বিশেষ সংবাদ

তালিকায় গরীবের নাম দেখিয়ে চেয়ারম্যান স্বজনদের নাম্বারে মোবাইল ব্যাংকিং

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা কর্মসূচি চালু করেছেন। এ কর্মসূচির আওতায় করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের নিম্নআয়ের মানুষদের মধ্যে-রিকশাচালক, ভ্যানচালক, দিনমজুর, কৃষি শ্রমিক, দোকানের কর্মচারী, ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যবসায় কর্মরত শ্রমিক, পোলট্রি খামারের শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, হকার, নির্মাণ শ্রমিকদের মতো পেশাজীবীরা সহায়তা পাচ্ছেন।

এটি বাস্তবায়ন ও পরিবারগুলো চিহ্নিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রতিটি জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদকে।

চিহ্নিত করা পরিবারগুলোকে টাকা দেয়া হচ্ছে মূলত মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, রকেট, নগদ এবং শিওরক্যাশের মাধ্যমে। নগদ সহায়তা হলেও কাউকে নগদে টাকা দেয়া হবে না অর্থাৎ মোবাইল ব্যাংকিং পরিসেবার মাধ্যমে কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগী প্রত্যেক পরিবারের হিসাবে সরাসরি এককালীন দুই হাজার পাঁচশ টাকা করে নগদ অর্থ পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছে যাবে।

জয়পুরহাট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলায় নগদ টাকা পাবে ৫০ হাজার পরিবার। এরই মধ্যে জেলায় ১১ হাজার পরিবার নগদ অর্থ পেয়েও গেছেন। এই পরিবারগুলো চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একটি কমিটিকে। এই কমিটিতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, সমাজের গণমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে। একইভাবে পৌরসভা পর্যায়ে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটিও কাজ করেছে।

জয়পুরহাট সদর উপজেলার সাত নম্বর বম্বু ইউনিয়নে ১৩৫৭ জন দরিদ্র ব্যক্তি নগদ অর্থ পাওয়ার কথা রয়েছে। সে অনুযায়ী তালিকাও প্রস্তত করে তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। কিন্ত ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ড কমিটির মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে এ তালিকা প্রস্তত করার কথা থাকলেও বাস্তব চিত্র উল্টো।

সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড উপ-কমিটির সভাপতি ইউপি মেম্বারকে না জানিয়ে চেয়ারম্যান তার ঘরে পছন্দমতো লোকদের যুক্ত করে নিয়েছেন। তার পছন্দের তালিকায় থাকছে আত্মীয় স্বজনদের নাম। যেখানে ভোটার আইডি কার্ডের সঙ্গে ব্যক্তির কোনও মিল নেই এবং স্বচ্ছল বিত্তবানদের নামসহ একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তির নামও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে জয়পুরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের এলাকাবাসীরা। ওই ওয়ার্ডবাসীরা অভিযোগে জানান, প্রধানমন্ত্রীর এককালীন আড়াই হাজার টাকা প্রদানের প্রকাশিত তালিকা দেখে তারা বিস্মিত হয়েছেন। ওই তালিকায় চার নম্বর ওর্য়াডের ৬৮১ ক্রমিকে আবেদ আলীর পরিবারের অনেকের নিজস্ব মোবাইল থাকা সত্ত্বেও চেয়ারম্যান মোল্লা শাসছুল আলমের ব্যবহৃত সরকারি মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।

৫২৮ ক্রমিকে সেলিনা বেগম, ৫৪০ ক্রমিকে আনিছুর রহমান, ৫৬১ ক্রমিকে শামছুল আলম, ৬৬১ ক্রমিকে রুজিনা বেগমের নিজস্ব মোবাইল থাকা সত্ত্বেও চেয়ারম্যানের ছেরে রতনের দুইটি মোবাইল নম্বর, চেয়ারম্যানের পুত্রবধূ তানিয়ার মোবাইল নম্বর, চেয়ারম্যানের একান্ত আস্থাভাজন ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ইউনিয়ন য়ুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জনির মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।

চার নম্বর ওয়ার্ডে ৬৪৩ ক্রমিকে কাজেম উদ্দিনের নাম তালিকাভুক্তিতে দেওয়া হলেও এই নামে কোনও ব্যক্তি নেই বলে লিখিতভাবে জানিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসার ফেরদৌস আলম।

এদিকে অসহায় ও দরিদ্র সেলিনা বেগম, শামছুল আলম আইডি কার্ড ও মোবাইল নম্বর চেয়ারম্যানকে দেওয়া সত্ত্বেও তালিকায় তাদের নামের পাশে চেয়ারম্যানের ছেলে ও জনির মোবাইল নম্বর দেখে তারা হতবাক হয়েছেন।
এ বিষয়ে সুষ্টু তদন্ত করে মোবাইল নম্বর পরিবর্তনের জন্য সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

সম্প্রতি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে বম্বু ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের পুরুষ ইউপি সদস্য লোকমান হোসেন ও সংরক্ষিত নারী সদস্য পারভীনকে ২৫০০ টাকার তালিকাভুক্তিতে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

দরিদ্র আবেদ আলী ,সেলিনা বেগম, শামছুল আলমসহ আরো কয়েকজন জানান, ‘আমাদের নিজস্ব মোবাইল নম্বর দেওয়ার পরেও তালিকায় চেয়ারম্যান,চেয়ারম্যান ছেলে ও জনির মোবাইল ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা এর কিছুই জানি না এবং তদন্ত করে এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’

এলাকাবাসীর পক্ষে লিখিত অভিযোগকারী ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কোমরগ্রাম এলাকার হারুনূর রশিদ জানান, অসহায়,গরিব ও করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের নামের তালিকার পাশে মোবাইল নম্বর দেওয়া সত্ত্বেও চেয়ারম্যান, চেয়ারম্যানের ছেলে , পুত্রবধূসহ আস্তাভাজনদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে যা দুঃখজনক। অসহায় মানুষেরা যেন টাকা পায় এজন্যই অভিযোগ দিয়েছি।

এ ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য খায়রুল আলম মিঠু বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনার ২৫০০ টাকার তালিকা তৈরির জন্য ইউনিয়ন পরিষদে সভা হলো,কমিটিও তৈরি করা হলো। পরে সব কিছুই চেয়ারম্যানের ছেলে করেছে। আমি এর কিছুই জানি না।

সাত সম্বর বম্বু ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন জানান, চার নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য মিঠু ও ছয় নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য আসাদুলের কাছে কোনও নামই নেয়নি চেয়ারম্যান, অথচ কারোনাকালীন দুর্যোগের জন্য তারা ওই ওয়ার্ডের উপ-কমিটির সভাপতি। তাছাড়া প্রত্যেক ওয়ার্ডে অল্প কিছু করে নাম নেওয়া হয়েছে ইউপি সদস্যদের কাছ থেকে। বাদ বাকি সব নামই দিয়েছে চেয়ারম্যান ও চেয়ারম্যানের ছেলে।

অভিযোগে বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোল্লা শামসুল আলম বলেন, ‘একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। প্রণোদনার অর্থ আত্মসাত করার কোনও অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমি চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দেবো।
জয়পুরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিল্টন চন্দ্র রায় জানান, ‘চেয়ারম্যান ও চেয়ারম্যানের ছেলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

জয়পুরহাট করেসপন্ডেন্ট, ২ জুলাই ২০২০

Share