ঘাতক বাহিনী নিশানা করে। দুই. শামীমেরা গ্রেপ্তার হলেও জামিন পেয়ে যান। তিন. শামীম আনসার আল ইসলাম নামে যে সংগঠনের হয়ে জল্লাদ বাহিনীতে নাম লিখিয়েছেন, সেই সংগঠনটি এখনো নিষিদ্ধ নয়।
আয়মান আল-জাওয়াহিরি আল-কায়েদার দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতীয় উপমহাদেশে আল-কায়েদার শাখা (একিউআইএস) হিসেবে আনসার আল ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে। সরকার আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করেছে।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, আনসার আল ইসলামকে এখনো কেন নিষিদ্ধ করা হলো না? (প্রথম আলো)
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ২:৩০ পিএম, ২৫ আগস্ট ২০১৬, বৃহস্পতিবার
ডিএইচ