শিক্ষার হার যে এলাকায় যতো কম, সেই এলাকায় মাতব্বরদের দাপটও ততো বেশি। চুরি নিয়ে মুখ খোলায় হয়েছিল মারধর।গ্রামের মাতব্বরদের না জানিয়ে সেই হামলার কথা পুলিশকে জানানোয় হতে হয়েছিল ‘একঘরে’। ছাড়তে হয়েছিল এলাকা। ভাইপোর বউ-ভাত উপলক্ষে ছ’বছর বাদে গ্রামে ফিরে বছর পঁয়তাল্লিশের আবিদা বিবি (নাম পরিবর্তিত) দেখলেন, পরিস্থিতি একচুলও বদলায়নি। উল্টে হাঙ্গামা বাধানোর অভিযোগে তাঁকে তিন ঘণ্টা গাছে বেঁধে রাখা হয়। মাতব্বরদের ‘ফতোয়া’য় ঘাবড়ে গিয়ে বধূটির সাহায্যে এগিয়ে আসেনি কেউ। এমনকী, তাঁর দাদাও!
মালদহের ইংরেজবাজার থানার বটতলা গ্রামে শুক্রবার ওই কাণ্ডের খবর পেয়ে আবিদাকে উদ্ধার করে পুলিশ। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া মহিলাকে ভর্তি করাতে হয় মালদহ মেডিক্যালে। সেখানেই চিকিৎসা চলছে তাঁর। জেলার পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বধূটি এখনও অভিযোগ জানাতে পারেননি। উনি অভিযোগ জানালেই ব্যবস্থা নেব। কেন ওঁর সঙ্গে গ্রামের লোক এমন ব্যবহার করল, দেখছি আমরা।’’
ইংরেজবাজারের বহু গ্রামে এখনও রয়েছে স্বঘোষিত মাতব্বর-মুরুব্বিদের দাপট। সালিশি সভা বসিয়ে ন্যায়বিচারের নামে যথেচ্ছ শাস্তি দেওয়ার প্রবণতাও নতুন নয়। চলতি বছর ওই থানা এলাকায় এ ধরনের অন্তত দু’টি ঘটনা রয়েছে পুলিশের নজরে। যে এলাকায় শিক্ষার হার যত কম, সেখানে তত বেশি দাপাদাপি মাতব্বরদের। অমৃতি পঞ্চায়েতের বটতলাও তেমনই এক গ্রাম। প্রধানত সংখ্যালঘু খেতমজুর, দিনমজুরদের বাস। হাজারখানেক লোকের গ্রামে বড়জোর ৪৫ শতাংশ বাসিন্দার অক্ষরজ্ঞান রয়েছে।
আবিদার স্বামী ও বড় ছেলে ভিন্-রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করেন। দম্পতির তিন ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে বিবাহিতা। ২০০৯ পর্যন্ত আবিদা থাকতেন বটতলাতেই। ওই বছর গ্রামে তাঁর বাড়ির পাশে একটি শিশু-শিক্ষা কেন্দ্রের বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। ঠিকাদার বাড়ি তৈরির কাঁচামাল দেখভালের দায়িত্ব দেন আবিদাকে। সেই সময় গ্রামেরই দুই বাসিন্দা নির্মাণ-সামগ্রী চুরি করতে গেলে হাঙ্গামা বাধান বধূটি। পুলিশ সূত্রের দাবি, তার জেরে মহিলা ও তাঁর মেয়ের উপরে হাঁসুয়া-লাঠি নিয়ে হামলা করে দুই অভিযুক্তের পরিবার। আবিদা থানায় হামলার অভিযোগ করায় ছ’জন ধরা পড়ে। তারা এখন জামিনে রয়েছে।
সরাসরি পুলিশের দ্বারস্থ হওয়ায় মাতব্বরেরা সপরিবার আবিদাকে সামাজিক বয়কট করার নিদান দেয় বলে অভিযোগ। আবিদার কথায়, ‘‘ধোপা-নাপিত বন্ধ হয়ে যায়। এমনকী, আমাদের সঙ্গে কথা বললেও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে বলে ফতোয়া দিয়েছিল মাতব্বরেরা।’’ এই পরিস্থিতিতে এলাকা ছেড়ে জেলারই অন্যত্র চলে যায় পরিবারটি।
আবিদার দাদা শেখ রুনুর (নাম পরিবর্তিত) ছেলের বউ-ভাত ছিল এ দিন। তাতে যোগ দিতে ছোট ছেলেকে নিয়ে বটতলায় ফিরেই বিপদের মুখে পড়েন আবিদা। বধূটির কথায়, ‘‘যে দাদা আমাকে নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে ডাকল, সে-ই বলল, ‘তোকে বাড়িতে ঢুকতে দিলে মাতব্বরদের কোপে পড়ব। তুই ফিরে যা’। কেন দাদা এমন করল, সেটাই জানতে চাইছিলাম। তখনই তেড়ে এল গ্রামের কিছু লোকজন।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, আবিদা গ্রামের শান্তি নষ্ট করছেন অভিযোগে তাঁকে টানতে-টানতে নিয়ে গিয়ে পিছমোড়া করে গাছে বেঁধে ফেলে মাতব্বরদের সাঙ্গোপাঙ্গেরা। মহিলা চিৎকার করলেও সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। মায়ের হাত দুয়েক দূরে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়েছিল বছর আটের বালক। মায়ের হাতের বাঁধন খুললে ‘বিপদ হবে’ বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে তাকেও। আবিদার কথায়, ‘‘চুরি আর অন্যায় হামলার প্রতিবাদ করাটাই আমার কাল হল! গ্রামের কেউ সাহায্য করতে এগোল না। আমার নিজের দাদাও না!’’
শেখ রুনু দাবি করেছেন, বোনকে তিনি বাড়ির অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেননি। আবিদা স্বেচ্ছায় গ্রামে এসেছেন। কিন্তু যে আবিদা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাড়ি বেচে গ্রাম ছেড়েছিলেন, বিনা কারণে তিনি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে দাদার বাড়িতে আসতে যাবেন কেন? রুনু এবার নিরুত্তর। তবে পরে বলেন, ‘সমাজের নির্দেশ আছে, বোনের সঙ্গে কথা বললে দশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে।সামান্য খেতমজুর আমি। টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বোনকে গাছে বাঁধার ব্যাপারটায় খারাপ লাগলেও কিছু করার ছিল না।’
গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, মোড়ে-মোড়ে জটলা।স্থানীয় মাতব্বর বলে পরিচিত রাইহান শেখ, সাহেব শেখ, হাসেন শেখরা দাবি করেন,‘আবিদার পরিবারের লোকেরাই ওকে গাছে বেঁধেছে।ওই মহিলা নানা সময় গ্রামের মানুষের বিরুদ্ধে নানা রকম মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।ফলে, গ্রামবাসী ওঁকে এড়িয়ে চলে। বয়কট করা বা ওঁর সঙ্গে কথা বললে জরিমানা দিতে হবে বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা ঠিক নয়।’
এলাকায় রাজনৈতিক প্রভাব বেশি কংগ্রেসের।স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য তথা কংগ্রেস নেতা সাহাবুল শেখ বলেছেন,‘ঘটনার পিছনে রয়েছে গ্রামবাসীর একাংশ।এর বেশি জানি না।’তবে জেলা কংগ্রেসের সভানেত্রী তথা সাংসদ মৌসম বেনজির নুর বলেন,‘মহিলার উপরে এমন হামলা কখনই কাম্য নয়।’রাজ্যের মন্ত্রী তথা এলাকার তৃণমূল এমপি কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বলেন, ‘পুলিশকে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলেছি।কোন যুক্তিতে এক মহিলাকে এভাবে অপমান করা হল?’ ঘটনায় থমকে গিয়েছে বধূটির ছোট ছেলে। আট বছরের বালক কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না, ‘মা, ওরা তোমায় বাঁধল কেন?’ -এবিপি
নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ০৬:০৩ পিএম,০৬ ডিসেম্বর ২০১৫, রোববার
এমআরআর