বজ্রপাত এখন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বর্তমান সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে ‘ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ’ হিসেবে ঘোষণা করে। আর এ প্রাকৃতিক দুর্যোগকে প্রাকৃতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এবং বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সারাদেশে তালগাছের সংখ্যা বাড়াতে রাস্তার দু’পাশে কিংবা বাড়ির পরিত্যাক্ত আনাচে-কানাচে ও পুকুর,ডোবা-নালার পাড় তালের আঁটি রোপণের জন্য ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দেন। গ্রামীণ ব্যাংকের সক্রীয় সদস্যগণ কোটি কোটি তালের আঁিট একদিনেই রোপণ করে দেশে গড়ে তুলতে পারে প্রকৃতির সবুজ বেষ্টনী।
কৃষিবিভাগের সহায়তা নিয়ে বজ্রপাত প্রতিরোধে পরিবেশবন্ধু এ তালগাছের সংখ্যা বাড়াতে তালের আঁটি রোপণ করতে গ্রামীণ ব্যাংকের ১ কোটি সদস্যদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানাই। গ্রামীণ ব্যাংক কেন্দ্রিয়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দেশ ও জাতিকে বজ্রপাতের মত এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে নতুনভাবে উদ্যোগ নিতে পারে। কেননা গ্রামীণ ব্যাংকের এক কোটি সদস্য স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বিনাশ্রমে ও অর্থব্যয়হীনভাবে এ কাজটি করতে পারবে।
বাংলাদেশ বাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন এ গ্রামীণ ব্যাংক, সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়,আবহাওয়া, প্রাণিসম্পদ,কৃষি ও ত্রাণ-দুর্যোগ বিভাগের যৌথ সিদ্ধান্তে অর্থ ছাড়াই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ চমৎকার সিদ্ধান্তটি দেশ ও জাতির স্বার্থে বাস্তবায়ন সম্ভব। পাশাপাশি তালগাছ কাটা ও তালের বীজ বাড়াতে গ্রীস্মকালে রাস্তায় রাস্তায় ভ্যান চালকদের তালের শাঁশ বিক্রি সম্পূর্ণ নিষেধ করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে গ্রামীণ মা-বোনরা তাল‘গোলিয়ে ’আটিঁ আলাদা করার পর তা’ যথাযথাভাবে কিছুদিন সংরক্ষণ করে তা রোপণ করার মানসিকতা সৃষ্টি এখন প্রয়োজন। চ্াঁদপুরের একজন কৃষিবিদ বলেছেন, তালের আঁিটিটি প্রায় ১ ফুট পর্যন্ত মাটিতে পুতে রাখার পর পরের বছর তাল গাছ গজাবে। দেশের প্রতিটি গৃহিণী যদি তালের আাঁটি সংরক্ষণ করে-তা হলে তা রোপণ করতে পারবে।
২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের ডাইরির পরিসংখ্যান মতে- সারাদেশে ৮১ হাজার ৬শ’৭৮টি গ্রামের ভেতর গ্রামীণ ব্যাংকের ২ হাজার ৫শ’ ৬৮টি শাখা রয়েছে। এর কেন্দ্র সংখ্যা-১ লাখ ৩৫ হাজার ৪শ’ ১৭টি এবং সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ২১ হাজার ৯শ’ ৪৭ জন। এর মধ্যে মহিলা সদস্য সংখ্যা ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৫শ ৮২ জন এবং পুরুষ ঋণ গ্রহীতার সংখ্যা ৩ লাখ ২২ হাজার ৩শ ৬৫ জন। ঋণগ্রহীতাদের ৯৭% মহিলা। সারাদেশে ২২-‘২৩ অর্থবছরে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ৫ লাখে ছাড়িয়ে গেছে বলে জানা গেছে। চাঁদপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের ৬ টি এরিয়া অফিস ও ৫৪ টি শাখায় ১ লাখ ৮৩ হাজার সদস্য রয়েছে।
শুধু বিভাগীয় আদেশ পেলেই গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যগণ এটা বাস্তবায়নে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। কেননা সারাদেশে এ বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৪৮তম শাহাদাৎবার্ষিকী ও ১৫ আগাস্ট জাতীয় শোক দিবসের দিন গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ও কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ সাড়ে ৩ কোটি ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করেছে। পুরো বছর ২০ কোটি গাছের চারা রোপণ করার নির্দেশ রয়েছে। এ কাজটি এককভাবে বাস্তবায়ন করতে দেশের আর কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের এত সংখ্যক জনবল নেই।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়ায় মানুষ ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। সারাদেশে কোনো না কোনো স্থানে বজ্রপাতে মানুষ, গবাদিপশু ও বন্যপ্রাণী মারা যাচ্ছে। এখন বজ্রপাত কোনো মৌসুমই মানছে না। তবে বর্ষা মৌসুম এলে বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যায়।
মেঘলা আকাশ, বিদ্যুতের চমক,গগনভেদী আওয়াজ আর ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বজ্রপাত ঘটতে থাকে। এ অঞ্চলের আবহাওয়া বিশ্লেষণ করে আবহাওয়াবিদগণ মতামত দিয়েছেন, বছরের এপ্রিল-জুলাই পর্যন্ত বজ্রপাতের আশঙ্কা বেশি থাকে। আর এ দুর্যোগ প্রায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকে।
মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে এখন প্রতি বছর বর্ষাকালে বজ্রপাত মহামারীর আকার ধারণ করেছে। কয়েক বছরে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর হিসাব রেকর্ড করা হয়েছে।এটি নি:সন্দেহে আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের দেশে সম্প্রতি বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে। বাংলা ও বাঙালির জনপ্রিয় ফল তাল। ভাদ্র মাসের তাল না খেলে কালে ছাড়ে না বলে বাঙালি সমাজে প্রবাদও রয়েছে। তাই তালগাছের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। গ্রামেগঞ্জে প্রচুর পরিমাণে তালগাছ ও নারিকেল গাছগুলো বজ্র নিরোধক হিসেবে কাজ করে।
বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, ‘আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বজ্রপাত। প্রতিবছর বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যায় তার এক-চতুর্থাংশ মারা যায় বাংলাদেশে। বজ্রপাতের এমন আচরণই বলে দিচ্ছে মানবজাতির কার্যক্রমের উপর প্রকৃতি কতটা নাখোশ।
মানুষের অধিক চাহিদা আর লোভে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্টের খেসারত হিসেবে প্রকৃতির প্রতিশোধ বজ্রপাত কিনা তা এখন গভীরভাবে ভাবতে হবে। এক সূত্র মতে, বেশি বজ্রপাত সংঘটিত দেশেগুরো মধ্যে ভেনিজুয়োল, কঙ্গো, ব্রাজিল ও বাংলাদেশের নাম রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের তথ্য মতে,বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি সম্পর্ক আছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের মতোই ভয়ঙ্কর হতে পারে বজ্রপাত। কালবৈশাখী-ঘূর্ণিঝড়,বন্যা-জলোচ্ছ্বাস,ভূমিকম্প-অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে নতুন দুর্যোগ হিসেবে যুক্ত হয়েছে বজ্রপাত্। বিগত সাড়ে ৯ বছরে বজ্রপাতে দেশে আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।
এ বছরের সাড়ে পাঁচ মাসে বজ্রপাতে মারা গেছে শতাধিক মানুষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী- ২০১১-২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছে ২ হাজার ২শ ৭৬ জন। দেশের ঐ বিভাগটি বলছে-জলবায়ু পরিবর্তন আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাত বাড়ছে। তাপমাত্রা যত বেশি হবে বজ্রপাত তত বাড়বে। আবহাওয়াবিদগণ বলেছেন‘ গত ৪০ বছরে দেশের তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রী বৃদ্ধি পেয়েছে। ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে ২০% বজ্রপাত বেড়ে যায়। এ হিসাবে বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৫%।
বাংলাদেশে মার্চ-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। প্রাকৃতিক বিরূপ প্রভাবে বজ্রপাত হচ্ছে। তারপরও মানুষ থেমে নেই। বাংলা ও বাঙালির জনপ্রিয় ফল তাল। ভাদ্র মাসের তাল না খেলে কালে ছাড়ে না বলে বাঙালি সমাজে প্রবাদও রয়েছে। তালগাছের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এক সময় গ্রামেগঞ্জে প্রচুর পরিমাণে তাল, খেজুর, সুপারি ও নারিকেল গাছের সমারোহ বিদ্যমান ছিল। সেগুলো বজ্র নিরোধক হিসেবে কাজ করতো। এখন কালের আবর্তে দ্রুত নগরায়ন ও পরিবারভাঙ্গন বেড়ে বনজ এলাকা দিন দিনই কমে যাচ্ছে।
পরিবেশবিদদের মতে-তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। কারণ তালগাছের বাকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকে। তালগাছের উচ্চতা ও গঠনগত দিক থেকেও বজ্রপাত নিরোধে সহায়ক। তালগাছের পাশাপাশি নারকেল গাছ, সুপারিগাছের মতো উচ্চতা সম্পন্ন গাছ বজ্রপাত নিরোধে বেশ কার্যকরি। প্রকৃতি দিয়েই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। বজ্রপাত শুধু বাংলাদেশে ; নয় সারা বিশ্বের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঘন সবুজে আবৃত বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের মাঝখানে কর্দমাক্ত মেঠোপথ, দু’ পাশে মাথা উঁচু তালগাছ আমাদের উপকূল ও গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পেতাম। এমন সুন্দর ও নৈসর্গিক দৃশ্য এখন খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। তালগাছ স্বল্পতার কারণে বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মানুষ ও পশুপাখিসহ জীববৈচিত্র্য। আশ্রয় হিসেবে এ গাছ বাবুই পাখিদের বড়ই প্রিয় জায়গা। বাবুই ছাড়াও অঞ্জন, বাদুরসহ নানা প্রাণী আশ্রয় হিসেবে এ গাছটি বেছে নেয়। দেশে তালগাছ প্রায় বিলুপ্ত হওয়ায়ই মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ছে। একটি তালগাছ ৯০-১শ ফুট উঁচু হয়। ইহা উঁচু গাছ হওয়ায় বজ্রপাত সরাসরি এ গাছের মাধ্যমে মাটিতে গিয়ে আমাদের রক্ষা করে।
এ ছাড়াও তালগাছ ভূমিক্ষয়, ভূমিধস, ভূগর্ভস্থ পানির মজুত বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা রক্ষা করে। তালগাছের আকর্ষণে বাড়ে মেঘের ঘনঘটা। ঘটে বৃষ্টিপাতও। তালগাছের শিকড় মাটির অনেক নিচ পর্যন্ত প্রবেশ করায় ঝড়ে হেলে পড়ে না কিংবা ভেঙে পড়ে না। যেখানে কোনো কিছু চাষ হয় না সেখানেও তালগাছ তার শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়।
নতুন রাস্তার ল্যান্ডস্কেপ, বাঁধ ও নদীভাঙন ঠেকাতে এর রয়েছে সফল প্রয়োগ। পরিশেষে বলা যায়- তালগাছ শুধুই বজ্রপাতের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করবে না বরং তালগাছের নানান উপকারিতা রয়েছে। মানুষ বিভিন্নভাবে তালগাছ দ্বারা উপকৃত হয়। যেমন: তালপাতার পাটি, তালপাতার পাখা,তালের রস, তালের গুড়, তালের শাঁস দিয়ে সুস্বাদু মিষ্টি খাবার রান্না করা হয় এবং তাল দিয়ে ঐতিহ্যবাহী অনেক পিঠা তৈরি করা হয়। তালের গাছ ও পাতা ঘরের কাজে ও জ্বালানি কাজে ব্যবহার করা হয়। তালের পাতায় সুন্দরভাবে বাসা তৈরি করে বসবাস করে। এ সব আমাদের গ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রেখেছে।
তালগাছ মানুষ ও পাখি উভয়ের জন্যই উপকারী। এ দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষের ভাবনার অন্ত নেই। তালগাছ লাগানোর পাশাপাশি নারকেলগাছ ও সুপারিগাছ লাগানোর উদ্যোগকেও সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। এটা হোক দেশের নোবেল বিজয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের একটি নতুন উদ্যোগ।
গ্রামীণ ব্যাংকের পাশাপাশি আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তার দুপাশে,পুকুর পাড়ে, বাড়ির আশপাশে,পরিত্যক্ত জায়গায় তালবীজ রোপণ করতে পারি। বজ্রপাত থেকে জীবন রক্ষায় উঁচু তালগাছের বিকল্প নেই। এতে গ্রামীণ ও উপকূলীয় জনপদে সারি সারি তালগাছের পরিকল্পিত চাষে নান্দনিক সৌন্দর্যরূপ ফুটে উঠবে।
দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরা উদ্ভূদ্ধকরে অন্তত: একটি করে তালবীজ রোপণ করা যেতে পারে। শিক্ষক ও অভিভাবকগণ একটু উদ্যোগ নিলেই বদলে যাবে আমাদের চিরপরিচিত পরিবেশ।
তথ্য : দৈনিক ইত্তেফাক, গ্রামীণ ব্যাংক বার্তা ও ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত। লেখক পরিচিতি: আবদুল গনি,শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী,চাঁদপুর। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১৭১৮-২১১০৪৪।