Home / ফিচার / ঢাবির প্রথম মুসলিম ছাত্রী ও দেশের প্রথম নারী অধ্যক্ষের ইতিহাস
ঢাবির প্রথম মুসলিম ছাত্রী ও দেশের প্রথম নারী অধ্যক্ষের ইতিহাস

ঢাবির প্রথম মুসলিম ছাত্রী ও দেশের প্রথম নারী অধ্যক্ষের ইতিহাস

ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান ছাত্রী ফজিলতুন্নেসা জোহা। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে ফজিলতুন্নেসা হলেন প্রথম স্নাতক ডিগ্রিধারী।

তাঁর আগে আর কোন মুসলমান মেয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করতে পারেনি। অসম্ভব মেধার অধিকারী ফজিলতুন্নেসা শুধু অসামান্য সুন্দরীই ছিলেন না তি্নি ছিলেন অঙ্কের এম এ এবং একজন উচুঁদরের বাক্পটু মেয়ে।

১৯২৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেনিতে প্রথম স্থান লাভ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। বাংলার রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থাকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে অসম সাহস ও উচ্চ শিক্ষা লাভের প্রবল আকাংখায় বোরকা ছাড়া বহুবিধ অত্যাচার সহ্য করে উওরসুরী মুসলিম মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করেন ফজিলতুন্নেসা।

নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি সম্পর্কে সওগাতসহ অনেক পত্রিকায় তার বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশিত হয়। আমাদের ব্যার্থতা আমরা এই গুণী নারীকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পারিনি। বর্তমান প্রজন্মও তাকে খুব একটা জানেনা এমনকি বাংলাদেশেও ফজিলতুন্নেসাকে স্মরন করে না।

ফজিলাতুন্নেসা ১৯০৫ সালে (জন্মতারিখ জানা যায়নি) ময়মনসিংহ জেলার করটিয়ার ‘কুমল্লীনামদার’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ওয়াহেদ আলী খাঁ। করোটিয়ার জমিদার বাড়িতে সামান্য একটি চাকরি করতেন ওয়াহেদ আলী খাঁ।

ফজিলতুন্নেসার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে গ্রামে। গ্রামের স্কুলেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু। ৬ বছর বয়সে ফজিলতুন্নেসা করটিয়ার প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। শৈশব হতেই ফজিলাতুন্নেসা লেখাপড়ায় আগ্রহী এবং মেধাবী ছিলেন। তিনি প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হতেন।

স্কুলের বাৎসরিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল দেখে পারিবারিক অস্বচ্ছলতা থাকা সত্বেও তিনি তাঁর মেয়েকে শিক্ষার পথে এগিয়ে দেন। নিম্ন প্রাইমারি, উচ্চ প্রাইমারি ও মাইনর পাস শেষে সামাজিক ও পারিবারিক বাধা অতিক্রম করে ১৯১৭ সালে তিনি ফজিলতুন্নেসাকে ঢাকা নিয়ে আসেন এবং সে সময়ের একমাত্র সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ‘ইডেন স্কুলে’ ভর্তি করে দেন।

কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের পুরস্কার তিনি পান ১৯২১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন(বর্তমান এসএসসি) পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে এবং মাসিক ১৫ টাকা হারে বৃত্তি পান। তখন থেকে লোকের মুখে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে।

এরপর ১৯২৩ সালে ইডেন কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন এবং শিক্ষাবৃত্তি লাভ করেন। অতঃপর কলকাতার বেথুন কলেজে বিএ পড়ার জন্য যান। এই কলেজে তখন তিনিই ছিলেন একমাএ মুসলিম ছাএী। ১৯২৫ সালে ডিসটিংশান সহ বিএ পাশ করেন ফজিলাতুন্নেসা।

তাঁর আগে কোন মুসলিম মেয়ে এই বিরল সম্মানের অধিকারী হয়নি। বিএ পাশ করে তিনি ঢাকা ফিরে আসেন। এর পরে তাঁর পিতা তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিতে মাস্টার্স ক্লাশে ভর্তি করে দেন।

তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাএী। কিন্তু এখানে তিনি কঠিন পরীক্ষায় পড়লেন কারন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার পরিবেশ ছিলনা। এক্ষেএেও ফজিলতুন্নেসা ছিলেন সফল, তিনি সতীর্থদের সাথে গড়ে তুলেন বন্ধত্বময় সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক।

১৯২৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কশাস্ত্রে মিশ্র বিভাগে এমএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান দখল করেন। এমএ পাশ করার পর ১৯২৮ সালে কিছুদিন তিনি ঢাকার ইডেন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য ফজিালতুন্নেসা ইংল্যান্ড যান।

প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে একজন মেয়েকে বিলেত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি নিজ চেষ্টায় ‘ষ্টেটস স্কলারশীপ’ যোগাড় করেন।

এ ব্যাপারে সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দিন ও খান বাহাদুর আবদুল লতিফ তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। ফলে তাঁর বিলেত যাওয়ার পথ সুগম হয়। কিন্তু বাবার অসুখের খবর পেয়ে ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোর্স শেষ না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।

এরপর আর তাঁর বিলেত যাওয়া হয়নি। লন্ডন থেকে ফিরে ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতায় প্রথমে স্কুল ইন্সপেক্টরের চাকুরিতে যোগদান এবং পরে কলকাতার বেথুন কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন।

তিনি এ কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান এবং একই সঙ্গে কলেজের উপাধ্যক্ষা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি বেথুন কলেজের চাকরি ছেড়ে স্বেচ্ছায় ঢাকা চলে আসেন এবং ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন।

বাংলাদেশে তিনিই প্রথম মহিলা অধ্যক্ষ। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি ইডেন কলেজের অধ্যক্ষার পদে আসীন ছিলেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছার অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় বিজ্ঞান ও বাণিজ্যিক বিভাগসহ ইডেন কলেজ ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়। কিন্তু প্রশাসনিক কোন্দলের জের ধরে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই তাঁকে বাধ্যতামূলক আবসর নিতে হয়।

ব্যক্তিগত জীবনে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ্‌র পুত্র প্রথম বাঙালি সলিসিটর জনাব শামসুজ্জোহার সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন ফজিলাতুন্নেসা। নাম হয় ফজিলাতুন্নেসা জোহা।

বিলেতে থাকাকালে তার সাথে জনাব শামসুজ্জোহার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। পরবর্তীতে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর মধ্যস্থতায় জনাব জোহার সাথে ফজিলতুন্নেসার বিয়ে হয়।

এখানে প্রসঙ্গত আরেকটি বিষয়, আমাদের জাতীয় কবি, প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বেগম ফজিলাতুন্নেছার কাছে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হন।

ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন বর্ধমান হাউস হোস্টেলের হাউস টিউটর কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে। ওই বছররে ২৫ ফেব্রুয়ারিখে তারিখে বন্ধু মোতাহারকে লেখা চিঠিতে কবি লিখছেন, ‘ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভাব ছিল sadness-এর। কিছুতেই sad হতে পারছিলাম না। কেবল ভেসে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু আজ ডুবেছি বন্ধু! একেবারে নাগালের অতলতায়।’

কবি তার সমস্ত কবিতা ও গানের সর্বাপেক্ষা উত্তমগুলির সংকলন সঞ্চিতা তার নামে উৎসর্গ করার অনুমতি চেয়েও পান নি। আমরা জানি, সঞ্চিতা শেষাবধি রবীন্দ্রনাথের নামে উৎসর্গীকৃত। অর্থাৎ গণিতের এই ছাত্রীটি নজরুলকে উৎসর্গের অনুমতি দেন নাই।

এ কথা সত্য যে কবি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন যা জানা যায় কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা কবির এক পত্রে। প্রত্যাখ্যাত কবি কাজী মোতাহার হোসেনকে লিখেন, “গণিতজ্ঞ লোকেরা বড্ডো কঠোর নিষ্ঠুর হয়… ওদের কেবলই intellect, heart নেই। আমাদের যেমন কেবল heart, intellect নেই। একেবারে যারে বলে ‘সিলি ফুল’। শেষমেশ ফজিলাতুন্নেসাকে নিয়ে তৈরি সমস্ত অভিমান কবি ঝেড়েছেন গণিতের উপর। কবির ভাষায় ‘কোনো নারী–সুন্দরের উপাসিকা নারী–কোনো অঙ্কশাস্ত্রীর কবলে পড়েছে, এ আমি সইতে পারি নে। নারী হবে সুন্দরের অঙ্কলক্ষী, সে অঙ্কশাস্ত্রের ভাঁড়ার রক্ষী হবে কেন?’

অপর একটি চিঠিতে কবির উতলাভাব আরও উতলা হয়ে পড়েছে, ‘আমার এতদিনে ভারী ইচ্ছে করছে অঙ্ক শিখতে।…আমি যদি বিএ-টা পাশ করে রাখতাম, তাহলে দেখিয়ে দিতাম যে, এম. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট কবিও হতে পারে ইচ্ছে করলে।’

তার পরেও ফজিলাতুন্নেসার প্রতি তার ভালোবাসা মরে যায়নি। তাই নজরুল তার বন্ধুকে লিখেছেন. ‘যেদিন আমি ঐ দূর তারার দেশে চলে যাব–সেদিন তাকে বলো এই চিঠি দেখিয়ে–সে যেন দুটি ফোঁটা অশ্রু তর্পণ দেয় শুধু আমার নামে।’

সে যাই হোক। ফজিলাতুন্নেসা জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন নিঃসঙ্গ নির্জনে। অতঃপর কালের অমোঘ নিয়মে ১৯৭৭ সালে ২১ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন এই বিদুষী নারী।

তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৭ সালে ফজিলাতুন্নেছার নামে হল নির্মাণ করা হয়।

(লেখক- নূর মোহাম্মদ নূরু, সংবাদকর্মী)

আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১: ০০ এএম, ২৪ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার
ডিএইচ

Leave a Reply